চিত্র: একুয়ারিয়ামে ছোট আকারের কচ্ছপ।
চিত্র: একুয়ারিয়ামে ছোট আকারের কচ্ছপ।

একুয়ারিয়াম সবারই প্রিয় এবং আমাদের অনেকেরই সাধ জাগে একুয়ারিয়ামে মাছ পোষার। কিন্তু অনেকেই মনে করেন যে একুয়ারিয়াম থাকলে বাড়তি কিছু ঝামেলা পোহাতে হয়। তার মধ্যে নিয়মিত পরিস্কার ও পানি পরিবর্তন করা (প্রতি মাসে বা প্রতি দুই মাসে একবার)। এ কারনে অনেকেই বেশ বিরক্ত। এমনও লক্ষ্য করা গেছে যে অনেকে প্রথম প্রথম শখের বশে একুয়ারিয়াম কিনে মাছ পোষা আরাম্ভ করলেও কিছুদিন পর তা বাদ দিয়ে দিয়েছেন। এছাড়া মাছকে সকাল বিকেল খাবার দেয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার যা অনেকের কাছেই বড় একটি সমস্যা। ‍কথায় আছে ‘শখের দাম লাখ টাকা’ তাই শখ করে একুয়ারিয়ামে মাছ পোষার ক্ষেত্রে কিছুটা ঝামেলা তো সহ্য করতেই হবে! তবে কেউ যদি নিম্নোক্ত বেশ কিছু বিষয় লক্ষ্য রাখেন তাহলে একুয়ারিয়াম ব্যবস্থাপনা অনেকটাই সহজ হয়ে যায়-

একুয়ারিয়ামের আকার:
চেষ্টা করুন একটু বড় আকারের একুয়ারিয়াম কিনতে। এতে একটু বেশী জায়গা প্রয়োজন হলেও আপনার মাছ বেশী দিন বেচে থাকবে। ছোট আকারের একুয়ারিয়ামে পানির গুণাগুণ অল্প সময়ের মধ্যে নষ্ট হয়ে যেতে পারে যেটা বড় আকারের একুয়ারিয়ামে হয় না। অনেকে ছোট গোলাকার কাচের পাত্রে মাছ পুষে থাকেন, তাদের নিশ্চয় হঠাৎ করে মাছ মারা যাবার অভিজ্ঞতা আছে।

ফিল্টার ও এরেটর:
অনেক মাছ আছে যারা অক্সিজেন সরবরাহ ব্যতীত বাঁচে না। চেষ্টা করুন পাওয়ার ফিল্টার ব্যবহার করতে। এটি ফিল্টার ও এরেশন দুটোর কাজ করবে। এই ফিল্টারের সবচেয়ে বড় সুবিধা যেটি সেটি হলো সহজেই পরিস্কার করা যায়, যার কারনে বার বার পানি পরিবর্তন করতে হয় না। যখন দেখবেন ফিল্টারটির এরেশনের গতি কমে গেছে (বুদ বুদ বের হওয়া কমে যাবে বা মাঝে মাঝে থেমে যাবে) তখন ফিল্টারটি বের করে নিয়ে এর মাঝের স্পঞ্জটি পরিস্কার করে পুনরায় একুয়ারিয়ামে বসাতে হবে।

চিত্র: পাওয়ার ফিল্টার।
চিত্র: পাওয়ার ফিল্টার।

ছোট পাথরকুচি, বড় পাথর:
আমাদের যাদের একুয়ারিয়াম আছে তারা সকলেই ছোট ছোট সাদা-কালো বর্ণের পাথরকুচি একুয়ারিয়ামের তলদেশে ব্যবহার করে থাকি। মাছ হতে যে বর্জ্য পদার্থ নিঃসৃত হয় তা কিন্তু এসকল ছোট পাথরের উপর জমা হয়। পরবর্তীতে একুয়ারিয়ামের মাছগুলো তাদের মুখ দিয়ে এসকল বর্জ্য খোঁচাতে থাকে এবং পানি নোংরা করে ফেলে। আমরা যদি শুধুমাত্র ছোট পাথরকুচি ব্যবহার না করে সাথে কিছু অপেক্ষাকৃত বড় পাথরও ব্যবহার করি তবে এ সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব। এজন্য ছোট পাথরকুচির উপর দিয়ে এক বা একাধিক স্তর বড় পাথর বিছিয়ে দিতে হবে। এতে বর্জ্য পদার্থ বড় পাথরের ফাঁকা দিয়ে নিচে ছোট পাথরকুচির উপর জমা হবে কিন্তু বড় পাথর থাকায় মাছ পানি নোংরা করতে পারবে না।

