বর্তমানে বিল, হ্রদ, হাওড়, প্লাবনভূমি ও নদীর মত উন্মুক্ত জলাশয়ে দেশী মাছের প্রজাতির সংখ্যা ক্রমশ কমতে থাকলেও বিদেশী প্রজাতির সংখ্যা বিপদজনক ভাবে দ্রুত বাড়ছে যা দেশের মৎস্য বৈচিত্র্যের জন্য মোটেও কোন আশাপ্রদ খবর নয়। সময় নষ্ট না করে এখনই প্রয়োজন বাংলাদেশের মৎস্য বৈচিত্র্য হ্রাসের প্রকৃত কারণ খুঁজে বের করা এবং ইতোমধ্যে বাংলাদেশের মৎস্য বৈচিত্র্য হ্রাসের প্রেক্ষিতে যেসব কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে তা মাঠ পর্যায়ে যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা এবং আরও যেসব কার্যক্রম গ্রহণ করা প্রয়োজন তা খুঁজে বেড় করে দ্রুত বাস্তবায়ন করা। এ লেখায় বাংলাদেশের মৎস্য বৈচিত্র্য হ্রাসের কারণসমূহ খুঁজে বের করার প্রচেষ্টা থাকবে। মাৎস্যবিজ্ঞানী, বিশেষজ্ঞ, গবেষকসহ সাধারণ মানুষ এবিষয়ে কী ভাবছেন তাও তুলে ধরা হবে এ লেখায়।

দেশীয় প্রজাতির মাছ হ্রাসের প্রধান কারণ হিসেবে মাছের বসবাসস্থল ও প্রজননক্ষেত্র ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া এবং উভয় জলাশয়ের মাঝে মাছের চলাচলের প্রতিবন্ধকতা, ত্রুটিপূর্ণ জলাশয় ব্যবস্থাপনা ও মাত্রারিক্ত মৎস্য আহরণ, ক্ষতিকর বিদেশী মাছের আগ্রাসন ও মাছচাষের বিবেচনাহীন প্রসারকে বড়দাগে চিহৃত করা যায়। বিষয়গুলি নিচে বিস্তৃতভাবে আলোচিত হল।

১. মাছের বসবাসস্থল ও প্রজননক্ষেত্র ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া এবং উভয় জলাশয়ের মাঝে মাছের চলাচলের প্রতিবন্ধকতা:
দেশীয় মাছের প্রাকৃতিক বসবাসস্থল ও প্রজনন ক্ষেত্র আজ হারিয়ে যেতে বসেছে। একই ভাবে উভয় জলাশয়ের মাঝে মাছের চলাচলের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হওয়ায় মৎস্য প্রজাতি হ্রাসকে তরান্বিত করেছে। সবগুলো বিষয় আবার একটি অপরটি সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত।

১.১. অপরিকল্পিতভাবে রাস্তাঘাট ও বাঁধ নির্মাণ:
বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও নদী শাসনের নামে দেশে দশকের পর দশক ধরে যত্রতত্র অপরিকল্পিতভাবে বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। কিন্তু এর মাধ্যমে খুব কম ক্ষেত্রেই নদী শাসন ও বন্যা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়েছে। জীববৈচিত্র্যের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষকে বিবেচনায় না এনে এখনও গঠন প্রক্রিয়া চলমান এমন একটি বদ্বীপে পর্যাপ্ত সেতুর ব্যবস্থা না রেখে রাস্তাঘাট নির্মাণ ও পানি নেমে যাবার পরিকল্পিত ব্যবস্থাপনা না রেখে বাঁধ নির্মাণ এই বিপর্যয়ের অন্যতম কারণ। এছাড়াও এই বাঁধ প্রযুক্তি যেসব দেশ থেকে আমদানি করা হয়েছে সেসব দেশের সবচেয়ে বড় নদীটিও আমাদের দেশের সবচেয়ে ছোট নদীটির চেয়েও ছোট। ফলে এই প্রযুক্তি যে এই বদ্বীপে বুমেরাং হয়ে ফিরে আসবে তাই স্বাভাবিক। এছাড়াও আমাদের স্মরণে রাখা উচিত ছিল প্রকৃতিকে ততটাই পরিবর্তন করা যায় যতটা সে নিজে থেকে মেনে নেয়। এসকল বিষয়াবলী বিবেচনায় না এনে অপরিকল্পিতভাবে বাঁধ নির্মাণের ফলে আজও বন্যা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়নি। যা হয়েছে তা হচ্ছে বন্যার সময়কাল, স্থান ও ধরণে ক্ষতিকর পরিবর্তন যা আমাদের দেশের জীববৈচিত্র্যের জন্য মোটেও কোন শুখকর খবর নয়।

