ভূমিকা:
গ্রীষ্ম ও বর্ষাকালে মাছচাষিরা মাছের যে সব রোগ-বালাই নিয়ে আতঙ্কিত থাকেন তার মধ্যে লার্নিয়াসিস অন্যতম। এটি মাছের বহিঃপরজীবীঘটিত একটি রোগ। গ্রীষ্মকালে সাধারণত স্রোতহীন জলাশয়ে প্রচুর পরিমাণে পরজীবীর আধিক্যের ফলে এ রোগের সংক্রমণ ঘটতে দেখা যায়। এ পরজীবী মাছের দেহে চোষকের সাহায্যে লেগে থেকে রক্ত খায়। ফলে মাছ দুর্বল হয়ে পড়ে এমনকি রোগে আক্রান্ত হয়ে মারাও যেতে পারে। তবে এ রোগ নিয়ে আতঙ্কিত না হয়ে সচেতন হওয়াই একজন সফল মাছচাষির বৈশিষ্ট্য। কারণ সহজেই এ রোগ চিহ্নিত করে প্রতিকার করা যায়।
পরজীবী পরিচিতি:
Arthropoda পর্বের Crustacea শ্রেণি ভুক্ত Lernaea sp.দ্বারা এ রোগ সংঘটিত হয়ে থাকে।
এই পরজীবীটির মস্তক অঞ্চল দেখতে অনেকটা নোঙ্গরের মতো হওয়ায় একে নোঙ্গর পরজীবী (Anchor worm) নামে অভিহিত করা হয়। এই পরজীবীর শ্রেণীতাত্ত্বিক অবস্থান নিম্নরূপ-
Phylum – Arthropoda
Class – Crustacea
Subclass – Copepoda
Order – Cyclopodia
Family – Lernaeidae
Genus – Lernaea
Species – Lernaea sp
এই গণের অধীনে এ পর্যন্ত ১১০টির মতো প্রজাতির সন্ধান পাওয়া গেছে। এর মধ্যে Lernaea cyprinacea নামক প্রজাতিটি সমগ্র পৃথিবী জুড়ে বিস্তৃত। এ প্রজাতির পরজীবী দ্বারা সাধারণ রুই জাতীয় মাছ যেমন- রই, কাতলা, মৃগেল, গ্রাস-কার্প,কমন-কার্প ইত্যাদি মাছ আক্রান্ত হয়ে থাকে। এছাড়াও ক্যাটফিশ যেমন শিং-মাগুর, কৈ,গোল্ডফিশ প্রভৃতি মাছও আক্রান্ত হয়ে থাকে।
রোগের লক্ষণ:
যে সব লক্ষণ দেখে এ রোগ সহজেই সনাক্ত করা যায় –
- আকৃতিগত দিক থেকে এ রোগের পরজীবী (Lernaea sp) দণ্ডকার এবং মাথায় নোঙ্গরের মতো উপাঙ্গ বিদ্যমান যার মাধ্যমে এরা মাছের দেহের যে-কোন স্থানে বিশেষ করে বহিঃত্বক বিশেষত কানকো ও পাখনার গোঁড়া নিকটে এবং ফুলকায় লেগে থাকে এবং মাছের রক্ত শোষণ করে গ্রহণ করে বেঁচে থাকে।
- আক্রমণের ধারা হিসাবে এরা সম্মুখভাগের নোঙ্গর উপাঙ্গ পোষকের দেহের অভ্যন্তরে প্রবেশ করিয়ে দিয়ে আটকে থাকে এবং পশ্চাতের অংশ মাছের দেহের সাথে ঝুলতে থাকে যা বাইরে থেকে সহজেই প্রতীয়মান হয়।
- এ ধরণের পরজীবীর আক্রমণে কখনো কখনো মাছ জলাশয়ের কোন শক্ত বস্তুর সাথে গা ঘসতে থাকে।
- মাছ দুর্বল ও রোগাক্রান্ত হয়ে পড়ে,বৃদ্ধি কমে যায় এবং ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে।
- আক্রান্ত স্থানে ব্যাকটেরিয়া ও ছত্রাকের আক্রমণ পরিলক্ষিত হয়।
নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি:
এ পরজীবীর থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য প্রতিরোধ ও প্রতিকার উভয় ব্যবস্থাই অবলম্বন করা যায়। তবে আমরা জানি প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ করতে পারলেই ভালো। কেন না প্রতিকার করতে গেলে তার আগেই কিছু ক্ষতি সাধিত হয়ে যেতে পারে।
প্রতিরোধ:
- সাধারণত মাছের হ্যাচারিতে এ পরজীবীর প্রাদুর্ভাব সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। তাই হ্যাচারি থেকে বা পোনা বিক্রেতার কাছ থেকে পোনা কেনার সময় ভালো ভাবে দেখে নিতে হবে যে এই পরজীবীর উপস্থিতি রয়েছে কিনা।