চিত্র: একুয়ারিয়ামে ছোট পাথরকুচির উপর অপেক্ষাকৃত বড় আকারের পাথর।
চিত্র: একুয়ারিয়ামে ছোট পাথরকুচির উপর অপেক্ষাকৃত বড় আকারের পাথর।

শুধু মাছ নয়!
চেষ্টা করুন একুয়ারিয়ামে মাছের পাশাপাশি অন্যান্য জলজ প্রাণীও রাখতে যা আপনার একুয়ারিয়ামকে করে তুলবে বৈচিত্র্যময়। এসকল প্রাণীর মধ্যে কচ্ছপ, চিংড়ি, শামুক ইত্যাদি হতে পারে। তবে কচ্ছপ বা চিংড়ি রাখলে একুয়ারিয়ামের পানির উপরিভাগে (পানির লেভেলে) এমন স্থান তৈরী করুন যাতে সেখানে তারা উঠতে পারে এবং বিশ্রাম নেয়। তবে বড় আকারের কচ্ছপ না রাখাই ভালো কারন তারা অধিক পরিমান বর্জ্য নিষ্কাশন করে ফলে পানি দ্রুত নোংরা হয়।

চিত্র: একুয়ারিয়ামে শামুক (ইনকা স্নেইল)।
চিত্র: একুয়ারিয়ামে শামুক (ইনকা স্নেইল)।

জলজ উদ্ভিদ
আমাদের দেশে জীবন্ত জলজ উদ্ভিদ একুয়ারিয়ামে লাগানোর প্রচলন না থাকলেও বিদেশী এ বিষয়টি ব্যাপক জনপ্রিয়। আমাদের আশেপাশের পুকুর বা ডোবা বা অগভীর নদী (যদি থাকে) প্রায়শই ভাসমান বা ডুবন্ত জলজ আগাছা থাকে। একুয়ারিয়ামে ভাসমান জলজ উদ্ভিদের চেয়ে ডুবন্ত লতানো উদ্ভিদ অধিক আকর্ষনীয়। ভাসমান জলজ উদ্ভিদ (যেমন, টোপাপানা) একুয়ারিয়ামে লাইটের আলো পানিতে প্রবেশে প্রবেশে বাধা প্রদান করে। ডুবন্ত জলজ উদ্ভিদ একুয়ারিয়ামে লাগাতে হলে প্রথমেই সেটিকে শিকড়সহ সংগ্রহ করতে হবে। সংগ্রহের অল্প সময়ের মধ্যেই সেটিকে একুরিয়ামে স্থাপন করতে হবে। স্থাপন করার সময় শিকড়গুলো পানির তলদেশে আটকে দিতে হবে (এজন্য ছোট ছোট প্লাস্টিকের টব বা বাক্সে মাটি নিয়ে তাতে আটকে দিতে হবে অথবা সরাসরি অপেক্ষাকৃত বড় পাথরের সাহায্যে চাপা দিয়ে আটকে রাখতে হবে)।

চিত্র: একুয়ারিয়ামে জীবন্ত জলজ উদ্ভিদ (পুকুর হতে সংগ্রহকৃত উদ্ভিদ)।
চিত্র: একুয়ারিয়ামে জীবন্ত জলজ উদ্ভিদ (পুকুর হতে সংগ্রহকৃত উদ্ভিদ)।

একুয়ারিয়ামের সাইজ অনুযায়ী জলজ উদ্ভিদ নির্বাচন করতে হবে। বড় পাতা বিশিষ্ট উদ্ভিদ অল্প সংখ্যক লাগাতে হবে। তবে ক্ষুদ্র পাতাবিশিষ্ট উদ্ভিদ লাগালে একুয়ারিয়ামে তুলনামূলক বড় আকারের মাছ বিশেষ করে গোল্ডফিশ রাখা যাবে না। কারন এরা উদ্ভিদের পাতা সর্বক্ষণ মুখের সাহায্যে খাওয়ার চেষ্টা করে এবং পাতাগুলিকে কাণ্ড হতে আলাদা করে ফেলে।

