বিভিন্ন ধরণের মাছের ত্বক (বাহির থেকে দৃষ্ট )
বিভিন্ন ধরণের মাছের ত্বক (বাহির থেকে দৃষ্ট )

সাধারণত মেরুদণ্ডীদের ত্বক (integument) চামড়া (Skin) নামে পরিচিত। অন্যভাবে বলা যায়, চামড়া বলতে কেবলমাত্র মেরুদণ্ডীদের ত্বকেই বোঝায়। মাছসহ অন্যান্য সকল মেরুদণ্ডীদের ত্বক গঠনগত দিক থেকে প্রায় একই রকম যদিও ত্বকোদ্ভূত অঙ্গের দিকে থেকে যথেষ্ট পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। যাই হোক, মেরুদণ্ডীদের ত্বক প্রধানত দুটি স্তর নিয়ে গঠিত। স্তর দুটি হল বাহিরের দিকে থেকে ভেতরের দিকে যথাক্রমে এপিডার্মিস (Epidermis) ও ডার্মিস (Dermis)। এছাড়াও ডার্মিসের নিম্নস্থ আরও একটি স্তর দেখতে পাওয়া যায় যা সাবকিউটেনিয়াস স্তর (Subcutaneous layer) বা হাইপোডার্মিস (Hypodermis) নামে পরিচিত। এপিডার্মিস ও ডার্মিস স্তর থেকে বিভিন্ন ধরণের অঙ্গের আবির্ভাব ঘটে যাকে ত্বকোদ্ভূত অঙ্গ (Integumentary derivatives) বলে। ত্বক ও ত্বকোদ্ভূত অঙ্গকে সম্মিলিতভাবে ত্বকতন্ত্র (Integumentary system) বলে। উপরিতলের আয়তন ও বিস্তৃতির উপর ভিত্তি করে মেরুদণ্ডীদের ত্বকতন্ত্রকে সবচেয়ে বড় অঙ্গতন্ত্র (Organ system) হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

 

এপিডার্মিস (Epidermis)

  • স্তরে স্তরে সজ্জিত এপিথেলিয়াম (Epithelium) কোষ নিয়ে গঠিত এপিডার্মিস স্তর হচ্ছে ত্বকের সবচেয়ে বাহিরের আবরণ এবং এর উৎপত্তি ভ্রূণীয় এক্টোডার্ম (Ectoderm) থেকে।
  • এপিডার্মিসে আবার দুটি অঞ্চল দেখতে পাওয়া যায়। যার একটি হচ্ছে- এপিডার্মিসের বাহিরের দিকে অবস্থিতি মৃত, নিউক্লিয়াস বিহীন ও চ্যাপ্টা স্কোয়ামাস (Squamous) কোষের একাধিক স্তর নিয়ে গঠিত স্ট্রাটাম কর্নিয়াম (Stratum corneum) এবং অন্যটি হচ্ছে- এপিডার্মিসের ভেতরের দিকে অবস্থিত জীবিত, নিউক্লিয়াস বিশিষ্ট ও এক স্তর স্তম্ভাকার (Columnar) কোষ নিয়ে গঠিত মালপিজিয়ান স্তর (Malpighian layer) বা স্ট্রাটাম জার্মিনেটিভাম (Stratum germinativum)।
  • স্ট্রাটাম কর্নিয়ামে কেরাটিন (Keratin) নামক আমিষ বর্তমান যা এ স্তর থেকে উদ্ভূত আঁইশ (Scale), স্কিউট (Scute), শিল্ড (Shield), চূড়া (Crest), কাঁটা (Spine), প্লেট (Plate), চঞ্চু (beak), পালক (Feather), নখর (Claw), শিং (Horn), নখ (Nail), ক্ষুর (Hoof), লোম বা চুল (Hair) ইত্যাদি গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। কেরাটিন সিস্টিন (Cystine) ও মিথাওনিন (Methionine) নামক অ্যামাইনো এসিড (Amino acid) সমৃদ্ধ যা পানিতে অত্যন্ত স্বল্পমাত্রায় দ্রবণীয় ফলে এ স্তরটি পানি অভেদ্য (Water proof) গুন বিশিষ্ট হয়ে থাকে।
  • স্ট্রাটাম জার্মিনেটিভাম স্তরটি একটি ভিত্তি পর্দার (Basement membrane) মাধ্যমে ডার্মিস থেকে আলাদাভাবে অবস্থান করে। এ স্তরের কোষগুলি প্রতিনিয়ত মাইটোসিস (Mitosis) কোষ বিভাজনের মাধ্যমে সংখ্যা বৃদ্ধি করে থাকে। সময়ের পরিবর্তনে এই কোষগুলি ধীরে ধীরে বাহিরের দিকে গমন করে, চ্যাপ্টা আকার ধারণ করে, কেরাটিন সমৃদ্ধ হতে থাকে এবং পরিশেষে নিউক্লিয়াস বিহীন হয়ে স্ট্রাটাম কর্নিয়াম গঠনে অংশ নেয়।
  • জলজ মেরুদণ্ডীদের এপিডার্মিস স্তরটি পাতলা ও শ্লেষ্মা গ্রন্থি (Mucous gland) সমৃদ্ধ হয়ে থাকে কিন্তু স্থলজ মেরুদণ্ডীদের ক্ষেত্রে স্তরটি পুরু হয়ে থাকে এবং এখান থেকেই আঁইশ (Scale), স্কিউট (Scute), শিল্ড (Shield), চূড়া (Crest), কাঁটা (Spine), প্লেট (Plate), চঞ্চু (beak), পালক (Feather), নখর (Claw), শিং (Horn), নখ (Nail), ক্ষুর (Hoof), লোম বা চুল (Hair) ইত্যাদি অঙ্গের উদ্ভব ঘটে।

