কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দেশীয় ছোট মাছ
কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দেশীয় ছোট মাছ

দেশীয় ছোট মাছ:
সাধারণত এ দেশের প্রাকৃতিক উৎসজাত এমন মাছ যেগুলো পূর্ণ বয়স্ক অবস্থায় সর্বোচ্চ ৯ ইঞ্চি বা ২৫ সে.মি. পর্যন্ত আকারের হয়ে থাকে সেগুলোকে দেশী ছোট মাছ বলে। এ দেশের স্বাদু পানির ২৬০টি প্রজাতির মাছের মধ্যে অধিকাংশই ছোট মাছ। তবে বর্তমানে এর মধ্যে মাত্র ৫০ প্রজাতির ছোট মাছ কোন রকমে টিকে আছে। বাদ বাকী মাছ প্রাকৃতিক আবাসস্থল ভরাট ও সংকোচনসহ মনুষ্যসৃষ্ট নানাবিধ কারণে বিপদাপন্ন, বিপন্ন ও বিলুপ্তপ্রায়। এ বিপন্নতার হাত থেকে দেশীয় মূল্যবান ছোট মাছগুলি রক্ষার যেসব ব্যবস্থাপনা গ্রহণ করা হয়েছে তার মধ্যে ছোট মাছ চাষের উদ্যোগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং একান্ত প্রয়োজনীয়।

দেশীয় ছোট মাছের গুরুত্ব:

  • দেশী ছোট মাছ সবার জন্য বিশেষত গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর জন্য একটি সহজলভ্য পুষ্টির উৎস।
  • ছোট মাছ সহজপাচ্য উন্নতমানের প্রাণীজ আমিষ সরবরাহকারী হিসেবে চিহ্নত।
  • ছোট মাছে মানবদেহের জন্য উপকারী অত্যাবশ্যকীয় এমাইনো এসিড বর্তমান যা দেহের কোলেস্টেরলের মাত্রা কমায়।
  • এ মাছে ওমেগা থ্রি ফ্যাটি এসিড রয়েছে যা রক্তের অণুচক্রিকাকে জমাট বাঁধতে বাঁধা দেয় ও ফুসফুসের প্রদাহ কমাতে সহায়তা করে।
  • ছোট মাছে কম-বেশি প্রায় ৭২% পানি, ১৯% আমিষ, ৮% চর্বি, ০.১৫% ক্যালসিয়াম, ০.২৫% ফসফরাস এবং ০.১০% ভিটামিন এ, বি, সি এবং ডি আছে।
  • প্রচুর পরিমাণে ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, লৌহ ও আয়োডিনের মত খনিজ পদার্থ থাকায় দৈহিক বৃদ্ধি, ক্ষয় পূরণ ও রোগ প্রতিরোধে ছোট মাছ অত্যন্ত কার্যকর।
  • অন্ধত্ব, রাতকানা, রক্তশূন্যতা, গলগণ্ড প্রভৃতি রোগ প্রতিরোধকারী।
  • ছোট মাছের তেল কিডনিতে পাথর হওয়ার ঝুঁকি কমায়।
  • গর্ভবতী, প্রসূতি ও দুগ্ধদানকারী মায়েদের রক্তশূন্যতা দূরীকরণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
  • গর্ভাবস্থায় বাচ্চার স্বাভাবিক বৃদ্ধির (বাচ্চার মস্তিষ্ক, চোখের গঠন, হাড় ও দাঁতের গঠন) জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।
  • প্রচুর ভিটামিন এ সমৃদ্ধ বলে চোখের দৃষ্টি শক্তি বৃদ্ধি ও রাতকানা রোগ প্রতিরোধে সহায়ক।
  • ওজনানুপাতে সংখ্যায় বেশি হয় বলে পরিবারের সদস্যদের মাঝে বণ্টনে সুবিধা হয়।
  • ছোট ছোট ভাগায় বিক্রি হয় বলে স্বল্প আয়ের মানুষ ক্রয় করে পারিবারিক পুষ্টি চাহিদা মিটাতে পারে।

ছোট মাছের গুরুত্ব বোঝার জন্য কয়েকটি ছোট ও বড় মাছের প্রতি ১০০ গ্রামে প্রাপ্ত পুষ্টি উপাদানের তুলনামূলক চিত্র নিচে দেয়া হল-