এভাবে একদিকে যেমন মাছের প্রধান প্রজননক্ষেত্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তেমনই উজানের পানি ভাটিতে নেমে যাবার পরিমাণ, পথ ও সময়কাল পরিবর্তিত হবার প্রেক্ষিতে জলাভূমি একদিকে যেমন সঙ্কুচিত হচ্ছে অন্যদিকে নাব্যতাও কমছে দ্রুততম হারে । যেটুকু বা আছে তাতেও আগের-মত তিন-চার মাস পানি থাকে না। রাজশাহী, বগুড়া, পাবনা জেলার অধিকাংশ এলাকা জুড়ে বিরাজমান চলন বিল মূলত ব্রহ্মপুত্র ও পদ্মা নদীর সঙ্গমস্থলের পশ্চিম-উত্তর অংশজুড়ে বিস্তৃত চিল। বর্তমানে ভর বর্ষায় এই বিলের আয়তন সর্বোচ্চ ৮০০ বর্গমাইল [তথ্যসূত্র-০১]। প্রথমে নাটোর-সান্তাহার ও ঈশ্বরদী-সিরাজগঞ্জ রেলপথ পরবর্তীতে নাটোর-বগুড়া, নাটোর-হাটিকুমরুল (সিরাজগঞ্জ) মহাসড়কসহ অসংখ্য সড়ক জালের মত ছড়িয়ে ছিটিয়ে নির্মাণ করা হয়েছে পর্যাপ্ত সেতুর ব্যবস্থা না রেখেই। যা একদিকে যেমন বন্যার পানিকে ভাটির দিকে নামতে বাঁধা প্রদান করেছে, বন্যার গতি, প্রকৃতি ও স্থানের ক্ষতিকর পরিবর্তন এনেছে অন্যদিকে এ বিলকে খণ্ডিত করে, নাব্যতা নষ্ট করে, জলজ পরিবেশের বারটা বাজিয়ে ধ্বংসের প্রান্তে নিয়ে গেছে। চলন বিলের মতো দেশের অসংখ্য উন্মুক্ত জলাশয়ের প্রাকৃতিক পরিবেশ আজ একইভাবে বিপন্ন। এর প্রধান কাড়নই হচ্ছে অপরিকল্পিতভাবে বাঁধ ও পর্যাপ্ত সেতু না রেখে রাস্তাঘাট নির্মাণের মাধ্যমে মাছের প্রাকৃতিক আবাসভূমি ও প্রজননক্ষেত্রকে খণ্ডিত ও সঙ্কুচিত করে ফেলার সাথে সাথে এর ভৌত ও জৈবিক বৈশিষ্ট্যের ক্ষতিকর পরিবর্তন করা। এর পাশাপাশি মাছের প্রাকৃতিক আবাসভূমি ও প্রজননক্ষেত্রের মধ্যবর্তী স্থানে পানি ও মাছ চলাচলের পর্যাপ্ত অবকাঠামো না থাকায় একদিকে যেমন মাছ চলাচলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়েছে অন্যদিকে তেমনি যাও বা একটু আছে তাও উভয় স্থানের মধ্যবর্তী সংযোগ নদী, খাল বা বিলের মত জলাভূমির নাব্যতা অস্বাভাবিকভাবে কমে যাওয়ায় মাছের চলাচল বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ফলে সময়মত প্রজননক্ষম মাছ সময়মত তার প্রজননক্ষেত্রে পৌছাতে পারছে না। এছাড়াও এই সংযোগস্থল ক্রমশ সরু হয়ে আসায় লোভী মৎস্য শিকারিরা এই সংযোগস্থল জুড়ে ক্ষতিকর জাল ফেলে বেশিরভাগ মাছ ধরে নেয়ায় মৎস্য চলাচলের শেষ সুযোগটুকুও কেড়ে নিচ্ছে।

প্রকৃতির কাছে কোন রকম দায়বদ্ধতা বিবেচনায় না নিয়ে নির্মিত এইসব বাঁধের কারণে প্লাবনভূমির মত উন্মুক্ত জলাশয় যা দেশীয় ছোটমাছের প্রধান প্রজননক্ষেত্র তার আয়তন ও পানি ধারণের সময়কাল একেবারে কমে এসেছে। এতটাই কমে এসেছে যে শত বাঁধা প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে যেসব মা-বাবা মাছ বিল বা প্লাবনভূমিতে নতুন প্রজন্মের আগমে অংশগ্রহণ করছে তারা যেমন হুমকির মুখে পড়ছে তেমনই নতুন প্রজন্ম বিলে পানি দ্রুত কমে যাবার আগেই বাঁধা পেরিয়ে নদীর মতো জলাশয়ে যেতে না পেরে কম বয়সে ধরা পড়ছে মাছ শিকারির হাতে। ফল বছরের পর বছর ধরে ওভার ফিশিং এর ঘটনা ঘটে চলেছে যা মৎস্যবৈচিত্র্যের জন্য হুমকিস্বরূপ।

শুধু দেশের ভেতরেই নয় দেশের বাইরে উজানে নানা ধরনের রাস্তাঘাট ও বাঁধ নির্মাণের কারণে পানির গতির তীব্রতা, দিক ও সময়কালে পরিবর্তন এসেছে। ফলে পাহাড়ি ঢলে হাওরের তলদেশ পলি জমে ভরাট হয়ে যাচ্ছে সহজেই, একই ঘটনা ঘটছে নদীর ক্ষেত্রেও। ফারাক্কা বাঁধের কারণে পদ্মার পানির গতি কমে যাওয়ায় পানির পলিকণা সমুদ্রে পৌছার আগেই নদীর তলদেশে জমা হয়ে নাব্যতা কমিয়ে দিচ্ছি বছরের পর বছর ধরে। আমাদের দেশের উজানে এরকম বাঁধের সংখ্যা অসংখ্য। নদী, খাল, বিল, হাওরের মত উন্মুক্ত জলাশয় ভরাট হয়ে মাছের বিচরণক্ষেত্র যেমন কমে যাচ্ছে তেমনই প্রজননের জন্য নির্দিষ্ট জায়গারও অভাব দেখা দিয়েছে।

১.২. জলাশয়ের জীববৈচিত্র্য আর ধান চাষের ধাঁচে পরিবর্তন:
এদেশের বহু-প্রকৃতি একদা ছিল বর্ষা, বন্যা বা প্লাবনবান্ধব। বর্ষায় যখন পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত হতো তখন বৃষ্টির পানিসহ পাহাড়ি ঢল ছোট-বড় নদী দিয়ে প্রবাহিত হয়ে সাগরে যেয়ে পড়তো। এসময় নদীর দুকূল ছাপিয়া তা হাওর, বিল আর প্লাবনভূমির মতো জলাশয়গুলোকে ভাসিয়ে নিয়ে যেতো। এই পানি বৃদ্ধির হার ছিল ধীর গতির। এই গতির সাথে পাল্লা দিয়ে অভিযোজিত হয়ে হাজার বছর ধরে টিকে ছিল জলাভূমির উদ্ভিদ, চাষকৃত ধান আর দেশীয় ছোট-বড় মাছ। মানুষও সবদিক থেকে বর্ষার জন্য প্রস্তুত থাকতো। বলা যায় এদেশের মানুষ তার বসবাসের চারপাশের জলজ পরিবেশের সাথে নিজেকে অভিযোজিত করে টিকে ছিল হাজার বছর ধরে।