 

ডার্মিস (Dermis)

  • এপিডার্মিসের নীচে অবস্থিত পুরু, নমনীয় ও স্থিতিস্থাপক স্তরটিই হচ্ছে ডার্মিস বা করিয়াম (Corium) যা ভ্রূণীয় মেসোডার্ম (Mesoderm) থেকে উৎপত্তি লাভ করে এবং তন্তুময় যোজক কলা (Fibrous connective tissue) নির্মিত ।
  • এ স্তরেই রক্ত জালিকা (Blood capillaries), লিম্ফ নালিকা (Lymph vessel), স্নায়ু তন্তু (Nerve fibre), স্থিতিস্থাপক তন্তু (Elastic fibre), অনুভূতি অঙ্গ (Sense organ) ইত্যাদি পরিলক্ষিত হয়।
  • ডার্মিসে সঞ্চিত খাদ্য হিসেবে চর্বি (Fat) দেখতে পাওয়া যায় যা এডিপোসাইট (Adipocyte) নামক কোষ এবং এডিপোস টিস্যু (Adipose tissue) নামক কলা গঠন করে।
  • স্তন্যপায়ীদের সিবাসিয়াস গ্রন্থি (Sebaceous gland), স্বেদ বা ঘর্ম গ্রন্থি (Sweat gland), লোমের ফলিকল (Hair follicle) ইত্যাদি প্রকৃতপক্ষে এপিডার্মিসের অংশ হলেও এদের মূল (Root) ডার্মিসে অনুপ্রবেশ করে।
  • বেশিরভাগ প্রাণীদের ডার্মিসে রঞ্জক কোষ (Pigment cell) দেখতে পাওয়া। স্তন্যপায়ীদের অন্যতম রঞ্জক কোষ হচ্ছে মেলানোফোর (Melanofore) বা মেলানোসাইট (Melanocyte) যা মেলানিন (Melanin) উৎপন্ন করে যা ত্বকের কালো বর্ণের জন্য দায়ী।

 

সাবকিউটেনিয়াস স্তর (Subcutaneous layer) বা হাইপোডার্মিস (Hypodermis)