দেশীয় ছোট মাছ

প্রজাতি ভিটামিন-এ (মাইক্রোগ্রাম) ক্যালসিয়াম (মিলিগ্রাম) আয়রন (মিলিগ্রাম)
মলা ১৯৬০ ১০৭১
ঢেলা ৯৩৭ ১২৬০
দারকিনা ১৪৫৭
চান্দা ৩৪১ ১১৬২
পুঁটি ৩৭ ১০৫৯

বড় মাছ

প্রজাতি ভিটামিন-এ (মাইক্রোগ্রাম) ক্যালসিয়াম (মিলিগ্রাম) আয়রন (মিলিগ্রাম)
ইলিশ ৬৯ ১২৬
সিলভার কার্প ১৭ ২৬৮
রুই ২৭ ৩১৭
তেলাপিয়া ১৯

 

ছোট মাছ চাষের গুরুত্ব:

  • ছোট, বড়, গভীর, অগভীর সবধরনের জলাশয় ছোট মাছ চাষের জন্য উপযোগী।
  • ছোট মাছ অধিক ঘনত্বে এককভাবে চাষ করা যেমন লাভজনক তেমনই আবার রুই জাতীয় মাছের সাথে ছোট মাছের মিশ্রচাষ করাও লাভজনক। পরিকল্পিতভাবে ধানক্ষেতেও ছোট মাছ চাষ করা যায়।
  • ছোট মাছ সারা বছর উৎপাদনশীল। প্রাকৃতিক জলজ পরিবেশে নিজে নিজেই বংশবিস্তার করে। ফলে চাষিকে প্রতিবছর পোনা মজুদ করতে হয় না। চাষির শ্রম ও অর্থের সাশ্রয় হয়।
  • চাষে সময় কম লাগে। মজুদের দুই তিন মাস পর থেকে কিছুদিন পরপর ক্রমাগতভাবে মাছ ধরে পরিবারের প্রয়োজনীয় চাহিদা পূরণ এবং অতিরিক্ত মাছ বাজারে বিক্রয় করে বাড়তি আয় লাভ করা সম্ভব হয়।
  • দেশীয় মাছের নানা বৈচিত্র্যময় প্রজাতি সংরক্ষণের জন্য ছোট মাছ চাষ প্রয়োজনীয়।
  • স্বাদু পানির বিলুপ্ত ও বিপন্ন মাছের পুনরাবির্ভাব ঘটানোর জন্য ও সবার জন্য মাছ প্রাপ্তি সহজতর করতে ছোট মাছ চাষের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। আর এ কারণেই মাঠ পর্যায়ে বড় মাছের সাথে ছোট মাছ চাষ প্রযুক্তি সম্প্রসারণ করাও এখন সময়ের দাবী।

 

দেশীয় ছোট মাছের চাষ প্রযুক্তি:

পুকুর প্রস্তুতি:

  • চাষের শুরুতেই জাল টেনে বা পুকুর শুকিয়ে পুকুরে থাকা রাক্ষুসে ও ক্ষতিকর মাছ দমন করা।
  • তারপর পুকুরের পাড় ও তলা মেরামত করা।
  • তলার অতিরিক্ত পোঁচা কাঁদা অপসারণ করে নেয়া।
  • পুকুরে ছায়াদানকারী বৃক্ষের ডালপালা কেটে রৌদ্র পড়ার ব্যবস্থা করা।
  • পুকুরের পাড় ঘেঁষে থাকা ভাসমান লতা-পাতা ও উপকারী ঘাস জাতীয় আগাছা সামান্য পরিমাণ রেখে অন্যান্য জলজ ও ভাসমান আগাছা পরিষ্কার করা।

চুন ও সার প্রয়োগ:

  • প্রতি শতাংশে ০১-০২ কেজি হারে চুন প্রয়োগ করতে হয়।
  • চুন দেয়ার ৩/৪ দিন পর প্রতি শতাংশে ৫-৭ কেজি গোবর, ১৫০-২০০ গ্রাম ইউরিয়া ও ১০০ গ্রাম টিএসপি সার একসাথে পানিতে গুলিয়ে নিয়ে সারা পুকুরে ছিটিয়ে দিতে হয়।

পোনা মজুদ:

  • সার প্রয়োগের ৪/৫ দিন পর পানির রং যখন হালকা সবুজ বা হালকা বাদামী হবে তখন ছোট মাছ ও মিশ্রচাষের ক্ষেত্রে অন্যান্য মাছ মজুদ করতে হবে।

 

মলা মাছের চাষ:

  • মলা, বাটা ও ভাগনার মিশ্রচাষের ক্ষেত্রে শতাংশে ১০০-১২০টি বড় মলা, ১০-১৫ গ্রাম ওজনের ৫০টি ছোট ভাগনা ও ১০০টি বাটা অর্থাৎ একত্রে ২৫০টি হারে পোনা মজুদ করে চাষ যায়।
  • মলা মাছের একক চাষে শতাংশে ৪০০টি বড় মলা মাছ মজুদ করা যায়।
  • মলা সাধারণত পুকুরের উপরের স্তরের খাবার খায়। মজুদকৃত মাছের খাদ্য হিসাবে দেহের মোট ওজনের ৭% হারে চালের মিহি কুড়া ও সরিষার খৈল অর্ধেক অর্ধেক হারে (৫০:৫০) মিশিয়ে প্রয়োগ করা যেতে পারে।
  • গবেষণায় দেখা গেছে, পরিপক্ব ছোট মলা মাছ মজুদের ২-৩ সপ্তাহের মধ্যে প্রজননের কাজ শেষ করে।
  • বৈশাখের শুরুর দিকে উপযুক্ত পরিবেশ পেলে পরিপক্ব মলা মাছ পুকুরের পাড় ঘেঁষে থাকা ভাসমান লতা-পাতায় ডিম ছাড়ে। ১-২ দিনের মধ্যে এ ডিম থেকে রেণু পোনার জন্ম হয়। মলা মাছ বছরে ২/৩ বার ডিম ছাড়ে।
  • ডিম ছাড়ার ৩০ দিন পরেই কিছু মাছ আহরণযোগ্য হয়। এরপর প্রতি ১৫/২০ দিন পরপর কিছু কিছু ছোট মলা মাছ ধরা যায়। মলা সর্বোচ্চ ৯ সে.মি পর্যন্ত লম্বা হয়, তবে ৩-৫ সে.মি হলেই বিক্রয় করা যায়।

 

রুই জাতীয় মাছের সাথে অন্যান্য ছোট মাছ চাষ:
রুই জাতীয় মাছের সাথে ছোট মাছের মিশ্রচাষে প্রতি শতাংশের জন্য নিম্নবর্ণিত মজুদ ঘনত্ব অনুসরণ করা যেতে পারে-

প্রজাতি নমুনা ১ নমুনা ২ নমুনা ৩ নমুনা ৪ নমুনা ৫
মলা ৬০  –  –  – ১০০
দেশী পুঁটি ৬০  –  –  –  –
দেশী সরপুঁটি  –  – ১৫  –  –
বিদেশী রাজপুঁটি  –  –  – ০৮  –
শিং  – ২০০  –  –  –
পাবদা  –  –  – ৭০  –
বাটা  –  –  –  – ১০০
রুই ০৮ ১০ ০৫  –  –
কাতলা ০৫ ০৫ ০৫ ০৪ ০৪
মৃগেল ০৮  – ০৪ ০৮ ০৮
সিলভার কার্প ০৭ ০৫ ০৫ 8 ১৬
গ্রাস কার্প ০২  – ০২ ০২ ০২
কার্পিও  –  – ০৪  –  –
মোট ১৫০ ২২০ ৪০ ১০০ ২৩০

 * যেসব মাছকে প্রাধান্য দিয়ে নমুনা তৈরি করা হয়েছে সেগুল হল- নমুনা-১: মলা ও পুঁটি, নমুনা-২: শিং, নমুনা-৩: দেশী সরপুঁটি, নমুনা-৪: পাবদা এবং নমুনা-৫: মলা ও বাটা।

 

ফিডিং ট্রে ব্যবহার করে মাছের খাবারের অপচয় কমানো যায়
ফিডিং ট্রে ব্যবহার করে মাছের খাবারের অপচয় কমানো যায়