গত শতাব্দীর চল্লিশের দশক থেকে পর্যাপ্ত সেতুর ব্যবস্থা না রেখে রাস্তাঘাট নির্মাণ আর আশির দশক থেকে পানি নেমে যাবার পরিকল্পিত ব্যবস্থাপনা না রেখে বাঁধ নির্মাণ এই প্রাকৃতিক জলাশয় ও এর উদ্ভিদ ও প্রাণীর জীবন কাঠামোকে ক্ষতিগ্রস্ত করে এর ধরণ পাল্টে ফেলল যা পূর্বের সম্পূর্ণ বিপরীত। বর্তমানে কোথাও না কোথাও বাঁধ ভেঙ্গে প্রতি বছরই বিল, হাওর ও প্লাবনভূমিতে পানি প্রবেশ করছে তীব্র গতিতে। এই গতির সাথে এদেশের জলজ উদ্ভিদ বা হাল আমলের হাইব্রিড ধান অভিযোজিত হতে পারে নি। ফলে আমরা হারিয়েছি বর্ষার দেশীয় ধান আর হারাতে চলেছি দেশীয় ছোট মাছ কারণ প্লাবনভূমির জলজ উদ্ভিদ আর চাষকৃত ধানক্ষেতই হচ্ছে আমাদের দেশীয় ছোট মাছের প্রধান প্রজননক্ষেত্র।

সবকিছু মিলিয়ে প্লাবনের স্থান, কাল ও সময় পরিবর্তিত হয়েছে মারাত্মকভাবে যার সাথে এদেশের জলজ উদ্ভিদ ও প্রাণীরা অভিযোজিত হতে পারেনি। তীব্র গতিতে আসা ঝুঁকিপূর্ণ অনির্ধারিত প্লাবন অল্পসময়ের ব্যবধানে দ্রুতগতিতে নেমে যাবার ফলে স্থলজ ফসলের চাষাবাদের সাথে সংশ্লিষ্ট কৃষক একদিকে যেমন ফসল হারিয়ে সর্বস্বান্ত হচ্ছে অন্যদিকে বর্ষার সময়কাল ও ধরনের পরিবর্তন হওয়ায় দেশী বর্ষার ধানের আবাদ নেই বললেই চলে। ফলে এসব জলাশয়ের দীর্ঘদিনের জলজ পরিবেশে বড় ধরণের পরিবর্তন দেখা দিয়েছে যা দেশীয় ছোট মাছের প্রজননের প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এমনতর স্বল্পমেয়াদী বর্ষায় কোন ধানের চাষ করতে না পেরে চাষিদের কাছে একসময়ের আশীর্বাদের বর্ষা বর্তমানে অভিশাপ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। একারণে চাষিরাও চায় দ্রুত বর্ষার পানি নেমে যাক। এর আর একটি দিক হচ্ছে বিল বা প্লাবনভূমির মত উন্মুক্ত জলাশয়ে যতদিন পানি থাকে ততদিন তা কমন প্রোপার্টি (সাধারণ সম্পত্তি) হিসেবে ব্যবহৃত হয় অর্থাৎ তখন ভূমির মালিক বা ভূমিহীন, ধনী বা গরিব সমাজের সর্বস্তরের মানুষের প্রবেশাধিকার উন্মুক্ত হয়ে যায়। কিন্তু পানি নেমে যাবার সাথে সাথে ভূমির সুনির্দিষ্ট মালিকা প্রতিষ্ঠিত হয় যা প্রতিটি মালিকের একান্ত কাম্য। শুধু তাই নয় চাষিদের বোঝানো হয়েছে উচ্চ ফলনশীল ধান তাদের কেমন করে অর্থনৈতিকভাবে চাঙ্গা করবে আর দেশের মানুষকে বোঝানো হয়েছে উচ্চ ফলনশীল ধানের মাধ্যমে দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। যদিও ঢালাওভাবে সারাদেশে সারা বছর একই ধরণের উচ্চ ফলনশীল ধান আবাদের সিদ্ধান্ত যৌক্তিক নয়। কারণ উচ্চ ফলনশীল ধানের আবাদ নিশ্চিত করতে তৈরি করা বাঁধ বন্যা ঠেকাতে তো পারেনি বরং দীর্ঘ দিনের প্রাকৃতিক পরিবেশ এবং এর জীববৈচিত্র্য ও চাষ ব্যবস্থাপনাকে তছনছ করে দিয়ে দেশীয় ছোট মাছের প্রাকৃতিক প্রজননক্ষেত্র ধ্বংস করে চলেছে দিনের পর দিন ধরে যা মৎস্য বৈচিত্র্য হ্রাসের অন্যতম কারণ হিসেবে আজ চিহৃত হচ্ছে। আজ যখন পত্রিকায় বন্যায় টিকে থাকতে সক্ষম ধানের জাত উদ্ভাবনের খবর প্রকাশিত হয় তখন তাদের জন্য করুণা হয়। একটি মিথ্যা ঢাকার জন্য যেমন অসংখ্য মিথ্যার জন্ম হয় তেমনই বন্যা প্রবণ এলাকায় উচ্চ ফলনশীল ধানের আবাদের নিশ্চয়তার জন্য প্রথমে নির্বিচারে বাঁধ নির্মাণ করে পরিবেশের বারটা বাজিয়ে বন্যার গতি প্রকৃতিকে ক্ষতিকরভাবে পরিবর্তিত করে প্রথমে দেশীয় বর্ষার জাতের ধানকে বিলীন করা হয়েছে। অতঃপর যখন কোনভাবেই বন্যা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয় নি তখন পরিবর্তিত বন্যায় টিকে থাকতে সক্ষম ধানের জাত উদ্ভাবনের খবর আসছে। অথচ উচ্চ ফলনশীল ধান থেকে বন্যা সহনশীল জাত উদ্ভাবনে দৃষ্টি না দিয়ে বরং আমাদের বন্যায় টিকে থাকতে সক্ষম দেশীয় ধান থেকে উচ্চ ফলনশীল জাত উদ্ভাবনে গবেষণা হওয়া ছিল বেশী জরুরী। সবকিছু মিলিয়ে তাই দেখা যাচ্ছে যে জলাশয়ের জীববৈচিত্র্য আর ধান চাষের ধাঁচে পরিবর্তন আসায় তা আমাদের মৎস্য সম্পদের জন্য অপূরণীয় ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

