ফিশারীজ কোন মৌলিক বিজ্ঞান নয় বরং এটি জীববিজ্ঞান, রসায়ন, গণিত ও পদার্থবিজ্ঞানের একটি সমন্বিত বিজ্ঞান যা মাছ ও অন্যান্য অর্থনৈতিক গুরুত্ব বিশিষ্ট জলজ প্রাণীদের জীবতত্ত্ব, চাষ, আবাসস্থল ব্যবস্থাপনা, আহরণ, প্রক্রিয়াজনকরণ ইত্যাদি বিষয়ে বিজ্ঞানভিত্তিক আলোচনা করে। তাই ফিশারীজকে বুঝতে হলে অবশ্যই জীববিজ্ঞান, রসায়ন, গণিত ও পদার্থবিজ্ঞানের মৌলিক বিষয়াদি সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা থাকা প্রয়োজন। সে উদ্দেশ্য পূরণকল্পে শুরু হল বিডিফিশ বাংলার পূর্বপাঠ অধ্যায়। এলেখার বিষয় পর্ব পরিফেরা (Porifera) এবং নিডেরিয়া (Cnidaria)। সাথে রইল কুইজে অংশ নেয়ার সুযোগ

 

পরিফেরা (Porifera)
পরিফেরা পর্বের প্রাণীদের বৈশিষ্ট্য:

  • বহুকোষী দেহে সুনির্দিষ্ট কলা, কলাতন্ত্র, অঙ্গ এবং অঙ্গতন্ত্র অনুপস্থিত।
  • দেহে নালিকাতন্ত্র (Canal system) বর্তমান যা এ পর্বের অনন্য বৈশিষ্ট্য।
  • দেহের অভ্যন্তরে স্পঞ্জোসিল (Spongocoel) নামক প্রশস্ত গহ্বর বর্তমান যা অসক্যুলাম (Osculum) নামক বড় আকারের ছিদ্রের মাধ্যমে বাহিরে উন্মুক্ত।
  • দেহপ্রাচীর অস্টিয়া (Ostia) নামক অসংখ্য ক্ষুদ্রাকৃতির ছিদ্র বিশিষ্ট।
  • দেহে ফ্লাজেলা বিশিষ্ট কোষ কোয়ানোসাইট (Choanocyte) দিয়ে পরিবেষ্টিত এক বা একাধিক প্রকোষ্ঠ (Chamber) বর্তমান।
  • এদের দেহ ফুলদানী আকৃতির (Vase-like), সিলিন্ডার আকৃতির (Cylindrical), নলাকার (Tubular), কুশন আকৃতির (Cushion-shaped) ইত্যাদি এবং প্রতিসাম্যতা (Symmetry) অপ্রতিসম (Asymmetry) অথবা অরিয় প্রতিসম (Radial symmetry) ধরণের।
  • দেহপ্রাচীর দ্বিস্তর বিশিষ্ট। বাহিরের স্তর পিনাকোডার্ম (Pinacoderm) এবং ভেতরের স্তর কোয়ানোডার্ম (Choanoderm)। উভর স্তরের মাঝে সাধারণত কোষ-বিহীন (Non-cellular) মেসেনকাইম (Mesenchyme) বর্তমান যাতে স্পিকিউল (Spicule), স্পঞ্জিন (Spongin) ও অ্যামিবয়েড (Amoeboid) কোষ দেখতে পাওয়া যায়।
  • পরিণত প্রাণীরা নিশ্চল (Sessile) অর্থাৎ কোন অবকাঠামোতে স্থায়ীভাবে আটকে থাকে।
  • এরা একাকী (Solitary) অথবা উপনিবেশ (Colonial) গঠন করে অবস্থান করে।
  • সকলেই জলজ প্রাণী যাদের বেশিরভাগ সামুদ্রিক সামান্য কিছু প্রজাতি স্বাদুপানির।
  • সকল স্পঞ্জই  উভলিঙ্গ (Hermaphrodite) হলেও এরা Allogamy তথা cross-fertilization প্রদর্শন করে অর্থাৎ একই দেহে স্ত্রী ও পুরুষ জননকোষ উৎপন্ন হলেও দুটি ভিন্ন সদস্যের স্ত্রী ও পুরুষ জননকোষের মাধ্যমে নিষেক (Fertilization) সম্পন্ন হয়।
  • এদের অযৌন প্রজনন বাডিং (Budding), ফিউশন (Fission) এবং গ্যামুউল (Gammule) ধরনের এবং যৌন প্রজনন গ্যামেটোগনি (Gametogony) ধরনের।
  • দেহের ক্ষতিগ্রস্ত অংশের পুনঃ উৎপত্তির (Regeneration) ক্ষমতা বর্তমান।

