বর্তমান সময়ে এমন কোন ক্ষেত্র নেই যেখানে নারীদের পদচারণা নেই। সুযোগ পেলে নারীরা ও যে পুরুষের সমান ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারে এমনকি কোন কোন ক্ষেত্রে পুরুষের চেয়ে এগিয়ে যেতে পারে তা অনেক ক্ষেত্রেই প্রমাণিত। বাংলাদেশের জনসংখ্যার অর্ধেকের বেশী নারী। মোট জনসংখ্যার ৫২.৫ মিলিয়ন হচ্ছে নারী। এছাড়াও মৎস্য বিষয়ক শ্রমশক্তির শতকরা ৩৬ ভাগ মহিলা। উপকূলীয় এলাকায় চিংড়ি পোনা সংগ্রহকারী শ্রমশক্তির শতকরা ৮০ ভাগই নারী ও শিশু। বিপুল এই জনশক্তিকে কাজে লাগিয়ে আত্মনির্ভরশীলতার পাশাপাশি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করা সম্ভব। মহিলারাই পারেন মশা উৎপাদনের উৎস এবং রোগ ব্যাধির বাহক ডোবা কে পুষ্টি বা আমিষ এবং বাড়তি আয়ের উৎস হিসেবে পরিণত করতে পারে (পারভীন ফেরদৌস, ১৯৯৫)।

কেস স্টাডি-১
গ্রামের নাম আদর্শ গ্রাম। রাজশাহী জেলার গোদাগাড়ী থানার গোগ্রাম ইউনিয়নে অবস্থিত। শুকুরমনি সেই গ্রামের একজন আদিবাসী সাঁওতাল পরিবারের সদস্য । তাঁর স্বামীর নাম বিকাশ । ৩ জন সদস্যবিশিষ্ট কৃষিনির্ভর এ পরিবারটির একমাত্র আয়ের উৎস ছিল দুই বিঘা বর্গা জমি । যেখান থেকে ইরি (চৈতা) মৌসুমে ধান পাওয়া ৩৪ মন । বর্গার নিয়ম অনুযায়ী তাদের অংশ ১৭ মন। গত ইরি মৌসুমে শুকুরমনির আগ্রহ ও ইচ্ছায় একটি এনজিও এর সহযোগিতায় ১০ শতক জমির এক কোনায় অর্ধ শতক জায়গায় গর্ত করে তেলাপিয়া মাছের ছোট আকারের ১৫ টি ব্রুড ছেড়ে পালনের পর পোনা উৎপাদন করে । যেখানে অর্ধ শতক জমিতে সে পেত ৩০ কেজি ধান (যার বাজার মূল্য ৩০০ টাকা) সেখানে মাছ থেকে সে পেয়েছে ১৫০০ টাকা । যা দিয়ে সে একটি ছাগল কিনেছে । ছোট আকারের ১৫ টি ব্রড মাছের বাজার মুল্য ছিল ১৫০ টাকা । অর্থাৎ প্রজননক্ষম মাছটি বিনামূল্যে না পেলেও তার লাভ হত ১৩৫০ টাকা। শুধুমাত্র শুকুরমনির আগ্রহ ও নিজে কিছু করার প্রচেষ্টা থেকে তারা এখন বাড়তি আয় করে একটি ছাগলের মালিক হতে পেরেছে।

কেস স্টাডি-২
রাজশাহী জেলার গোদাগাড়ী থানার গোগ্রাম গ্রামের আর এক আদিবাসী সাঁওতাল পরিবারের সদস্য মিনুরা। তাঁর স্বামীর নাম শ্রী মানিক ও পরিবারের সদস্যসংখ্যা ৫ জন। কৃষিনির্ভর এ পরিবারটির আয়ের উৎস তিন বিঘা বর্গা জমি । এছাড়া বাড়ির পাশে তাদের নিজস্ব একটি ডোবা আছে। ডোবাটি অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে থাকত। দীর্ঘদিন থেকেই নিজের পরিবারের জন্য মিনুরার কিছু করার ইচ্ছা ছিল । মিনুরার আগ্রহ ও ইচ্ছায় একটি এনজিও এর সহযোগিতা ও পরামর্শে ডোবায় কার্পজাতীয় মাছের ২ কেজি ধানী পোনা ছেড়ে দেয়। মিনুরার প্রত্যক্ষ ব্যবস্থাপনায় দেড় মাস পোনা পালন করে আঙ্গুলী পোনা তৈরি করে। দেড় মাস পর এ পোনা বিক্রি করে সে ৫ হাজার টাকা লাভ করে। ২ কেজি ধানী পোনার বাজারমূল্য ছিল ৮০০ টাকা । খাবার বাবদ খরচ হয়েছে ২০০ টাকা। এনজিওর সহযোগিতায় বিনামূল্যে ধানী পোনা ও মাছের খাবার না পেলেও তাঁর লাভ হত ৪০০০ টাকা।

উল্লিখিত নারীরা অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়ার কারণে তাদের সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা বেড়েছে ও অর্থনৈতিকভাবে পরিবারের উপর নির্ভরশীলতা কমেছে। এভাবে দেশের প্রতিটি নারীর ইচ্ছা, আগ্রহ ও কর্মক্ষমতা কে কাজে লাগানো গেলে নারী দেশের বোঝা না হয়ে বরং সম্পদে পরিণত হবে। নারীরা বাড়ির নিকটবর্তী পুকুর (বিশেষ করে মৌসুমী পুকুর), ধানক্ষেত ও বড় পুকুরে খাঁচায় অনায়াসেই মাছ চাষ করতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশের নারীদের মাছ চাষে পিছিয়ে থাকার কিছু অন্যতম কারণ হল শ্রম বিভাজনের বৈষম্য, শিক্ষা, জ্ঞান ও দক্ষতার অভাব এবং পুরুষের অসম ও অত্যুৎসাহী দৃষ্টিভঙ্গী (পারভীন ফেরদৌস, ১৯৯৫)। এ জন্য বিভিন্ন সরকারী ও বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের অংশগ্রহণে প্রয়োজনীয় ঋণ বিতরন ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা যেমন প্রয়োজন তেমনি দেশের নারী সমাজকেও নিজের অধিকার, সামর্থ্য ও প্রাপ্যতা সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। নিজে সচেতন ও আত্মনির্ভরশীল হলে সমাজ ও জাতি তাঁর মর্যাদা অবশ্যই দেবে।

তথ্যসূত্র
পারভীন ফেরদৌস, ১৯৯৫। মৎস্য সম্পদ উন্নয়নে মহিলাদের ভূমিকা, মৎস্য পক্ষ সংকলন-১৯৯৫, মৎস্য অধিদপ্তর, ঢাকা, ৭১-৭৩।


Visited 572 times, 1 visits today | Have any fisheries relevant question?
নারীর আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে মাছচাষ

Visitors' Opinion

সৈয়দা নুসরাত জাহান

গবেষক, ফিশারীজ বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। বিস্তারিত

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.