১.৩. জলাশয় দখল ও ভরাট:
অতিদ্রুত বৃদ্ধিপ্রাপ্ত দেশের বিশাল জনসংখ্যার চাপের কারণে জলাভূমি ভরাট করে একদিকে যেমন বসত ভিটা গড়ে তোলার প্রক্রিয়া চলমান অন্যদিকে ভূমিদস্যুদের লোভী দখলবাজ চরিত্র বাধাহীন ভাবে বিকশিত হওয়ায় বিল ও নদীর মতো উন্মুক্ত জলাশয়ের আয়তন কমেছে ক্রমশ। দেশে জলাভূমি হিসেবে স্বীকৃত স্থান ভরাট করা আইনত নিষিদ্ধ হলেও প্রভাবশালীদের কাছে আইনের জাল ছিঁড়ে বেড় হয়ে আসা খুবই অস্বাভাবিক কোন ঘটনা নয়। ফলে ভূমিদস্যুরা ফুলে ফেঁপে উঠলেও মাছের আবাসস্থল ও প্রজননক্ষেত্র এবং উভয় জলাশয়ের মাঝে মাছের চলাচলের সংযোগ খাল বা নদী দখল হয়ে ভরাট হয়ে যাচ্ছে দ্রুতই।

১.৪. জলাশয়ের পানি দূষণ:
বোরো ফসলে মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহারসহ নানা ধরণের কৃষি বর্জ্যে আজ প্লাবনভূমি, বিল হাওরের পানির রাসায়নিক গুনাগুণ এমনভাবে পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে যা মাছের প্রজননের প্রতিকূলতার জন্য যথেষ্ট। এর সাথে যোগ হয়েছে নদীতীরবর্তী কল-কাখানার বর্জ্যের দূষণ যা নদীকে দূষিত করে মাছকে নদী ছাড়া করেছে অনেক আগে আর বর্ষায় নদীর এই দূষিত পানি প্লাবিত হয়ে বিলে বা হাওরে প্রবেশ করায় সেখানকার পানিও দূষিত হয়ে পড়ছে। ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও এর আশে পাশের কোন নদীই আজ আর মাছের স্বাভাবিক জীবনধারণের উপযোগী নয়। ধীরে ধীরে নদীগুলো মাছ শূন্য হয়ে পড়ছে।

সুন্দরবনের নিকটে প্রস্তাবিত কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্যের উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলবে বলে বিশেষজ্ঞরা মতামত ব্যক্ত করেছেন [তথ্যসূত্র-০২]।

এছাড়াও ভারতের মেঘালয়ের কলকারখানার বর্জ্যের দূষণ দেশের হাওর এলাকার পানিকে দূষিত করছে [তথ্যসূত্র-০৩]।

জাহাজ-ভাঙ্গ কার্যক্রম চলার ফলে সীতাকুণ্ডের সমুদ্র উপকূলে মৎস্য আহরণ ৮০ শতাংশের মতো কমেছে। শ্রাবণ-ভাদ্র মাসে পাওয়া যেত প্রচুর রুপালি ইলিশ, যা দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে। এই অঞ্চলগুলো একসময় বিভিন্ন মাছের প্রজননক্ষেত্র ছিল। গভীরতার কারণে এখানে একসময় মাছেরা ডিম পাড়তে আসত। এখন তা আর নেই। সমুদ্রের পানির ওপর যে তেল ও বর্জ্য জমা হয়ে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে [তথ্যসূত্র-০৪]।

২. ত্রুটিপূর্ণ জলাশয় ব্যবস্থাপনা ও মাত্রারিক্ত মৎস্য আহরণ:

২.১. ত্রুটিপূর্ণ জলাশয় ব্যবস্থাপনা:
সরকার উন্মুক্ত জলাশয়ের মত গুরুত্বপূর্ণ একটি খাত থেকে অর্থ সংগ্রহের লোভ সংবরণ করতে পারে নি। এই অর্থ সংগ্রহের জন্য এধরণের গুরুত্বপূর্ণ জলাশয় তুলে দেয়া হয়েছে অনেক অবিবেচক ইজারাদারদের হাতে। এর সাথে অর্থনৈতিক দিক জড়িত থাকায় লাভের বিষয়টি সবার সামনে চলে এসেছে। ফলে এসব জলাশয়ে সর্ব সাধারণেরা প্রবেশাধিকার হারিয়ে একদিকে যেমন সামাজিক সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে তেমনই অধিক লাভের আশায় ইজারাদার কর্তৃক নিয়মনীতি না মেনে অবৈধভাবে মাত্রারিক্ত মাছ আহরণ করা হচ্ছে বছরের পর বছর ধরে।

২.২. যত্রতত্র মাছ শিকার ও মাছ শিকারের ক্ষতিকর পদ্ধতি প্রয়োগ:
জনসংখ্যার আধিক্যের পরিপ্রেক্ষিতে মৎস্য চাহিদার বৃদ্ধি আর অধিক লোভের কারণে বিচার-বিবেচনাহীনভাবে সারা দেশে সারা বছর যখন যেখানে যতটুকু সুযোগ রয়েছে সেখানেই মাছ শিকার চলছে। বর্তমানে প্রজনন মৌসুমে ডিমওয়ালা মা মাছ ধরা বা প্রজনন পরবর্তী সময়ে শিশু মাছ (যেমন- জাটকা) ধরার উপর নিষেধাজ্ঞা থাকলেও তা কার্যকর করা সম্ভব হচ্ছে না।