- পোনা ছাড়ার আগে শোধন করে নিতে হবে। লার্নিয়া পরজীবী আক্রান্ত পোনা মজুদের পূর্বে ১০-২০ পিপিএম মাত্রার পটাশিয়াম পার ম্যাঙ্গানেট এর দ্রবণে ১.৫-২ ঘণ্ট গোসল করিয়ে পুকুরে ছাড়তে হবে।
- মাছ ধরার কাজে ব্যবহৃত জাল এক পুকুর থেকে অন্য পুকুরে ব্যবহারের পূর্বে শোধন করে ও ভালো ভাবে শুকিয়ে ব্যবহার করতে হবে।
- এছাড়াও পুকুরের সার্বিক পরিবেশ সঠিক রাখতে পারলে মাছের রোগাক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা অনেক কমে যায়।
প্রতিকার:
বর্তমানে বাজারে বিভিন্ন ধরণের ওষুধ পাওয়া যায় যা পুকুরের পানিতে ব্যবহারের মাধ্যমে সহজেই এ পরজীবীর হাত থেকে মাছকে মুক্ত করা যায়। নিচে এমন কয়েকটি প্রতিকার ব্যবস্থা আলোচনা করা হল –
- এই পরজীবীর নিয়ন্ত্রণে আর্গুলেক্স (EON কোম্পানির বাজারজাতকৃত) নামক ওষুধটি সর্বাধিক কার্যকর ও দ্রুত রোগ নিরাময়ে কাজ করে। প্রতি শতাংশে প্রতি ফুট পানির গভীরতার জন্য ৮-১০ মিলি লিটার হারে ৭ দিন পর পর আর্গুলেক্স প্রয়োগ করলে এ পরজীবীর হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।
- ডিপটরেক্স ০.২ থেকে ০.৫ পিপিএম মাত্রায় এক সপ্তাহ পর পর মোট তিন বার পুকুরে প্রয়োগ করা যেতে পারে।
- শূক অবস্থার পরজীবী দমনের জন্য ডায়ালক্স ০.২৫-০.৫ মাত্রায় এক সপ্তাহ পর পর ৫ বার পুকুরের পানিতে প্রয়োগ করলে ভালো ফল পাওয়া যায়। তাপমাত্রা ২৯০সে.এর উপরে হলে ওষুধের মাত্রা ১.০ পিপিএম করতে হবে।
- গ্যামাক্সিন এর দ্রবণ ১.০ পিপিএম মাত্রায় পুকুরের পানিতে প্রয়োগ করা যেতে পারে।
- আক্রান্ত মাছকে ৫ পিপিএম পটাশিয়াম পার ম্যাঙ্গানেট এর দ্রবণে ৩ মিনিট গোসল করালেও এ জীবাণুর হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।
- আক্রান্ত মাছকে ৩-৫% সাধারণ লবণ দ্রবণে ১ মিনিট অথবা মাছ যতক্ষণ সহ্য করতে ততক্ষণ গোসল করিয়েও এ পরজীবীর হাত থেকে রক্ষা পাওয়াযায়।
পরিশেষ:
এ পরজীবী দ্বারা মাছ আক্রান্ত হলে ভয় না পেয়ে দ্রুত কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে মাছকে রোগ মুক্ত করে আর্থিক ক্ষতির হাত থেকে মাছ চাষিরা সহজেই রক্ষা পেতে পারেন।
কৃতজ্ঞতা:
এই ফিচারের সকল আলোকচিত্র তুলে দিয়েছেন বলরাম মহলদার (টেকনিক্যাল স্পেশালিস্ট, অ্যাকুয়াকালচার ফর ইনকাম এন্ড নিউট্রিশন প্রজেক্ট, ওয়ার্ল্ডফিশ-বাংলাদেশ)। তার নিকট লেখক গভীরভাবে কৃতজ্ঞ।
তথ্যসূত্র:
- ওয়ার্ল্ডফিশ-বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়া, ২০১৩, কার্প জাতীয় মাছের হ্যাচারি অপারেশন ম্যানুয়াল,অ্যাকুয়াকালচার ফর ইনকাম এন্ড নিউট্রিশন (এআইএন)প্রজেক্ট, ওয়ার্ল্ডফিশ-বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়া, ঢাকা, বাংলাদেশ। Retrieve on 02 September 2014 and from http://www.worldfishcenter.org/resource_centre/Carp-Hatchry-Manual.pdf
- বিষ্ণু দাস,১৯৯৭, মাৎস্য ও মাৎস্য সম্পদ ব্যবস্থাপনা (তৃতীয় খণ্ড), বাংলা একাডেমী,ঢাকা, বাংলাদেশ। পাতা ২২৮-২৯৭।
- Steckler N and Yanong RPE, 2014. Lernaea (Anchorworm) Infestations in Fish. EDIS, University of Florida IFAS Extension. Retrieve on 02 September 2014 and from http://edis.ifas.ufl.edu/fa185
Visited 2,984 times, 1 visits today | Have any fisheries relevant question?