শিং ও মাগুর মাছ
শিং ও মাগুর মাছ

শিংমাগুর মাছ খেতে যেমন সুস্বাদু তেমনই পুষ্টিকর। সহজপাচ্য হওয়ায় রোগীর পথ্য হিসেবে এর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। পানির পাশাপাশি বায়ু থেকে শ্বাস গ্রহণ করতে পারায় শিং-মাগুর মাছ প্রতিকুল পরিবেশেও বেঁচে থাকতে পারে। ফলে এদেরকে হাজা-মজা পুকুরেও চাষ করা সম্ভব। ব্যাপক চাহিদা থাকা সত্ত্বেও আমাদের দেশে দেশী শিং ও মাগুর মাছের চাষ এখনও বৃহৎ পরিসরে শুরু করা সম্ভব হয়নি। তবে অল্প পরিসরে অনেক জলাশয়ে পরীক্ষামূলকভাবে এর চাষ শুরু হয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এদের একক চাষ করা হয়ে থাকে তবে উপযুক্ত পদ্ধতি অবলম্বন করলে মিশ্র চাষ করা সম্ভব। এলেখায় পুকুরে শিং ও মাগুরের চাষ ব্যবস্থাপনা বিস্তারিত আলোচনা করা হল।

 

১. মজুদ পূর্ব ব্যবস্থাপনা

১.১ পুকুর নির্বাচন:
দেশী শিং/মাগুর মাছ মিঠা পানির যে কোন জলাশয়েই চাষ করা যায় তবে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে চাষের জন্য জলাশয় নির্বাচনের ক্ষেত্রে পুকুর বা জলাশয়ের কিছু বৈশিষ্ট্য বিবেচনায় আনলে অধিক লাভবান হওয়া যায়। যেমন-

  • ছোট আয়তনের পুকুরেই এ মাছ চাষের জন্য সুবিধাজনক।
  • চাষের জন্য ০.১৫-০.৩০ হেক্টর আয়তনের পুকুর নির্বাচন করা ভাল যার গভীরতা ৬ ফুটের বেশী নয় (দাশ, ১৯৯৭)। হক (২০০৬) অনুসারে পুকুরের গভীরতা ৪-৬.৫ ফুটের মধ্যে হওয়া ভাল। অন্যদিকে সিদ্দিকী ও চৌধুরী (১৯৯৬) এর মতে এই গভীরতা ৪.৯ ফুটের (১.৫ মি) মধ্যে হওয়াই উচিৎ।
  • যে সব পুকুরের গভীরতা গ্রীষ্মে তথা শুষ্ক মৌসুমে এতটাই কমে আসে যে রুই জাতীয় মাছ চাষে ভাল উৎপাদন পাওয়া যায় না এমন পুকুরেও শিং-মাগুর চাষ করা যায় সহজেই।
  • পাট পচানোর কাজে ব্যবহৃত পুকুরও এ মাছ চাষের জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে।

 

১.২ পুকুর প্রস্তুতি:
পোনা ছাড়ার পূর্বে অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে নিলে তা পোনার দ্রুত বৃদ্ধির জন্য সহায়ক হয়ে থাকে। তাই মাছচাষে পুকুর প্রস্তুতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

১.২.১ তলদেশ ও পাড় মেরামত:
সম্ভব হলে শীতের পরপরই সেচের মাধ্যমে পুকুর শুকিয়ে ফেলা প্রয়োজন। এতে করে তলদেশ ও পাড় মেরামত করে নেয়া ছাড়াও সহজেই আগাছা পরিষ্কার, শিকারী ও আমাছা অপসারণ ও শুষ্ক গুড়া চুন প্রয়োগ করা যায়।
পুকুর প্রস্তুতির সময় পুকুরের তলায় শতাংশ প্রতি ০.৫ কেজি চুন ছিটিয়ে দিয়ে ৪-৫ দিন রোদে শুকানোর পর পানি ভর্তি করা উচিত (সিদ্দিকী ও চৌধুরী, ১৯৯৬) ।
পুকুরের পাড় কমপক্ষে ১.৫ – ১.৬ ফুট উঁচু হওয়া প্রয়োজন। পাড় যথেষ্ট উঁচু না হলে বাঁশের বানা অথবা ছোট ফাঁস বিশিষ্ট জাল দিয়ে ঘিরে দিতে হবে যেন অতিবৃষ্টি বা বন্যায় প্লাবিত হয়ে মাছ বেরিয়ে যেতে না পারে।