দেশী মাছ!
শুধু বিদেশী মাছ দিয়ে একুয়ারিয়াম সাজাবেন কেন? আমাদের দেশী অনেক সুন্দর সুন্দর মাছ আছে যাদের একুয়ারিয়ামে রাখলে সহজেই দর্শকের দৃষ্টি আকর্ষন করতে সক্ষম। বিভিন্ন দেশী মাছ যেমন বৌ বা রাণী, খলিশা, গুতুম, পুটি, টেংরা, বিশতারা বা চিত্রা, কুকুর জিব ইত্যাদি মাছগুলো খুব সহজেই একুয়ারিয়ামে পালন করা যেতে পারে। তবে দেশী মাছের বেলায় প্রথম প্রথম খাবার নিয়ে সমস্যা হতে পারে। প্রথম দুই-তিন দিন এরা একুয়ারিয়াম মাছের জন্য প্রাপ্ত প্যাকেট জাত খাবার না খেলেও পরবর্তীতে তা খাবার হিসেবে গ্রহণ করে।

চিত্র: একুয়ারিয়ামের কাচে লেগে থাকা বাংলাদেশী মাছ ‘পাতা’ বা ‘জিহবা’।
চিত্র: একুয়ারিয়ামের কাচে লেগে থাকা বাংলাদেশী মাছ ‘পাতা’ বা ‘জিহবা’।

স্ক্যাভেঞ্জার ফিশ
একুয়ারিয়ামে কিছু সংখ্যক বর্জ্যভোজী মাছ (স্ক্যাভেঞ্জার) রাখা উচিত। এসকল মাছের মধ্যে সাকার মাউথ, হর্সফেস লোচ, করি ক্যাট, দেশী মাছের মধ্যে গুতুম, জিহবা (সোল) ইত্যাদি অন্যতম। এরা একুয়ারিয়ামের তলদেশ বা কাচের গায়ে লেগে থাকা ময়লা পরিস্কারে ভূমিকা রাখে।
ফাইটার (পুরুষ) একাধিক রাখা যাবে না। উইডো টেট্রা একসাথে ৫ এর থাকলে তা অন্যান্য মাছকে আক্রমন করতে পারে। মাছ ক্রয়ের সময় অবশ্যই জেনে নিন সেটি আপনার অন্যান্য মাছের সাথে একসাথে রাখা যাবে কিনা।

মাছ ধরার নেট
কখনই খালি হাতে বা বাটি-গামলা ব্যবহার করে একুয়ারিয়ামের মাছ ধরা উচিত নয়। এতে মাছ আঘাত প্রাপ্ত হতে পারে। একুয়ারিয়ামের মাছ ধরার জন্য একধরনের হাতলসহ নেট পাওয়া যায় যার মাধ্যমে মাছ ধরতে হবে।

চিত্র: নেটের সাহায্যে একুয়ারিয়াম হতে মাছ ধরা।
চিত্র: নেটের সাহায্যে একুয়ারিয়াম হতে মাছ ধরা।

খাবার
একুয়ারিয়ামে মাছের জন্য খাবার প্যাকেটজাত অবস্থায় বাজারে (একুয়ারিয়ামের দোকানে) পাওয়া যায়। একুয়ারিয়ামের মাছের আকার বিবেচনা করে খাবারের আকার (পিলেট সাইজ) নির্ধারণ করতে হবে। দৈনিক কতবার ও কতটুকু খাবার দিতে হবে তা নিয়ে অনেকেই বিভ্রান্ত হন। খাবার দিনে দু’বার দিলেই যথেষ্ট (সকাল ও বিকেলে/রাত্রে)। কতটুকু দিতে হবে তা নির্ভর করে কি পরিমান মাছ আছে তার উপর।