 

পরিফেরা পর্বের প্রাণীদের শ্রেণীবিন্যাস:

১৯৭২ সালে বিজ্ঞানী মেগলিস (Meglitsch) প্রদত্ত পরিফেরা পর্বের শ্রেণীবিন্যাস মূলত অন্তঃকঙ্কালের উপর ভিত্তিকরে নির্মিত যা নিম্নে দেয়া হল-

 

শ্রেণী: ক্যালকেরিয়া (Calcarea)

[ল্যাটিন শব্দ Calx যার আভিধানিক অর্থ Lime  তথা চুন]

  • ছোট আকৃতির চুনায়িত (Calcareous) স্পঞ্জ দৈর্ঘ্যে ১০ সেমি এর চেয়ে ছোট হয়ে থাকে।
  • দেহাকৃতি সিলিন্ড্রাকাল (Cylindrical) বা ফুলদানী (Vase-like) আকৃতির।
  • একাকী (Solitary) বা উপনিবেশে (Colonial) অবস্থান করে।
  • স্পিকিউল (Spicule) চুন (Lime) নির্মিত এবং এক/তিন/চার রশ্মি (Rayed) বিশিষ্ট।
  • ফ্লাজেলাম প্রকোষ্ঠ লম্বা আকৃতির।
  • কোয়ানোসাইট (Choanocyte) নামক কোষগুলো আকৃতিতে বড়।
  • সকলেই সামুদ্রিক।
  • উদাহরণ: Sycon gelatinosum

 

শ্রেণী: হেক্সাটিনেলিডা (Hexactinellida)

  • কাপ (Cup), গোলাকার বা ফুলদানী আকৃতির স্পঞ্জ তুলনামূলক বৃহৎ, অনেকে এক মিটার পর্যন্ত হয়ে থাকে।
  • স্পিকিউল (Spicule) সিলিকা নির্মিত (Siliceous) এবং ছয় রশ্মি (Rayed) বিশিষ্ট।
  • ডার্মাল এপিথেলিয়াম  (Dermal epithelium) বা এক্সোপিনাকোর্ডাম (Exopinacoderm) অনুপস্থিত।
  • ফ্লাজেলাম প্রকোষ্ঠ ডিম্বাকৃতির
  • কোয়ানোসাইট (Choanocyte) নামক কোষগুলো আকৃতিতে ছোট।
  • সকলেই সামুদ্রিক, অনেকেই গভীর সমুদ্রের বাসিন্দা।
  • উদাহরণ: Euplectella aspergillus

 

শ্রেণী: ডেমোস্পঞ্জি (Demospongiae)

[গ্রিক শব্দ Demose যার আভিধানিক অর্থ Frame  তথা কাঠামো এবং Spongos যার আভিধানিক অর্থ Sponge তথা স্পঞ্জ]