১.২.২ মাছ ও আগাছা অপসারণ:

জলজ আগাছা অপসারণ
জলজ আগাছা অপসারণ

পুকুরে রাক্ষুসে মাছ বা আগাছা থাকলে তা পোনার জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাড়ায়। তাই পোনা মজুদের পূর্বেই পুকুরের রাক্ষুসে মাছ ও আগাছা দমন করা প্রয়োজন।
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে পুকুর শুকিয়ে সহজেই রাক্ষুসে মাছ ধরে নেওয়া যায়। যদি পুকুরে সেচ দেওয়া সম্ভব না হয় তবে ঘন ফাঁসের জাল বারবার টেনে রাক্ষুসে মাছ নিয়ন্ত্রণ করা যায়। এছাড়াও রাসায়নিক পদ্ধতিতে অল্প আয়েসে রাক্ষুসে মাছ দমন করা যায়। সেজন্য প্রতি শতাংশে প্রতি ফুট গভীরতার জন্য ২৫-৩০ গ্রাম রোটেনন পাউডার পানিতে গুলিয়ে সমভাবে পুকুরে ছিটিয়ে দিয়ে সব ধরনের মাছ অপসারণ করা যায়। (মৎস্য অধিদপ্তর, ২০০২)।
পুকুর বা পাড়ে যদি কচুরিপানা বা অন্যান্য আগাছা থাকে তবে তা তুলে ফেলতে হবে।

চুন প্রয়োগ
চুন প্রয়োগ

১.২.৩ চুন প্রয়োগ:
পুকুরকে দূষণ মুক্ত রাখতে ও পানির ঘোলাটত্ব দূর করতে পুকুরে চুন প্রয়োগ করার হয়। পুকুর শুকিয়ে চুন প্রয়োগ করা ভাল। যদি তা সম্ভব না হয় তবে তবে পানি পূর্ণ পুকুরে আগে থেকে পানিতে গুলিয়ে নেয়া চুন ছিটিয়ে প্রয়োগ করা যায়। পুকুরে শতাংশ প্রতি ০.৫ থেকে ১.৫ কেজি চুন প্রয়োগ করতে হবে।

 

১.২.৪ সার প্রয়োগ:
পুকুরের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি তথা প্রাকৃতিক খাদ্যের সংখ্যা ও আয়তন বৃদ্ধির জন্য সার প্রয়োগ করা হয়ে থাকে। পুকুর প্রস্তুতির শেষ ধাপে সার প্রয়োগ করা হয়। চুন প্রয়োগের ৩-৪ দিন (হক, ২০০৬) বা ৭-১০ দিন (মৎস্য অধিদপ্তর, ২০০২) পর নিম্নোক্ত মাত্রায় সার প্রয়োগ করা হয়।

সার প্রয়োগ-মাত্রা
নমুনা-১ (হক, ২০০৬) নমুনা-২ (মৎস্য অধিদপ্তর, ২০০২)
গোবর ১০-২০ কেজি/ডেসি ৫-৭ কেজি/ডেসি
হাঁস-মুরগির বিষ্ঠা ৩-৪ কেজি/ডেসি
ইউরিয়া ১০০ গ্রাম/ডেসি ১০০-১৫০ গ্রাম/ডেসি
টিএসপি ১০০ গ্রাম/ডেসি ৫০-৭৫ গ্রাম/ডেসি
এমপি ২০ গ্রাম/ডেসি

 

২. মজুদ ব্যবস্থাপনা:

২.১ পোনার উৎস:

প্রাকৃতিক বা কৃত্রিম উভয় উৎস থেকেই পোনা সংগ্রহ করা যায়। বর্ষাকালে প্লাবিত ধানক্ষেতে মাগুর মাছ ডিম পাড়ে। প্লাবিত ধানক্ষেত সংলগ্ন অগভীর গর্ত থেকে এদের পোনা সংগ্রহ করা যায়।

কৃত্রিম ভাবে সরকারি পর্যায়ে গুলশান এবং ধানমন্ডি লেক প্রকল্প, মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউট, ময়মনসিংহ এবং ব্যক্তি পর্যায়ে গড়ে ওঠা মাগুর মাছের পোনা উৎপাদন খামার থেকেও পোনা সংগ্রহ করা যায়।

