যে কোন জীবন্ত প্রাণীর ভাল মানের ছবি তোলা যেমন কষ্টসাধ্য তেমন সময়সাপেক্ষ একটি বিষয়। জীবন্ত প্রাণীটি যদি দেশীয় প্রজাতির ছোট মাছ হয়ে থাকে তাহলে কষ্ট ও সময়ের পরিমাণ আরও বেড়ে যায় তা নিশ্চিত করে বলা যায়। এর বেশকিছু কারণ রয়েছে। সাধারণত এ্যাকুয়ারিয়ামে পালনের জন্য বাহারী মাছের দোকান তথা বাজারে দেশীয় ছোট মাছের খুব কম সংখ্যক প্রজাতিই কিনতে পাওয়া যায়। তাই বাজারের বা বাড়ির এ্যাকুয়ারিয়াম থেকে এসব মাছের ছবি তোলার তেমন সুযোগ নেই। আর মাছ বাজারে সাধারণত দেশীয় প্রজাতির জীবন্ত ছোট মাছ পাওয়া যায় কম। মৎস্যজীবীরা/মাছ ব্যাপারীরা বাজারে আনতে আনতে এরা মারা যায়। যেগুলো জীবিত থাকে সেগুলোও বেশ কাহিল হয়ে পড়ে। ফলে এ্যাকুয়ারিয়াম বা কাঁচের বাক্সে রেখে ছবি তুলতে গেলে এদের স্বাভাবিক গতিবিধি থাকে না। এজন্য সাধারণত এদের ছবি তোলার জন্য সরাসরি বিল, পুকুর, খাল, নদী বা হাওর যেখানে মৎস্যজীবী মাছ ধরে সেখানে যাওয়ার প্রয়োজন হয়। মৎস্যজীবী মাছ ধরার সাথে সাথে তা সংগ্রহ করে ছবি তুললে ভাল ফল পাওয়া যায়। আর এর ছবি তুলতে হলে কারিগরি কিছু বাড়তি কৌশল ও জানা থাকা প্রয়োজন হয়। নিচে দেশীয় প্রজাতির ছোট মাছের জীবন্ত ছবি তোলার কিছু কলা-কৌশল সম্পর্কে আলোচনা করা হল।
প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি
- ক্যামেরা
ভাল ছবি তোলার জন্য এসএলআর /ডিএসএলআর এর বিকল্প নেই। ডিএসএলআর ক্যামেরা হলে সবচেয়ে বেশী সুবিধা পাওয়া যায়। সাধারণত ক্যানন, নাইকন বা অন্য কোন ব্রান্ডের এন্ট্রি লেভেলের ডিএসএলআর ক্যামেরা অপেক্ষাকৃত কম দামে পাওয়া যায় এবং এগুলো দিয়ে ভালভাবে কাজ চালিয়ে নেওয়া যায়। তাছাড়া পয়েন্ট এন্ড শুট ক্যামেরা দিয়েও কাজ চলে, তবে ম্যানুয়াল সেটিংস এর সুবিধা সম্বলিত পয়েন্ট এন্ড শুট ক্যামেরাই এ ক্ষেত্রে ব্যবহার করা সুবিধাজনক।
- লেন্স
ছোট মাছের ছবি তুলতে হলে ম্যাক্রো লেন্স ব্যবহার করাই উত্তম। সাধারণত 60 থেকে 100 মিলিমিটারের মধ্যে কোন ম্যাক্রো লেন্স ব্যবহার করা যেতে পারে।
- এ্যাকুয়ারিয়াম বা কাঁচের বাক্স
আগেই বলা হয়েছে সরাসরি বিল, পুকুর, খাল, নদী বা হাওর যেখানে মৎস্যজীবী মাছ ধরে সেখানে যেয়ে ছবি তুললে ভাল ফল পাওয়া যায়, এজন্য খুব বেশী বড় এ্যকুয়ারিয়াম নিয়ে গন্তব্যস্থলে যাওয়া কষ্টসাধ্য। কাজেই 5-6 ইঞ্চি লম্বা, 2-3 ইঞ্চি চওড়া ও 2-4 ইঞ্চি উচ্চতার এ্যাকুয়ারিয়াম বা কাঁচের বাক্স হলে ভাল হয়। তবে মাছের সাইজ অনুযায়ী কাঁচের বাক্সের আকার ছোট বড় করা যেতে পারে। লক্ষণীয় সাদা রংয়ের পাতলা কাঁচ দিয়ে বাক্স তৈরি করলে ছবির মান ভাল পাওয়া যাবে।