অন্যদিকে মাছ শিকারে ক্ষতিকর পদ্ধতি ব্যবহৃত হচ্ছে হরহামেশাই। সুক্ষ ফাঁসের কারেন্ট জালের ব্যবহার করে নির্বিচারে মাছ ধরা যেমন চলছে তেমনই চলছে বিষ প্রয়োগে মাছ শিকারের ঘটনা। নদীতে আড়াআড়ি জালের বাঁধ নিয়ে মাছ ধরা যখন সাধারণ পদ্ধতিতে পরিণত হয় তখন তা নদীর মাছের জন্য হুমকি হয়ে দেখা দেয়।

কাঠা ফিশিং নামে এক ধরণের মৎস্য শিকার পদ্ধতি উত্তরাঞ্চলের ছোট-বড় সব নদীতে সচারাচর দেখা যায় যা মৎস্যবৈচিত্র্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর বলে বিবেচিত [তথ্যসূত্র-০৫]। অন্যদিকে মৃত প্রাণী ব্যবহার করে মাছ শিকারের ঘটনা পদ্মা নদীতে (রাজশাহী) দেখা যায় যা মৎস্য জীববৈচিত্র্যের জন্য হুমকি স্বরূপ [তথ্যসূত্র-০৬]।

চলন বিল এলাকায় পানি নেমে যাবার পর শুষ্ক ভূমির নীচে কোকুন বা গর্ত তৈরি করে আশ্রয় নেয়া মাছও (যেমন- গুঁচি, বাইম ইত্যাদি) রেহায় পায় না এক শ্রেণীর মৎস্য শিকারির হাত থেকে। এদেরকে মৎস্য শিকারি না বলে মৎস্য দস্যু বলাই শ্রেয়।

অনেক সামুদ্রিক ও মোহনা জলের মাছ সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ পরিবেশের জলাশয়গুলো ব্যবহার করে নিজেদের প্রজনন ক্ষেত্র হিসেবে। সিডর আর আইলার মত দুর্যোগ পরিবেশকে তছনছ করে দিলেও সময়ের ব্যবধানে পূর্বের অবস্থা ফিরে পায় কিন্তু ইচ্ছেমত বিষ ঢেলে দিয়ে চিংড়ি আহরণের ঘটনা বাড়তে থাকায় বনের জলাশয়গুলোর পরিবেশও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে মারাত্মকভাবে [তথ্যসূত্র-০৭]।

এছাড়াও প্রকৃতি থেকে মাত্রাতিরিক্ত চিংড়ি পোনা আহরণের সময় অন্যান্য প্রজাতির মৎস্য পোনা ধ্বংস হওয়ায় দেশের দক্ষিণাঞ্চলের মৎস্য বৈচিত্র্যের জন্য তা হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের (পাইকগাছা নোনা পানি গবেষণা কেন্দ্র) তথ্য মতে, খুলনার পাইকগাছা ও তৎসংলগ্ন এলাকায় একটি বাগদা চিংড়ির পোনা আহরণে ১১৯টি চিংড়ি প্রজাতির পোনা, ৩১২ প্রজাতির প্রাকৃতিক খাবার (প্ল্যাঙ্কটন) ও ৩১টি সাদা মাছ প্রজাতির পোনা ধ্বংস হয়ে থাকে। উপকূলের অন্যান্য এলাকায় একটি পোনা ধরতে গিয়ে ৪৬ টি চিংড়ি প্রজাতি, ৩৫টি জুপ্লাঙ্কটন প্রজাতি ও ১১টি সাদা মাছ প্রজাতির পোনা ধ্বংস হচ্ছে [তথ্যসূত্র-০৮]। কিন্তু নদীর চিংড়ির পোনার চাহিদা থাকায় নদী থেকে ক্ষতিকরভাবে পোনা আহরণ বন্ধ করা সম্ভব হয় নি [তথ্যসূত্র-০৯]।

২.৩. মৎস্য আইন না মানা, সচেতনতার অভাব ও দুর্বল স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা:
জেলে ও মৎস্য শিকারের সাথে জড়িত অনেকের মাঝেই মৎস্য আইন মেনে না চলার প্রবণতা রয়েছে। অনেকের মাঝেই আইন মেনে চলার বিষয়টির গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতনতার অভাব দেখতে পাওয়া যায়। আবার অনেকেই ক্ষতিকর জাল ও পদ্ধতি ব্যবহার করে মাছ ধরার ক্ষতিকর দিক ভাবতে ইচ্ছুক নন তারা তাৎক্ষণিক লাভ পেতে চান। দারিদ্রটা ও লোভের বশীভূত হয়েও অনেকেই আইন ও সচেতনতাকে পাশ কাটিয়ে চলতে চান। এর সাথে রয়েছে দুর্বল স্থানীয় প্রশাসন ব্যবস্থার পাশাপাশি দুর্নীতিকেও দায়ী করা যায়।