 

২.২ মজুদ ঘনত্ব:

হক (২০০৬) এর মতে শতাংশ প্রতি ৫-৮ সে. মি. আকারের ১৫০-২০০টি মাগুর/শিং এর পোনা মজুদ করলে ভাল ফল পাওয়া যায়।  মৎস্য অধিদপ্তর (২০০২) অনুসারে ৪-৬ সে. মি. আকারের পোনা শতাংশ প্রতি ১০০-১৫০টি (হেক্টরে ২৪,৭০০-৩৭,০০০ টি) মজুদ করা যায়।

দাশ (১৯৯৭) বিভিন্ন চাষ পদ্ধতিতে পোনার বিভিন্ন মজুদ ঘনত্ব উল্লেখ করেন-

চাষ পদ্ধতি

মজুদ ঘনত্ব (সংথ্যা/শতাংশ)

আকার (সেমি)

ওজন (গ্রাম)

মাগুর

শিং

মাগুর

শিং

মাগুর

শিং

নিবিড় চাষ

২,০০০-৩,০০০

২,৫০০-৩,০০০

৪-১২

৮-১২

৮-১২

৮-১০

আধা নিবিড়

৩০০-৪০০

৩৬০-৪৫০

৪-১২

৮-১২

৮-১২

৮-১০

গতানুগতিক

২০০-২২০

২২০-২৪০

৪-১২

৮-১২

৮-১২

৮-১০

 

২.৩ পোনা শোধন:

পোনা ছাড়ার সময় ২০০-২৫০ পিপিএম মাত্রার ফরমালিন দ্রবণে বা ম্যালাকাইট গ্রিন দ্রবণে  ১০-১৫ মি. পোনা শোধন করে নেয়ার পর পুকুরে ছাড়লে পোনার মৃত্যুহার কম হয়।

 

২.৪ পোনা ছাড়া:

সকালে অথবা বিকালে পোনা ছাড়ার উপযুক্ত সময়। তীব্র রৌদ্র সর্বদাই পরিহার করা উচিৎ। পোনার পাত্র/ব্যাগ ৩০ মিনিট পুকুরের পানিতে ভাসিয়ে রাখতে হবে যাতে করে পোনা পাত্রের/ব্যাগের পানির তাপমাত্রা এবং পুকুরের পানির তাপমাত্রা কাছাকাছি থাকে। এর পর পোনার পাত্র কাত করে এমনভাবে ধরতে হবে যেন পুকুরের পানি পাত্রে প্রবেশ করতে থাকে। এ অবস্থায় পাত্রের মুখে যে স্রোত সৃষ্টি হয় তার বিপরীতে পোনা সাঁতার কেটে পুকুরে স্থানান্তর হয়।

 

নমুনায়ন
নমুনায়ন
মাছের ওজন নেয়া
মাছের ওজন নেয়া
দৈর্ঘ্য পরিমাপ
দৈর্ঘ্য পরিমাপ

৩. মজুদ পরবর্তী ব্যবস্থাপনা:
৩.১ খাদ্য সরবরাহ:
সাধারণত পুকুরে দৈনিক ২ বার খাদ্য পরিবেশন করতে হয়। মোট খাবারের এক চতুর্থাংশ থেকে অর্ধেক সকালে (১০-১১টা) এবং অর্ধেক থেকে তিন চতুর্থাংশ বিকেলে (৩-৪ টা) দেওয়া ভাল। শুরুর দিকে মোট মাছের ওজনের ৫-১০ শতাংশ এবং পরের দিকে  মোট মাছের ওজনের ৩-৪ শতাংশ হারে সম্পূরক খাবার সরবরাহ করতে হবে (মৎস্য অধিদপ্তর, ২০০২ এবং সিদ্দিকী ও চৌধুরী, ১৯৯৬)।

মাছের মোট ওজন পরিমাপের জন্য নমুনায়ন পদ্ধতি সবচেয়ে ভাল। এ পদ্ধতিতে মোট মাছের কমপক্ষে ১০ শতাংশ মাছ নমুনা মাছ হিসেবে সংগ্রহ করা হয়। নমুনা মাছের গড় ওজন নির্ণয় করে মজুদকৃত মাছের মোট সংখ্যা দিয়ে গুণ করে মাছের মোট ওজন নির্ণয় করা হয়।