- অন্যান্য যন্ত্রপাতি বা উপকরণ
পরিষ্কার পানি/মিনারেল ওয়াটার বোতল, গামলা, টিস্যু পেপার, নুড়ি পাথর, স্কুপ নেট/বড় চামচ ও কাঁচের বাক্সের ঢাকনা।
কখন ছবি তুলবেন
- সাধারণত সকালের দিকে (সকাল ৮টা-৯টা) বা পড়ন্ত বিকালে (৪টা-৫টা) ছবি তুললে ভাল হয়।
- তবে মধ্যাহ্নে অনেক সময় মৎস্যজীবীরা মাছ ধরে। তখন ছাতা ব্যবহার করেও কাজ চালানো যেতে পারে ।
ক্যামেরা সেটিংস
- ছবি তোলার ক্ষেত্রে ক্যামেরা সেটিংস খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। বিভিন্ন প্রজাতির ছোট মাছ এ্যাকুরিয়ামে অনেক বেশী দৌড়াদৌড়ি করে, আবার কোনটি অপেক্ষাকৃত শান্ত প্রকৃতির। বেশী চঞ্চল মাছের ক্ষেত্রে ক্যামেরা সেটিংস ঠিক না থাকলে ছবিতে ব্লার (Blur) আসতে পারে। আবার উপস্থিত আলোর সাথেও ক্যামেরা সঠিকভাবে সেটিংস না হলে ছবি কালো হতে পারে।
- ডিএসএলআর ক্যামেরার ক্ষেত্রে সাধারণত এ্যাপারচার মোডে ক্যামেরা সেট করে এ্যপারচার ভেল্যু f/8 থেকে f/12 রাখা যেতে পারে। সেক্ষেত্রে এক্সপোজার টাইম এর দিকেও খেয়াল রাখতে হবে। এক্সপোজার টাইম 1/200s থেকে 1/800 এর মধ্যে থাকলে চলবে। এক্সপোজার টাইম এর চেয়ে বেশী হলে আইএসও বাড়িয়ে দেওয়া যেতে পারে। প্রয়োজন অনুযায়ী আইএসও স্পীড 100 থেকে 400 পর্যন্ত রাখা যেতে পারে। ডিসপ্লেতে ছবি দেখে প্রয়োজনমত সেটিংস পরিবর্তন করতে হবে।
- পয়েন্ট এন্ড শুট ক্যামেরায় ম্যানুয়াল সেটিংস এর মাধ্যমে অনুরূপ ভাবে ক্যামেরা সেট করা যেতে পারে। ম্যাক্রো ছবি তোলার ক্ষেত্রে ক্যামেরার কন্টিনিউয়াস শুটিং অপশন কাজে লাগালে ভাল ফল পাওয়া যায়। এই পদ্ধতিতে ক্যামেরা প্রতি সেকেন্ডে তিন-চারটি ছবি তুলতে পারে এবং এর মধ্য থেকে যে কোন একটি ভাল ছবি বের হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
- রোদের মধ্য অনেক সময় ডিসপ্লেতে ছবির আসল কনট্রাস্ট বোঝা যায় না। ছাতার নিচে ক্যামেরা নিয়ে বা হাত দিয়ে ছায়া দিয়ে খেয়াল করতে হবে এবং সে অনুযায়ী ক্যামেরা সেটিংস ঠিক করতে হবে।
যেভাবে ছবি তুলবেন
- মাছের ছবি তুলতে সাথে একজন সহযোগী থাকা প্রয়োজন হয়। একাকী সবকিছু করে ছবি তোলা বেশ কষ্টসাধ্য ব্যাপার।