  • অনেক মেরুদণ্ডীদের এপিডার্মিসে ও ডার্মিসের নীচে আরও একটি স্তর দেখতে পাওয়া যায় যা সাবকিউটেনিয়াস স্তর (Subcutaneous layer) বা হাইপোডার্মিস (Hypodermis) নামে নামে পরিচিত।
  • ভ্রূণীয় মেসোডার্ম (Mesoderm) থেকে উৎপত্তি হওয়া এই স্তরটি অ্যারিওলার কলা (Areolar tissue) ও এডিপোস কলা (Adipose tissue) নির্মিত।

 

মাছ ও অন্যান্য মেরুদণ্ডী প্রাণীর ত্বকোদ্ভূত  অঙ্গ:

মাছ ও অন্যান্য মেরুদণ্ডী প্রাণীর ত্বক থেকে উৎপত্তি লাভকারী অঙ্গসমূহের মধ্য অন্যতম হচ্ছে বিভিন্ন ধরণের বিশেষায়িত কোষ, কলা, গ্রন্থি, আঁইশ (Scale), স্কিউট (Scute), শিল্ড (Shield), চূড়া (Crest), কাঁটা (Spine), প্লেট (Plate), চঞ্চু (beak), পালক (Feather), নখর (Claw), শিং (Horn), নখ (Nail), ক্ষুর (Hoof), লোম বা চুল (Hair) ইত্যাদি।  একই প্রাণীতে বা একটি প্রাণী গোষ্ঠীর সকল প্রাণীতে উল্লেখিত অঙ্গসমূহ উপস্থিত থাকে না। বিভিন্ন প্রাণীতে বিভিন্ন ত্বকোদ্ভূত অঙ্গের উপস্থিতি মেরুদণ্ডীদের বৈচিত্র্যময় কর তুলেছে। যাই হোক, প্রাণী ভেদে এরসব অঙ্গ হয় এপিডার্মিস থেকে নতুবা ডার্মিস স্তর থেকে উদ্ভূত হয়ে থাকে। অনেক অঙ্গ আলাদা আলাদা ভাবে উভয় স্তর থেকেই উৎপন্ন হয়ে থাকে। আবার অনেক অঙ্গের ক্ষেত্রে দেখা যায় নিচের স্তরটি ডার্মিস নির্মিত এবং উপরের স্তরটি এপিডার্মিস নির্মিত, যেমন কচ্ছপের খোলক। অনেক অঙ্গ প্রকৃতপক্ষে এপিডার্মিস নির্মিত হলেও এর মূলটি ডার্মিসে অনুপ্রবেশ করে বা  গ্রন্থিত থাকে, যেমন- স্তন্যপায়ীদের লোম। নিচের সারণীতে মাছ ও অন্যান্য মেরুদণ্ডী প্রাণীর ত্বকোদ্ভূত গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গের একটি তালিকা দেয়া হল।