বাজারে প্রাপ্ত দানাদার প্যাকেটজাত খাবার ছাড়াও জীবন্ত খাবর (টিউবিফেক্স) ও হিমায়িত (ফ্রোজেন) টিউবিফেক্স পাওয়া যায়। চেষ্টা করুন একাধিক ধরনের খাবার প্রয়োগ করার। এতে মাছের স্বাস্থ্য ও খাবারে আগ্রহ দুটিই বৃদ্ধি পাবে। একুয়ারিয়ামে যদি কচ্ছপ থাকে তবে তাকে দানাদার খাবারের পাশাপাশি শশা (কুচি বা ছোট টুকরা করে), পুঁই শাক, এ্যাজোলা (ভাসমান জলজ উদ্ভিদ, পুকুর বা ধানক্ষেতে পাওয়া যায়) ইত্যাদি দেয়া যেতে পারে। যেসকল মাছ একুয়ারিয়ামের তলদেশে অবস্থান করে তাদের জন্য এমন খাবার দিতে হবে যাতে তা তলদেশে পৌছায়। একুয়ারিয়ামে খাবার হিসেবে সুজি অত্যন্ত উপযোগী। এটি প্রয়োগ করলে কিছু পরিমান সুজি তলদেশে ছড়িয়ে যায় এবং তা তলদেশের মাছও খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করতে পারে। খাবার এমন পরিমানে দিবেন যাতে তা দেয়ার ১৫ মিনিটের মধ্যে মাছ তা খেয়ে শেষ করে ফেলে। যদি ১৫ মিনিট পরও খাবার বেচে থাকে তবে পরবর্তীতে খাবারের পরিমাণ কমিয়ে দিন।

চিত্র: একুয়ারিয়াম মাছের জন্য দোকানে প্রাপ্ত প্যাকেটজাত খাদ্য।
চিত্র: একুয়ারিয়াম মাছের জন্য দোকানে প্রাপ্ত প্যাকেটজাত খাদ্য।
চিত্র: একুয়ারিয়ামের মাছের কাবার সুজি ও ফ্রোজেন টিউবিফেক্স (চারকোনা ব্লক)।
চিত্র: একুয়ারিয়ামের মাছের কাবার সুজি ও ফ্রোজেন টিউবিফেক্স (চারকোনা ব্লক)।

শীতের দিনে হিটার ব্যবহার
শীতের সময় একুয়ারিয়ামের পানি অত্যাধিক ঠাণ্ডা হয়ে গেলে মাছ মারা যেতে পারে। যদি পানির তাপমাত্রা ১৫ ডিগ্রির নিচে চলে যায় তাহলে মাছ মারা যাবার সম্ভাবনা বেশী থাকে। এসময় একুয়ারিয়ামে হিটার ব্যবহার করা উচিত। একুয়ারিয়ামের দোকানে হিটার পাওয়া যায়। চেষ্টা করুন অটো হিটার কেনার। অটো হিটারে আপনাকে বিদ্যুতিক সংযোগ কতক্ষণ দিতে হবে (কতক্ষণ হিটার চালু রাখতে হবে) তা নিয়ে চিন্তা করতে হবে না।

অন্যান্য
একুয়ারিয়ামের পানিতে আয়রন বেশী থাকলে কাচের গায়ে লাল বা খয়েরী বর্ণের দাগ পড়ে। এজন্য ব্লেড দিয়ে চেঁছে (পানির মধ্যেই) ফেলতে হবে। কোন ভাবেই সাবান বা ডিটারজেন্ট ব্যবহার করা যাবে না। পানিতে ঘোলাটে হলে মিথিলিন ব্লু  (একুয়ারিয়ামের দোকানে ‘ব্লু’ নামে পরিচিত) প্রতি লিটার পানির জন্য ২-৩ ফোটা ব্যবহার করুন।

কিছু বেসিক টিপস:

  • সাবান বা ডিটারজেন্ট ব্যবহার না করা।
  • সম্পূর্ণ বা অর্ধেক পানি একসাথে পরিবর্তন করবেন না।
  • মাছ হাত দিয়ে ধরার চেষ্টা করবেন না।
  • ফিলামেন্ট লাইট ব্যবহার করবেন না।
  • খাবার হিসেবে সুজি ব্যবহার করলে পাওয়ার ফিল্টার কিছুক্ষণের জন্য বন্ধ রাখুন।

 


Visited 12,113 times, 1 visits today | Have any fisheries relevant question?
একুয়ারিয়ামের সহজ ব্যবস্থাপনা

Visitors' Opinion

শামস মুহাম্মদ গালিব

প্রভাষক, ফিশারীজ বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী, বাংলাদেশ। প্রাক্তন শিক্ষার্থী, ফিশারীজ বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী-৬২০৫, বাংলাদেশ। বিস্তারিত ইমেল: thegalib@gmail.com

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.