উপকূলীয় এলাকায় বিশেষত মেঘনায় চিংড়ির পোনা ধরা নিষিদ্ধ হলেও চিংড়িচাষিদের কাছে এর ব্যাপক চাহিদা (মেঘনার চিংড়ির পোনা অল্প সময়ে বিক্রির উপযুক্ত হয় বলে এর কদর বেশি) থাকায় অবৈধভাবে চিংড়ি পোনা শিকার চলছে। এর সাথে যেমন জড়িয়ে রয়েছে জলজ জীববৈচিত্র্যের ভবিষ্যত, তেমনি রয়েছে বড় ধরণের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড।

কেবলমাত্র লক্ষ্মীপুরের রায়পুর উপজেলার মেঘনা নদী ও সংযোগ খাল থেকে মৌসুমে (চৈত্র থেকে জ্যৈষ্ঠ মাস) প্রায় দেড় শ কোটি টাকার গলদা চিংড়ির পোনা ধরা হয়। মেঘনাপাড়ের প্রায় ১০ হাজার জেলে চিংড়ির পোনা সংগ্রহের সাথে জড়িত [১]।
অন্যদিকে চাঁদপুরের হাইমচর থেকে রামগতির আলেকজান্ডার পর্যন্ত প্রায় এক শ কিলোমিটার দীর্ঘ মেঘনা এবং এর সংযোগ খাল গলদা চিংড়ির পোনার বিচরণক্ষেত্র। রায়পুর উপজেলার প্রায় ৪০ কিলোমিটার মেঘনাপাড়ের জেলেরা মশারি, জাল, ছাঁকনি ও চাদর দিয়ে পোনা শিকার করেন। একজন জেলে দিনে এক শ থেকে দুই হাজার পোনা ধরতে পারেন [১]। ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট অগ্রিম দাদন খাটিয়ে চিংড়ি পোনা আহরণ নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। অভিযোগ আছে, আহরিত পোনা সিন্ডিকেট নির্ধারিত দামেই নির্দিষ্ট দাদন ব্যবসায়ীর কাছে বিক্রি করতে বাধ্য করা হচ্ছে। ফলে সঠিক দাম না পাওয়ার কষ্টকর বেদনার ভুক্তভোগী আহরণকারী সকল আবালবৃদ্ধবনিতা [৪]।

চিংড়ির পোনাকে কেন্দ্র করে মেঘনাপারের হাজিমারা, পানিরঘাট, নতুন ব্রিজ ও বালুরচরে আড়ত গড়ে উঠেছে। প্রতিদিন হাট বসে এসব এলাকায়। মৌসুমে তিন মাস চিংড়ির ব্যবসা হয়। এ ব্যবসায় একজন ব্যবসায়ী-ই লেনদেন করে থাকেন ৬০ থেকে ৭০ লাখ টাকা [১]। মাছ ঘাট সূত্র জানায়, প্রতি একশত গলদা চিংড়ি রেণু এক’শ টাকা এক’শ ত্রিশ টাকা আর খুলনা, বাগেরহাটে একশ সত্তর থেকে একশ আশি টাকা দরে বিক্রি হয়ে থাকে। খুলনা বাগেরহাট, কক্সবাজার ও চট্রগ্রামসহ দেশের বিভিন্নস্থানে কোটি কোটি টাকার এসব রেণু পাইকাররা নিয়ে যায় [৪]।

মশারি দিয়ে নদীর পানি ছেঁকে পোনা ধরার সময় চিংড়ি ছাড়াও বিভিন্ন প্রজাতির মাছের পোনা ও ডিম জালে ওঠে। চিংড়ির পোনা বাছাইয়ের পর সময়ই অন্য মাছের ডিম ও পোনার অধিকাংশই নষ্ট হয়ে যায়। এভাবে পোনা নিধন অব্যাহত থাকলে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ বিলুপ্ত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দেবে। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের (পাইকগাছা নোনা পানি গবেষণা কেন্দ্র) তথ্য মতে, খুলনার পাইকগাছা ও তৎসংলগ্ন এলাকায় একটি বাগদার পোনা আহরণে ১১৯টি চিংড়ি প্রজাতির পোনা, ৩১২ প্রজাতির প্রাকৃতিক খাবার (প্লাঙ্কটন) ও ৩১টি সাদা মাছ প্রজাতির পোনা ধ্বংস হয়ে থাকে [২,৩]। উপকূলের অন্যান্য এলাকায় একটি পোনা ধরতে গিয়ে ৪৬টি চিংড়ি প্রজাতি, ৩৫টি জুপ্লাঙ্কটন প্রজাতি ও ১১টি সাদা মাছ প্রজাতির পোনা ধ্বংস হচ্ছে [৬]।

চট্টগ্রাম, কক্সবাজার সমুদ্র উপকূলে ৯০ হাজার নারী-পুরুষ-শিশু কোন ধরনের নিয়মনীতি না মেনে সমূদ্র থেকে উজানের পানিতে নিষিদ্ধ নানা সরঞ্জাম ব্যবহার করে বাগদা চিংড়ি পোনা আহরণের নামে হাজার কোটি টাকা মূল্যমানের বিভিন্ন জাতের মূল্যবান মাছের রেনু পোনা ধ্বংস করছে। প্রাকৃতিক উৎস থেকে একটি চিংড়ি পোনা আহরণ করতে গিয়ে আহরণকারীরা নষ্ট করছে ক্ষুদ্র নানা প্রজাতির অণুজীব ছাড়াও প্রায় ৪০০ অন্যান্য মাছের পোনা। প্রতি বছর প্রাকৃতিক উৎস থেকে সারাদেশে দুই কোটি পোনা সংগ্রহ হয়ে থাকে। ফলে চিংড়ি পোনা আহরণের সময় সহস্রাধিক কোটি মাছের পোনা ধ্বংস হচ্ছে [৫]।

উপরোক্ত তথ্যাদি থেকে প্রতীয়মান হয় যে মূলত চিংড়ি পোনার চাহিদা ও এর সাথে অর্থনৈতিক বিষয়টি জড়িত থাকায় অবৈধ জেনেও বঙ্গোপসাগর, উপকূলীয় এলাকা যেমন- সুন্দরবন ও মেঘনা নদী ইত্যাদি স্থানে ব্যাপকভাবে চিংড়ি পোনা আহরণ চলছে। এই পোনা আহরণে ধ্বংস হচ্ছে বিশাল পরিমান জলজ জীবের পোনাও যার প্রভাব সরাসরি পড়ছে জলজ জীববৈচিত্র্যের উপর। যেহেতু আইন করে আর অভিযান চালিয়ে এটি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হচ্ছে না সেহেতু এর পাশাপাশি বিকল্প পন্থাসমূহ কি হতে পারে তা এখনই ভেবে দেখা প্রয়োজন। প্রয়োজন সচেতনা বাড়ানোর জন্য কার্যকর কৌশল গ্রহণের আর অর্থনৈতিক বিষয়টিকে বিবেচনায় নিয়ে বিকল্প কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করার মাধ্যমে এই ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড কমানো সম্ভব কিনা তাও ভেবে দেখা দরকার।

তথ্যসূত্রঃ


Visited 415 times, 1 visits today | Have any fisheries relevant question?
উপকূলীয় এলাকায় অবৈধভাবে চিংড়ির পোনা আহরণঃ হুমকিতে জলজ জীববৈচিত্র্য

Visitors' Opinion

এ বি এম মহসিন

প্রফেসর, ফিশারীজ বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী-৬২০৫, বাংলাদেশ। বিস্তারিত ...

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.