প্রাণী গোষ্ঠী এপিডার্মিস (Epidermis) উদ্ভূত অঙ্গ ডার্মিস (Dermis) উদ্ভূত অঙ্গ
চোয়ালহীন মাছ (Cyclostomes) শ্লেষ্মা কোষ (Mucous cell) রঞ্জক কোষ (Pigment cell)
মাছ (Fish) গবলেট কোষ (Goblet cell) বা শ্লেষ্মা কোষ (Mucous cell), বিষ গ্রন্থি (Poison gland), লবণ গ্রন্থি (Salt gland), আলোক গ্রন্থি (Luminescent gland) বা ফটোফোর (Photophores) ক্রোমাটোফোর (Chromatophores) ও ইরিডোফোর (Iridophores) নামক রঞ্জক কোষ (Pigment cell), বিভিন্ন ধরণের আঁইশ যথা – কসময়েড (Cosmoid), প্লাকয়েড (Placoid), গ্যানয়েড (Ganoid), সাইক্লয়েড (Cycloid) ও টিনয়েড (Ctenoid), পাখনা রশ্মি (Fin ray), ত্বকীয় সংবেদন অঙ্গ (Cutaneous sense organ)
উভচর (Amphibians) শ্লেষ্মা গ্রন্থি (Mucous gland), বিষ গ্রন্থি (Poison gland) ক্রোমাটোফোর (Chromatophores) নামক রঞ্জক কোষ (Pigment cell), উষ্ণ অঞ্চলের ব্যাঙ (Tropical toad) ও কিছু অ্যাপোডাতে (Apoda) ওস্টিওডার্ম (Osteoderm) নামক ডার্মাল স্কেল বা অস্থিময় প্লেট বর্তমান।
সরীসৃপ (Reptiles) ফিমোরাল গ্রন্থি (Femoral gland) ও মাস্ক গ্রন্থি (Musk gland) নামক গন্ধ গ্রন্থি (Sent gland), লবণ গ্রন্থি (Salt gland), আঁইশ (Scale), স্কিউট (Scute), শিল্ড (Shield), চূড়া (Crest), কাঁটা (Spine), প্লেট (Plate), শৃঙ্গায়িত চঞ্চু (Horny beak), নখর (Claw), র‍্যাটল (Rattle), Horned toad নামক এক ধরণের টিকটিকির শিং (Horn) ক্রোমাটোফোর (Chromatophores) নামক রঞ্জক কোষ (Pigment cell), কিছু টিকটিকিতে আঁইশ (Scale), কুমিরে ডিম্বাকার অস্থিময় প্লেট (Bony plate), কচ্ছপে ওস্টিওডার্ম (Osteoderm) নামক ডার্মাল স্কেল বা অস্থিময় প্লেট বর্তমান যা এপিডার্মাল আঁইশ বা প্লেটের ঠিক নিচেই অবস্থান করে।  এপিডার্মাল ও ডার্মাল আঁইশ বা প্লেটই সম্মিলিতভাবে পৃষ্ঠ দিকের ক্যারাপেজ (Carapace) অঙ্কীয় দিকের প্লাসট্রোন (Plastron) গঠন করে)
পাখি (Birds) পালক (Feather), চঞ্চুর (Beak) অংশ বিশেষ, নখর (Claw), আঁইশ (Scale), লবণ গ্রন্থি (Salt gland), ইউরোফাইজিয়াল গ্রন্থি (Uropygial gland) বা প্রিন গ্রন্থি (Preen gland)
স্তন্যপায়ী (Mammals) ঘর্ম গ্রন্থি (Sweat or Sudoriferous gland), তৈল গ্রন্থি (Sebaceous gland), গন্ধ গ্রন্থি  (Scent gland), মোম গ্রন্থি (Wax gland),  অশ্রু গ্রন্থি (Lacremal gland), স্তন্য গ্রন্থি (Mammary gland), লোম বা চুল (Hair), আঁইশ (Scale), শিং (Horn), নখ (Nail), নখর (Claw), ক্ষুর (Hoof), আর্মাডিলোর (Armadillos) প্লেট ও ব্যান্ড (Plate and Band) মেলানোসাইট (Melanocyte) নামক রঞ্জক কোষ (Pigment cell), কেবলমাত্র আর্মাডিলো (Armadillos) ও তিমিতে ওস্টিওডার্ম (Osteoderm) নামক ডার্মাল স্কেল তথা অস্থিময় প্লেট দেখতে পাওয়া যায়। আর্মাডিলোর (Armadillos) ওস্টিওডার্ম (Osteoderm) প্লেট এপিডার্মাল প্লেট ও ব্যান্ডের ঠিক নিচেই অবস্থান করে।

 

লোম বিশিষ্ট ও লোম বিহীন স্তন্যপায়ীর ত্বকের বিভিন্ন স্তর
লোম বিশিষ্ট ও লোম বিহীন স্তন্যপায়ীর ত্বকের বিভিন্ন স্তর *

*Photo source: Madhero88, wikipedian, en.Wikipedia.org  (This file is licensed under the Creative Commons Attribution-Share Alike 3.0 Unported license.)


Visited 2,504 times, 1 visits today | Have any fisheries relevant question?
মাছ ও অন্যান্য মেরুদণ্ডী প্রাণীর ত্বক: গঠন ও ত্বকোদ্ভূত অঙ্গ

Visitors' Opinion

এ বি এম মহসিন

প্রফেসর, ফিশারীজ বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী-৬২০৫, বাংলাদেশ। বিস্তারিত ...

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.