৩. ক্ষতিকর বিদেশী মাছের আগ্রাসন:
দেশের মৎস্য উৎপাদন বাড়াতে প্রায় চার দশক ধরে দেশে নানা প্রজাতির বিদেশী মাছের প্রবেশ ঘটেছে। এরও অনেক আগে থেকে এ্যাকুয়ারিয়ামের বাহারি মাছ হিসেবে বিভিন্ন প্রজাতির বাহারি মাছের আগমন ঘটে এই দেশে। চাষের জন্য যেসব মাছ এদেশে আসে তার মধ্যে সিলভার কার্প, গ্রাস কার্প, বিগহেড কার্প, মিরর কার্প, কমন কার্প, লেদার কার্প, তেলাপিয়া, নাইলোটিকা, গিফট তেলাপিয়া, আফ্রিকান মাগুর, থাই পাঙ্গাস, থাই পুঁটি, থাই কই এর কৃত্রিম প্রজননের সাফল্যের পর সহজেই চাষির পুকুরে চলে আসে। অন্যদিকে এ্যাকুয়ারিয়ামের মাছ হিসেবে আমাদের দেশে প্রবেশের পর পিরানহা অতি উৎসাহী হ্যাচারি টেকনিশিয়ানের হাতে সফল প্রজননের পর চাষের পুকুরে চলে আসে। এপর্যন্ত সুখের খবর হলেও এই মাছ গুলোর মধ্যে অনেক মাছ বর্তমানে বিজ্ঞানীদের দৃষ্টিতে ক্ষতিকর বলে বিবেচিত হচ্ছে। যার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে আফ্রিকান মাগুর, পিরানহা, তেলাপিয়া, কমন কার্প, থাই পুঁটি অন্যতম। এর মধ্যে বোমা ফাটানোর মত একটি খবরে সবাই নড়ে চড়ে বসেন যখন দেখা যায় বিভিন্ন নদ-নদী, চলন বিল আর কাপ্তাই হ্রদের মতো উন্মুক্ত জলাশয়ে এই মাছ গুলোর অবাধ বিচরণ দেখতে পাওয়া যায়। বন্যা প্রবণ এই দেশে এটাই যে স্বাভাবিক একটি বিষয় তা মাছগুলো যখন দেশে আনা হয় তখন বিবেচনায় আনা হয় নি বা আনা হলেও কেউ গুরুত্ব দেয় নি। অন্যান্য বিদেশী মাছের কথা বাদ দিলেও দেশে পিরানহা বা আফ্রিকান মাগুর নিষিদ্ধ হলেও দেদারছে??? চলছে এর চাষ ও বিপণন। এমনকি দেশের বাইরে পাচার খবরও পত্রিকায় আসছে। সাম্প্রতিক সময়ে সংবাদপত্রে প্রকাশিত বিভিন্ন প্রতিবেদন থেকে দেখা যায় দেশের অর্ধেক সংখ্যক জেলার (ঢাকা, নরসিংদী, ফরিদপুর, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, রাজশাহী, নওগাঁ, জয়পুরহাট, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, নাটোর, রংপুর, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, নীলফামারী, গাইবান্ধা, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়, চট্টগ্রাম, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি, কুমিল্লা, ফেনী, সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, চুয়াডাঙ্গা, খুলনা, চাঁদপুর, বরিশাল, ভোলা) মৎস্য আড়ত ও বাজারে পিরানহা মাছ বিক্রি হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশী এসেছে উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলি আর সবচেয়ে কম রয়েছে খুলনা অঞ্চলের জেলার নাম। পিরানহা চাষে যে স্থানটির নাম সবচেয়ে বেশী এসেছে সেটি হচ্ছে বগুড়ার আদমদিঘী। এখানকার চাষিদের দৌড়ত্ব এতটাই বেড়েছে যে তারা এ মাছ চাষের উপর থেকে সরকারি নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেওয়া উচিত বলে মন্তব্য করেছেন যা একটি পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে [তথ্যসূত্র-১০]। এ এলাকার আশেপাশের বিল ও নদীতে এখন পিরানহা মাছের উপস্থিতি স্বাভাবিক একটি বিষয় । এছাড়াও বিভিন্ন পত্রিকায় পিরানহা চাষের খবর পাওয়া গেছে নওগাঁ, জয়পুরহাট, কুমিল্লা, ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম থেকেও।

গত ক’বছরে চলন বিল ও এর আশে পাশের এলাকায় পিরানহা ও আফ্রিকান মাগুর ধরা পড়েছে প্রতিনিয়ত। যতই দিন যাবে এজাতীয় ক্ষতিকর মাছের তালিকা আরও বড় হবে তাতে কোন সন্দেহ নেই [তথ্যসূত্র-০১]। অন্যদিকে আশ্চর্যজনক হলেও সত্য কোন না কোনভাবে কাপ্তাই হ্রদে বিস্তার ঘটেছে গ্রাস কার্প, কার্পিও, রাজপুঁটি, নাইলোটিকা, সিলভার কার্প, তেলাপিয়া, মোজাম্বিক তেলাপিয়া, থাই মহাশোল, পিরানহা এবং আফ্রিকান মাগুর। লেক থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে সীলন, দেশী সরপুঁটি, বাঘাইর, মোহিনী বাটা ও দেশী পাঙ্গাশ প্রজাতির মাছগুলো। আর বিলুপ্ত প্রায় রয়েছে- দেশী মহাশোল, মধু পাবদা, পোয়া, তেলে গুলশা, সাদা ঘনিয়ার মতো প্রজাতির মাছ। ধীরে ধীরে কমছে রুই, কাতলা, মৃগেল, পোয়া, বোয়ালী পাবদা ও বড় চিতল প্রজাতির মাছ। সামান্য কয়েকটি ক্ষতিকর বিদেশি মাছের অনুপ্রবেশের ফলে দেশীয় এতগুলো মাছ আজ বিপন্ন। বিদেশি মাছগুলোর মধ্যে তেলাপিয়া, কার্ফু, থাই সরপুঁটি, আফ্রিকান মাগুর, পিরানহা দেশি মাছের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি বলে মনে করা হয় [তথ্যসূত্র-১১ ও ১২]।

সাকার মাউথ ক্যাট ফিশ। আদি আবাস আমেরিকা। মাছটি কিভাবে কোথা থেকে এলো এ ব্যাপারে দুই ধরনের তথ্য পাওয়া গেছে। এক পক্ষের বক্তব্য, বেশ কয়েক বছর আগে অ্যাকোয়ারিয়াম ফিশ হিসেবে মাছটি থাইল্যান্ড থেকে আনেন ঢাকার কাঁটাবনের ব্যবসায়ীরা। পরবর্তীতে মাছটি রাজধানীর বিভিন্ন অ্যাকোয়ারিয়াম ঘুরে চলে যায় গুলশান লেকে। অন্যমত ১৯৮০ সালের দিকে একজন ইউরোপীয় কূটনীতিক এই মাছটি অ্যাকোয়ারিয়ামের জন্য নিয়ে আসেন। তিন বছর পর তিনি মাছটি গুলশান লেকে ছেড়ে দেন। সেখান থেকেই মাছটি সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। ট্যাংরা মাছের মতো দেখতে তিন কাঁটাবিশিষ্ট সাকার মাউথ ক্যাট ফিশের গায়ের রং তামাটে। শরীরে কোনো আঁশ নেই। অন্য মাছের চেয়ে এর শরীর শক্ত ও খসখসে। অল্প পানি ও বৈরী পরিবেশে মাছটি সহজে বেঁচে থাকতে পারে। প্রজননক্ষমতা খুব বেশি বলে মাছটি অল্প সময়ের মধ্যে খালবিল, নদীনালা, পুকুর-দিঘিতে ছড়িয়ে পড়েছে। আতঙ্কের বিষয় হলো, এই মাছের কারণে দেশে নদী বা অন্যান্য জলাভূমির তলদেশে থাকা দেশি প্রজাতির মাছ এখন হুমকির মুখে [তথ্যসূত্র-১৩]। বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য ও প্রত্যক্ষদর্শীর মতানুসারে মাছটি ঝালকাঠি, মৌলভীবাজার, মুন্সীগঞ্জ, রাজশাহী, নওগাঁ, যশোর, দিনাজপুরের পুকুরের মত বদ্ধ এবং নদী বিলের মতো উন্মুক্ত জলাশয়ে পাওয়া গেছে। আর আত্রাই নদী ও সংলগ্ন বিভিন্ন বিলে মাছটি হরহামেশাই পাওয়া যায়।