সম্পূরক খাদ্য প্রয়োগ:
মাছের দ্রুত বৃদ্ধির স্বার্থে খাবার হিসাবে মজুদকৃত মাছের দেহের মোট ওজনের ৭% হারে সম্পূরক খাদ্য প্রয়োগ করতে হয়। ফিডিং ট্রেতে খাবার দিলে খাদ্যের অপচয় কমে ও পানির গুণগতমান ভাল থাকে। সম্পূরক খাবার হিসাবে চাষির হাতের কাছে থাকা চালের মিহি কুড়া ও সরিষার খৈল অর্ধেক অর্ধেক হারে মিশিয়ে প্রয়োগ করা যায়। আবার নিম্নরূপ খাদ্য উপকরণসমূহের মিশ্রণে ভাল প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার তৈরি করা যায়।

উপকরণ বিদ্যমান আমিষ (%) ব্যবহার মাত্রা (%) মিশ্রণের পরিমাণ (গ্রাম) প্রাপ্ত আমিষ (%)
ফিসমিল ৫৬.৬১ ২৫ ২৫০ ১৪.১৫
সরিষার খৈল ৩০.৩৩ ২৫ ২৫০ ৮.৩৩
গমের ভুষি ১৪.১৭ ৪০ ৪০০ ৫.৮২
আটা ১৭.৭৮ ১০ ১০০ ১.৭৮
খনিজ লবণ ১ চা চামচ
মোট ১০০ ১০০০ ৩০.০৮

 

অন্যান্য পরিচর্যা:

  • পোনা মজুদের পর খাদ্য প্রয়োগের পাশাপাশি নিয়মিতভাবে সার প্রয়োগ করতে হয়। অন্তত প্রতি ১৫ দিন পর পর প্রতি শতাংশে গোবর ৩ কেজি, ইউরিয়া ১০০ গ্রাম ও টিএসপি ৫০ গ্রাম হারে পানিতে গুলিয়ে ছিটিয়ে দিতে হবে।
  • পুকুরে অতিরিক্ত শ্যাওলা দেখা দিলে, বর্ষাকালে ও শীতকালে সার প্রয়োগ কমিয়ে দিতে হয় বা সাময়িকভাবে বন্ধ রাখতে হয়।
  • শীতের সময় রোগের জন্য অনুকূল পরিবেশ যাতে তৈরি না হতে পারে সেজন্য প্রতি শতাংশে ০১ কেজি হারে চুন প্রয়োগ এবং এর ৪/৫ দিন পর ০১ কেজি হারে লবণ প্রয়োগ করতে হবে।
  • কোন রোগ ব্যাধি বা সমস্যার ক্ষেত্রে স্থানীয় উপজেলা মৎস্য অফিসে যোগাযোগ করতে হবে।

 

তথ্যসুত্র:

  • ইকলার্ম, আইটিডিজি ও মৎস্য অধিদপ্তর, ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৮, বাংলাদেশে মিঠা পানিতে ক্ষুদ্র পরিসরে মাছ চাষ- একটি ব্যবহারিক নির্দেশিকা।
  • বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ, মে, ২০০৫, রুই জাতীয় মাছের মিশ্র চাষে মলা।
  • মৎস্য অধিদপ্তর, জুলাই, ২০০৭, দেশীয় প্রজাতির মৎস্য সংরক্ষণ ও সম্প্রসারণ অভিযান ২০০৭ এর সংকলন।
  • মৎস্য অধিদপ্তর, বাংলাদেশ, জুন, ২০০৭, গলদা চিংড়ি চাষ ব্যবস্থাপনা, স্বাদু পানির চিংড়ি চাষ সম্প্রসারণ প্রকল্প।
  • মৎস্য অধিদপ্তর, জুন, ২০০৬, দেশীয় প্রজাতির ছোট মাছ চাষ সহায়িকা।

Visited 4,706 times, 1 visits today | Have any fisheries relevant question?
দেশীয় ছোট মাছের গুরুত্ব ও চাষ প্রযুক্তি

Visitors' Opinion

মোঃ আবুল কালাম আজাদ

সিনিয়র উপজেলা মৎস্য অফিসার, মৎস্য অধিদপ্তর, বাংলাদেশ। তিনি খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মৎস্যবিজ্ঞানে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জন করেছেন। বর্তমানে একই বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি পর্যায়ে গবেষণা করছেন। যোগাযোগ: akazad_dof@yahoo.com । বিস্তারিত

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.