- প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম নিয়ে উপযুক্ত সময়ে মৎস্যজীবীর কাছে যেতে হবে। তার সাথে আলোচনা সাপেক্ষে মাছ ধরা পড়ার সাথে সাথে তা সংগ্রহ করে গামলায় পানি নিয়ে সেখানে মাছ রাখতে হবে।
- সাধারণত যেসব সরঞ্জামে মাছ আহত না হয় এমন সরঞ্জাম দিয়ে ধৃত মাছ সংগ্রহ করাই উত্তম; যেমন, ঠেলা জাল, কোনা জাল ইত্যাদি। এসব সরঞ্জাম থেকে ধৃত মাছ সাবধানে স্কুপ নেট বা চামচ দিয়ে সংগ্রহ করতে হবে যেন আহত না হয় বা গায়ের আঁইশ না উঠে যায়।
- এরপর কাঁচের বাক্সে মিনারেল ওয়াটার বোতল থেকে পানি ঢালতে হবে। পানিতে মাছের ধরন অনুযায়ী তার আবাসস্থলের সাথে সামঞ্জস্য রেখে কিছু জলজ শ্যাওলা বা নুড়ি পাথর দেওয়া যেতে পারে। তবে জলজ শ্যাওলার গায়ে যদি অনেক ময়লা থাকে তাতে কাঁচের বাক্সের পানি ঘোলা হয়ে যেতে পারে। এজন্য সেগুলো ভাল করে ধুয়ে তারপর কাঁচের বাক্সে দিতে হবে।
- এরপর একটি বা কয়েকটি মাছ সাবধানে স্কুপনেট বা চামচ দিয়ে গামলা থেকে কাঁচের পাত্রে নিতে হবে। কাঁচের বাক্সের গায়ে পানি বা ময়লা লাগলে তা টিস্যু পেপার দিয়ে মুছে সহযোগীর হাতে কাঁচের বাক্স দিয়ে ছবি তুলতে হবে।
- কাঁচের বাক্সে জলজ শ্যাওলা না দিয়েও সবুজ কোন আগাছার পাশে কাঁচের বাক্সটি ধরে ছবি তুললে সবুজ রংয়ের ব্যাকগ্রাউন্ড/Bokeh পাওয়া যায়।
- অবশ্যই সূর্যের বিপরীত দিকে ক্যামেরার মুখ রেখে ছবি তুলতে হবে।
- ছবি তোলার সময় ফ্ল্যাশ ব্যবহার করা যাবে না।
- ফোকাসিং এর ক্ষেত্রে সবসময় মাছের চোখে ফোকাসিং পয়েন্ট রাখার চেষ্টা করতে হবে।
- ব্যাকগ্রাউন্ডে যাতে হাতের আঙ্গুল না আসে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
সাবধানতা
- নৌকায় করে মৎস্যজীবীর কাছে গেলে ঢেউয়ে নৌকা দুলতে থাকে। সেক্ষেত্রে মৎস্যজীবীর কাছ থেকে মাছ সংগ্রহ করে দ্রুত পাড়ে এসে কাজ সারতে হবে।
- মাছের লাফালাফির কারণে ক্যামেরা লেন্স বা ক্যামেরার গায়ে পানি লাগতে পারে। এজন্য সাবধানে ক্যামেরা সামলাতে হবে। পানি লাগলে টিস্যু পেপার দিয়ে দ্রুত পানি মুছে ফেলতে হবে।
- অনেক সময় হাত ফসকে ক্যামেরা পড়ে যেতে পারে, সেজন্য অবশ্যই ক্যামেরার ফিতা গলায় ঝুলাতে হবে।
ছবি প্রসেসিং
- ছবি তোলার পর ফটোশপ, লাইটরুম কিংবা অন্যান্য ফটো এডিটিং সফটওয়্যারের সাহায্যে ছবির প্রয়োজনীয় এডিটিং (ক্রপিং, ব্রাইট, কনট্রাস্ট ইত্যাদি) করলে ছবি আরও সুন্দর ও জীবন্ত দেখাবে।
Visited 5,416 times, 1 visits today | Have any fisheries relevant question?