বিল ও হাওরের মত উন্মুক্ত জলাশয়ে বিভিন্ন সময়ে বিদেশী মাছ অবমুক্তকরণ করা হয়েছে বেশ ঢাক ঢোল পিটিয়ে। কিন্তু ফলাফল কি হতে পারে তা নিতে পর্যাপ্ত গবেষণা হয়েছে বলে মনে হয় না। এই মাছগুলো মূলত বদ্ধ জলাশয়ে কৃত্রিম চাষ পদ্ধতিতে ব্যবহারের জন্য আনা হয়েছিল। কিন্তু বন্যাপ্রবণ এই দেশে এই মাছ পুকুরের মত বদ্ধ জলাশয়ে আবদ্ধ থাকার নিশ্চয়তা নেই জেনেও অনেক ক্ষতিকর মাছ প্রবেশ করেছে দেশে। এর মধ্যে যুক্ত হয়েছে উন্মুক্ত জলাশয়ে বিদেশী মাছের অবমুক্তিকরণের মতো একটি অবিবেচনা প্রসূত একটা উদ্যোগ।

বাংলাদেশে প্রায় ২৪ প্রজাতির বিদেশী মাছ চাষের জন্য আনা হয়েছে [তথ্যসূত্র-১৪]। তবে বিদেশ থেকে আগত এ্যাকুয়ারিয়ামের বাহারি মাছের সংখ্যা ৭১ এর বেশী [তথ্যসূত্র-১৫]। আমদানিকৃত এসব মাছের দ্বারা দেশীয় মাছের ও পরিবেশের ওপর কি প্রভাব পড়ে সে বিষয়ে তেমন কোনো গবেষণা করা হয়নি। সিলভার কার্প, থাই পুঁটি ইত্যাদির মতো বিদেশী মাছ স্থানীয় মাছের সাথে খাদ্যের প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হয় যা দেশীয় মাছের জন্য ক্ষতিকারক ভূমিকা হয়ে দেখা দেয়। পিরানহা ও আফ্রিকান মাগুরের মত পরভোজী ও রাক্ষুসে স্বভাবের মাছ সহজেই দেশী মাছ ও অন্যান্য জলজপ্রাণীদের ধরে খেয়ে ফেলে। আফ্রিকান মাগুর ও পাংগাস প্রজাতির মাছ দেশী মাছের সাথে হংসশাবক, শামুক এমন কি পাখি পর্যন্ত খেয়ে ফেলছে বলে জানা যায়। তেলাপিয়া ও নাইলোটিকা মাছ রাক্ষুসে স্বভাবের না হলেও এদের বংশবিস্তার ক্ষমতা ও বৃদ্ধির পরিমাণ অত্যন্ত দ্রুত ও বেশি। ফলে এই মাছ দেশী মাছের খাদ্যে ভাগ বসাচ্ছে এবং তাদের বাসস্থান ক্রমশ দখল করে ফেলছে। বাংলাদেশে কোনো কোনো বিদেশী প্রজাতির মাছের চাষ শুধু সংরক্ষিত পুকুরে চাষাবাদের সুপারিশ থাকলেও বন্যার কারণে সে শর্ত রক্ষা করা সম্ভব হয়নি। এসব তথ্য থেকে সহজেই অনুধাবন করা সম্ভব যে, বিদেশী মাছের প্রজাতি দেশী বা স্থানীয় মাছের ওপর কতটা বিরূপ প্রভাব ফেলেছে। অপরদিকে ভারত হতে বিভিন্ন প্রকার ক্ষতিকারক মাছের প্রজাতি বাংলাদেশে বন্যার পানির সাথে যত্রতত্র আগমন ঘটেছে এবং জলাশয়ে ব্যাপক বিস্তার ঘটেছে [তথ্যসূত্র-১৬]। উল্লেখিত সূত্রে ভারত থেকে কোন কোন ক্ষতিকারক মাছ দেশে প্রবেশ করেছে সে সম্পর্কে কোন তথ্য পাওয়া যায় নি। বরং উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে পিরানহা, আফ্রিকান মাগুর দেশের বাইরে পাচারের খবর বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে।

৪. মাছ চাষের বিবেচনাহীন প্রসার:
“সব জলাশয়ে মাছ চাষ, সুখের সাথে বসবাস” এই শ্লোগানটি যখন জনপ্রিয় করে তোলা হয় তখন নিশ্চয় এর প্রভাব নিয়ে কেউ ভাবে নি। প্রাকৃতিকভাবে বড় হওয়া মাছ আহরণের পরিমাণ কমে যাবার প্রেক্ষিতে এই স্লোগান জনপ্রিয়তা পাবে তাই স্বাভাবিক। কিন্তু সব জলাশয় তো দূরের কথা বেশীরভাগ জলাশয় চাষের আওতায় চলে আসলে দেশীয় মাছের আবাসনের ব্যবস্থা, প্রজননের ব্যবস্থা কি হবে তার কোন চিন্তা করা হয় নি তা নিশ্চিতভাবে বলা যায়।