  • কোয়ানোসাইট (Choanocyte) নামক কোষগুলো আকৃতিতে ছোট।
  • ফ্লাজেলাম প্রকোষ্ঠ গোলাকার বা বৃত্তাকার।
  • অনেক প্রাণীতে স্পিকিউল অনুপস্থিত। যাদের বর্তমান তাদের স্পিকিউল সিলিকাজাত (Siliceous) বা স্পঞ্জিন-তন্তু (Spongin fibre) নির্মিত অথবা সিলিকা ও স্পঞ্জিন তন্তুর সমন্বয়ে গঠিত এবং এক বা ছয় রশ্মি (Rayed) বিশিষ্ট।
  • ছোট থেকে বৃহৎ আকারের দেহ ফুলদানী আকৃতির (Vase-like), কাপ আকৃতির (Cup-like), কুশন আকৃতির (Cushion-shaped) এবং এরা একাকী (Solitary) অথবা উপনিবেশ (Colonial) গঠন করে অবস্থান করে।
  • অধিকাংশই সামুদ্রিক, কিছু স্বাদুপানির বাসিন্দা।
  • উদাহরণ: Spongilla locustris

 

ল্যাটিন শব্দ Porus অর্থ ছিদ্র এবং Ferre অর্থ বহন করা।  এ শব্দদুটির সমন্বয়ে পরিফেরা (Porifera) শব্দটি তৈরি হয়েছে। ১৮৩৬ সালে বিজ্ঞানী গ্রান্ট (Grant) প্রথম পরিফেরা (Porifera) পর্বটির নামকরণ করেন।

 

 

পর্ব: নিডেরিয়া (Cnidaria)

নিডেরিয়া (Cnidaria) পর্বের প্রাণীদের বৈশিষ্ট্য:

  • কিছু কোষ কলা (যেমন- স্নায়ুকলা) গঠন করলেও অধিকাংশ কোষই বিচ্ছিন্ন তবে সুনির্দিষ্ট কাজের জন্য বিশেষায়িত।
  • এরা ডিপ্লোব্লাস্টিক (Diploblastic) প্রাণী অর্থাৎ এদের ভ্রূণ দ্বিস্তর বিশিষ্ট। বাহিরের স্তর এক্টোডার্ম (Ectoderm)  এবং ভেতরের স্তর এন্ডোডার্ম (Endoderm)।  পূর্ণাঙ্গ প্রাণীও দ্বিস্তর তথা দ্বিত্বক বিশিষ্ট।
  • দেহের ভেতরে প্রশস্ত গহ্বর যা সিলেন্টেরন (Coelenteron) নামে পরিচিত এবং একটি মাত্র ছিদ্র পথে (মুখছিদ্র) বাইরে উন্মুক্ত (পায়ু ছিদ্র অনুপস্থিত)।
  • এরা অরীয় প্রতিসম (Radial symmetry) অর্থাৎ এদের দেহের কেন্দ্রীয় অক্ষের মধ্য দিয়ে অতিক্রান্ত একটিমাত্র তল বরাবর ছেদ করে দুই বা ততোধিক বার দেহটিকে সমভাবে ভাগ করা যায়।
  • বহিঃ দেহত্বকে (Epidermis) প্রচুর পরিমাণে নিডোব্লাস্ট (Cnidoblast) নামক কোষ বর্তমান যারা বিষাক্ত পদার্থ ধারণ করার জন্য নিমাটোসিস্ট (Nematocyst) নামক একটি থলি এবং বিষাক্ত পদার্থ প্রয়োগ করার জন্য থ্রেড টিউব (Thread tube) নামক চাবুকের মত নল বহন করে।
  • অধিকাংশই সামুদ্রিক, কিছু স্বাদুপানির বাসিন্দা। একাকী অথবা উপনিবেশ গঠন করে অবস্থান করে। নিশ্চল অথবা মুক্ত সাঁতারু।
  • অনেকের শুধুমাত্র মুক্ত বা নিশ্চল পলিপ (Polyp) দশা বর্তমান। আবার অনেকের মুক্ত সাঁতারু মেডুসা (Medusa) দশা বর্তমান। আবার অনেকের উভয় দশাই বর্তমান।
  • বহিঃকোষীয় ও অন্তঃকোষীয় উভয় প্রকার পরিপাক প্রক্রিয়া এদের দেহে দেখতে পাওয়া যায়।

 

নিডেরিয়া (Cnidaria) পর্বের প্রাণীদের শ্রেণীবিন্যাস:

১৯৭২ সালে বিজ্ঞানী মেগলিস (Meglitsch) প্রদত্ত নিডেরিয়া পর্বের শ্রেণীবিন্যাসটি নিম্নে দেয়া হল-

 

শ্রেণী: হাইড্রোজোয়া (Hydrozoa)

[গ্রিক শব্দ Hydra যার আভিধানিক অর্থ Water  তথা পানি এবং Zoios যার আভিধানিক অর্থ animal তথা প্রাণী]

  • অনেকের জীবনচক্রে কেবলমাত্র পলিপ (Polyp) দশা বর্তমান, অনেকের আবার  অযৌন পলিপ (Polyp) ও যৌন মেডুসা (Medusa) উভয় দশাই উপস্থিত।
  • মেসোগ্লিয়া (Mesogloea) কোষ-বিহীন (Non-cellular)।
  • জননকোষ উৎপাদন অঙ্গ (Gonad) এক্টোডার্ম (Ectoderm) থেকে উদ্ভূত।
  • স্বাদুপানি অথবা সামুদ্রের বাসিন্দা এবং নিশ্চল অথবা মুক্ত সাঁতারু।
  • উদাহরণ: Hydra virdis, Obelia geniculata

 

শ্রেণী: স্কাইফোজোয়া (Schyphozoa)

[গ্রিক শব্দ Skyphos যার আভিধানিক অর্থ Cup  তথা কাপ এবং Zoios যার আভিধানিক অর্থ animal তথা প্রাণী]

  • এদের জীবনচক্রে মেডুসা (Medusa) দশাই প্রধান, পলিপ (Polyp) দশা অনুপস্থিত বা স্বল্পস্থায়ী।
  • মেডুসা দশায় দেহ ঘণ্টা অথবা ছাতা আকৃতির।
  • জননকোষ উৎপাদন অঙ্গ (Gonad) এন্ডোডার্ম (Endoderm) থেকে উদ্ভূত।
  • বৃহৎ আকৃতির মেসোগ্লিয়ায় (Mesogloea) তন্তু (Fibers) ও কোষ বর্তমান।
  • নিশ্চল এবং সামুদ্রিক।
  • উদাহরণ: Aurelia aurita, Cyania capillata

 

শ্রেণী: অ্যান্থোজোয়া (Anthozoa)

[গ্রিক শব্দ Anthos যার আভিধানিক অর্থ flower  তথা ফুল এবং Zoios যার আভিধানিক অর্থ animal তথা প্রাণী]

  • এদের জীবনচক্রে কেবলমাত্র পলিপ দশা উপস্থিত। মেডুসা দশা অনুপস্থিত।
  • মেসোগ্লিয়ায় (Mesogloea) তন্তুময় যোজক কলা (Fibrous connective tissue) বর্তমান।
  • জননকোষ উৎপাদন অঙ্গ (Gonad) এন্ডোডার্ম (Endoderm) থেকে উদ্ভূত।
  • একাকী অথবা উপনিবেশ গঠনকারী প্রাণীরা সকলেই সামুদ্রিক।
  • উদাহরণ: Metridium senil, Gorgoni verrucosa

 

গ্রিক শব্দ Knide অর্থ রোম বা কাঁটা এবং Aria অর্থ সংযুক্ত থাকা।  এ শব্দদুটির সমন্বয়ে নিডেরিয়া (Cnidaria) শব্দটি তৈরি হয়েছে। ১৮৮৮ সালে বিজ্ঞানী হাসচেক (Hatschek) প্রথম নিডেরিয়া (Cnidaria) পর্বটির নামকরণ করেন।

 

কুইজে অংশ নিতে লিঙ্কটি অনুসরণ করুন

 


Visited 22,553 times, 1 visits today | Have any fisheries relevant question?
পর্ব পরিফেরা (Porifera) এবং নিডেরিয়া (Cnidaria)

Visitors' Opinion

Tagged on:                                                                             

রাহাত পারভীন রীপা

প্রাণিবিদ্যায় স্নাতক ও স্নাতকোত্তর। বিস্তারিত

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.