মৎস্য অধিদপ্তর (২০০২) অনুসারে  চালের কুঁড়া ৪০ ভাগ, সরিষা বা অন্যান্য তৈলবীজের খৈল ৩০ ভাগ এবং ফিশমিল বা শুঁটকী ৩০ ভাগ একত্রে মিশিয়ে মাগুর বা শিং মাছের খাদ্য তৈরি করা যায়। আগের দিন চালের কুঁড়া ও খৈল সমপরিমাণ পানিতে ভিজিয়ে রেখে পরের দিন তার সাথে ফিশমিল মিশিয়ে গোলাকার বল আকারের খাদ্য তৈরি করে সহজেই সরবরাহ করা যেতে পারে।

 

৩.২ সার প্রয়োগ:

দাশ (১৯৯৭) অনুসারে পোনা ছাড়ার পর প্রতি মাসে শতাংশ প্রতি ৩৫-৪০ কেজি গোবর ও সমান অনুপাতে ৬০০ গ্রাম হারে ইউরিয়া ও টিএসপি প্রয়োগ করতে হবে। রাসায়নিক সার মাটির সাথে মিশিয়ে দলা করে প্রয়োগ করলে ভাল ফল পাওয়া যায়।

 

৩.৩ মাছ আহরণ ও বাজারজাতকরণ:
কেবলমাত্র জাল দিয়ে এই মাছ আহরণ করতে গেলে ৪০-৫০ শতাংশ মাছ পুকুরেই থেকে যায়। তাই চূড়ান্ত আহরণের জন্য পুকুর শুকিয়ে মাছ আহরণ করা আবশ্যক। মাগুর মাছ ৮-১০ মাস ও শিং ৪-৬ মাসের মধ্যে ধরার উপযোগী হয় (হক, ২০০৬)। সাধারণত ১০০-১৫০ গ্রাম হলেই এই মাছ আংশিকভাবে আহরণের উপযোগী হয়।

উল্লেখিত ব্যবস্থাপনায় উচ্চ মজুদ ঘনত্বে বড় আকারের পোনা ছেড়ে এক শতাংশ আয়তনের পুকুর থেকে ছয়-আট মাসে ১৬-১৮ কেজি শিং/মাগুর মাছ পাওয়া সম্ভব। একইভাবে আংশিক আহরণের পর সমসংখ্যক পোনা পুনরায় মজুদ করার সম্ভব হলে একই আয়তনের পুকুর থেকে সারা বছরে ২৪-২৫ কেজি শিং/মাগুর মাছ পাওয়া সম্ভব।

 

কৃতজ্ঞতা:

 

তথ্যসূত্র:

  • দাশ বিষ্ণু, ১৯৯৭; মাৎস্য ও মাৎস্য সম্পদ ব্যবস্থাপনা, চতুর্থ খণ্ড; বাংলা একাডেমী, ঢাকা; পৃষ্ঠা ২৫-৪৫।
  • হক ইনামুল, ২০০৬; বাংলাদেশের ছোট মাছ: জীববৈচিত্র্য, চাষ ব্যবস্থাপনা, পুষ্টিমান ও প্রক্রিয়াজাতকরণ; গ্রাফিক্স সাইন, ময়মনসিংহ;  পৃষ্ঠা ৫৬-৫৭।
  • সিদ্দিকী, কামাল এবং চৌধুরী সমরেন্দ্র নাথ, ১৯৯৬; মৎস্য: পুকুরে মাছ চাষ ম্যানুয়েল; ন্যাশনাল ইনষ্টিটিউট অব লোকাল গভর্ণমেন্ট, ঢাকা; পৃষ্ঠা ২৯৬-৩০১।
  • মৎস্য অধিদপ্তর, ২০০২; মাছ চাষ ম্যানুয়াল; বাংলাদেশ মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়; পৃষ্ঠা ৬৯-৭০।

 


Visited 13,948 times, 2 visits today | Have any fisheries relevant question?
পুকুরে শিং-মাগুর মাছের চাষ ব্যবস্থাপনা

Visitors' Opinion

নিপা চাকী

শিক্ষার্থী, ফিশারীজ বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী-৬২০৫, বাংলাদেশ। বিস্তারিত

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.