মাছ চাষের দোহাই দিয়ে পুকুর থেকে আগেই দেশীয় ছোট মাছকে ঝুটিয়ে বিদায় করা হয়েছে, পরবর্তীতে মাছ চাষ বিলে বিস্তার লাভ করায় এবার বিলের মতো উন্মুক্ত জলাশয় (যা দেশী ছোট মাছের গুরুত্বপূর্ণ আশ্রয়স্থল ও প্রজনন ক্ষেত্র) থেকে ক্রমশ দেশীয় ছোট-বড় মাছ বিদায় নেবে তা নিশ্চিত করে বলা যায়। তাই বলা যায় সব জলাতে বিশেষত বিল, হাওর ও হ্রদের মত জলাশয়গুলোতে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে মৎস্য চাষ বৃদ্ধি পাওয়া এবং ক্ষতিকর বিদেশী মাছের আগ্রাসনে আজ হুমকির মধ্যে পড়েছে নানা প্রজাতির দেশি মাছ।

পুনশ্চ:
তিন পর্বের এ লেখায় প্রথম পর্বে ছিল- বাংলাদেশের মৎস্য বৈচিত্র্য: অতীত ও বর্তমান
আর পরে পর্বে থাকবে- বাংলাদেশের মৎস্য বৈচিত্র্য রক্ষার উপায়

তথ্যসূত্র:
[০১] গৌতম কুমার রায়, চলন বিল হারাচ্ছে সক্রিয়তা: বিলুপ্ত পঁচিশ প্রজাতির মাছ, দৈনিক জনকণ্ঠ, ১১ জুন ২০১০।
[০২] হাসনাইন ইমতিয়াজ, কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র: হারিয়ে যাবে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য, শীর্ষনিউজ, ১৩ মে ২০১১।
[০৩] সুনামগঞ্জের হাওরে ৫৪ প্রজাতির মাছ বিপন্ন: বেসরকারী সংস্থার গবেষণা রিপোর্ট, দৈনিক জনকণ্ঠ, ১১ মে ২০১১।
[০৪] এ.বি.এম. মহসিন, জাহাজভাঙ্গা কার্যক্রমঃ বিপন্ন মানুষ, মাছ আর পরিবেশ, বিডিফিশ বাংলা, ২০১০।
[০৫] আরাফাত সিদ্দিকী, কাঠা দিয়ে মাছ শিকার: হুমকির মুখে মুক্তজলাশয়ের মৎস্যবৈচিত্র্য, বিডিফিশ বাংলা, ২০১০।
[০৬] এ.বি.এম. মহসিন, মৃত প্রাণী ব্যবহার করে মাছ শিকারঃ মৎস্য বৈচিত্র্যের জন্য একটি বড় হুমকি, বিডিফিশ বাংলা, ২০১০।
[০৭] হুমকিতে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য, কৃষক কমিউনিটি।
[০৮] হাবিবুর রহমান, উপকূলীয় অঞ্চলের মৎস্যসম্পদ ও জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে, প্রবাসবার্তা, ১১ মে ২০১০।
[০৯] এ.বি.এম. মহসিন, উপকূলীয় এলাকায় অবৈধভাবে চিংড়ির পোনা আহরণঃ হুমকিতে জলজ জীববৈচিত্র্য, বিডিফিশ বাংলা, ২০১০।
[১০] এস এম নাজমুল হক ইমন, বাজারজাত হচ্ছে পিরানহা! , দৈনিক ইত্তেফাক, ৭ নভেম্বর ২০১০।

[১১] মো.শফিকুর রহমান, রাঙামাটির হ্রদে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে: কাপ্তাই হ্রদের মৎস্য সম্পদ হুমকির মুখে, বিএনবি নিউজ, ১৭ মার্চ ২০১১।

[১২] ফজলে এলাহী, বদলে যাচ্ছে কাপ্তাই হ্রদের মৎস্য বৈচিত্র্য, সাপ্তাহিক ২০০০, ২০ জানুয়ারী ২০১১।
[১৩] ফখরে আলম, অ্যাকুয়ারিয়াম ফিশের বিড়ম্বনা, দৈনিক কালের কণ্ঠ, ২৮ মে ২০১০।
[১৪] শরীফুল ইসলাম, শতাধিক দেশি প্রজাতির মাছ বিপন্ন, প্রথম আলো, ৫ আগষ্ট, ২০০৯।
[১৫] SM Galib and ABM Mohsin, 2011. Cultured and Ornamental Exotic Fishes of Bangladesh: Past and Present. LAP LAMBERT Academic Publishing GmbH @ Co. KG, Germany. 176 pp.
[১৬] ড. সন্তোষ কুমার সরকার, বাংলাদেশের জীববৈচিত্র্য ও ক্ষতিকারক বিদেশী প্রজাতি, কৃষি তথ্য সার্ভিস। ডাউনলোড ১৮ মে ২০১১।

এই লেখটি তৈরি করতে আরও যেসব সংবাদপত্র ও সংবাদ সংস্থার সাহায্য নেয়া হয়েছে সেগুলো হল-
ইত্তেফাক, সংবাদ, বাংলা নিউজ২৪, সিএইচটি নিউজ২৪, সমকাল, ইউএনএস নিউজবিডি. দৈনিক জনকণ্ঠ, প্রথম আলো, দৈনিক কালেরকণ্ঠ, বিডিনিউজ২৪, আমারদেশ অনলাইন, আমাদের রাজশাহী, নিউজবিএনএ, রংপুরওয়েব, কুড়িগ্রাম নিউজ, দৈনিক করতোয়া, দৈনিক খেয়াইমাথাভাঙ্গা


Visited 2,579 times, 1 visits today | Have any fisheries relevant question?
বাংলাদেশের মৎস্য বৈচিত্র্য হ্রাসের কারণ

Visitors' Opinion

এ বি এম মহসিন

প্রফেসর, ফিশারীজ বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী-৬২০৫, বাংলাদেশ। বিস্তারিত ...

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.