উত্তরাঞ্চলের সিদল
উত্তরাঞ্চলের সিদল

শুটকি মাছ ও কচুর ডাটা দিয়ে তৈরি করা এক প্রকারের খাবারের নাম সিদল যা উত্তরাঞ্চলের একটি বিশেষায়িত খাবার। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের (গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, রংপুর, নীলফামারী, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁ) গ্রাম বাংলার মুখরোচক খাবার হিসেবে এর কদর রয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলেও সিদল নামের খাবার তৈরি করা হয় তবে তা উত্তরাঞ্চলের সিদলের মত নয়। যেমন বৃহত্তর ময়মনসিংহের অনেক অঞ্চলে চ্যাঁপা শুটকিকে সিদল/হিদল বলা হয় যা প্রক্রিয়াজাতকরণ ও রান্নার দৃষ্টিকোণ থেকে উত্তরাঞ্চলের সিদল হতে ভিন্ন। তবে ভিন্নতা থাকলেও সিদল তৈরিতে সব স্থানেই ছোট মাছের শুটকি ব্যবহার করা হয়।

 

সিদল তৈরিতে যা যা লাগবে:

  • পুঁটি বা দারকিনা শুটকি – ১/২ কেজি
  • কচুর ডাটা – এক চালুন (ধান ঝাড়ার বড় চালুন)
  • হলুদ গুড়া – ১ টেবিল চামচ
  • মরিচ গুড়া – ২ টেবিল চামচ
  • জিরা বাটা – ১ টেবিল চামচ
  • আদা বাটা – ১টেবিল চামচ
  • পিঁয়াজ বাটা – ১০ টি
  • রসুন বাটা – ১০ টি
  • সয়াবিন বা সরিষার তেল – ১০০ মিলি
  • লবণ -পরিমাণ মত

 

সিদল তৈরির সময়:

  • কড়া রোদ থাকলে বছরের যে কোন সময় সিদল তৈরি করা যায়।
  • ফাল্গুন – চৈত্র মাসে বাতাসে আর্দ্রতা কম থাকায় এসময় সিদল তৈরির জন্য ভাল।
  • বছরের অন্যান্য সময়ে তৈরি করা শুটকি থেকে সারা বছরই খুব সহজেই সিদল তৈরি করা যায়।

 

সিদল তৈরির পদ্ধতি:

  • শুটকি গুড়া তৈরি:
    • মচমচে শুটকি মাছ পাটা/হামান দিস্তা/ঢেঁকিতে খুব ভালো করে গুড়া করে নিতে হবে।
    • শুটকি ভালোমত গুড়া না হলে প্রয়োজনে গুড়া করার আগে হালকা ভেজে নিতে হবে।
    • শুটকির গুড়া চালুনিতে চেলে নিতে হবে।
  • কচুর ডাটার মণ্ড (পেস্ট) তৈরি:
    • কচুর ডাটা ধুয়ে ছিলে নিতে হবে।
    • এক-দেড় ঘণ্টা রোদে রেখে পানি ঝড়িয়ে নিতে হবে।
    • পানি ঝরানো হলে পাটা/হামান দিস্তা/ঢেঁকিতে ভালো ভাবে পিষে মিহি পেস্ট তৈরি করতে হবে।
  • শুটকি ও কচুর ডাটার মণ্ড ও অন্যান্য উপকরণ মিশ্রণ:
    • কচুর ডাটার মণ্ড (পেস্ট) ও শুটকির গুড়া ভালো করে মিশাতে এক সাথে পাটা/হামান দিস্তা/ঢেঁকিতে ভালো করে পিষতে হবে।
    • প্রাপ্ত মণ্ডতে বাকি সব উপকরণ মিশিয়ে নিতে হবে।
  • সিদলের আকৃতি প্রদান ও শুকানো:
    • হাতের তালুতে গোল করে চেপে সিদলের আকৃতি প্রদান করতে হবে।
    • তৈরি সিদল চাটাই/কুলা/চালুনে রোদে দিতে হবে।
    • শুকানোর প্রথম দিকে সিদলের উপরি ভাগ ফেটে গেলে প্রতিটা সিদল আলাদা আলাদা করে উঠিয়ে পুনরায় হাতের তালুতে গোল করে চেপে সিদলের আকৃতি দিয়ে রোদে শুকাতে হবে তা না হলে সিদল ফেটে যাবে।
    • এভাবে ১৫-১৬ দিন রোদে শুকালে সিদল সংরক্ষণের উপযোগী হবে।

 

সংরক্ষণ পদ্ধতি:

  • মুখবন্ধ পাত্রে সংরক্ষণ:
    • সিদল রোদ থেকে এনে ঠাণ্ডা করে প্লাস্টিক/টিন/কাঁচের মুখবন্ধ পাত্রে সংরক্ষণ করা যায়।
    • তবে মাঝে মাঝে বের করে রোদ দেয়া আবশ্যক। রোদে দেয়া সিদল পুনরায় ঠাণ্ডা করে মুখবন্ধ পাত্রে সংরক্ষণ করতে হবে।
    • কিছু দিন পর পর রোদে দিলে সিদল দেড়-দুই বছর ভালো থাকে।
  • রেফ্রিজারেটরে সংরক্ষণ
    • শুকনো সিদল প্লাস্টিকের কাগজে মুড়িয়ে প্লাস্টিকের বক্সে রেফ্রিজারেটরে রাখলে ৩ বছর পর্যন্ত ভালো থাকে।
    • এ ক্ষেত্রেও মাঝে মাঝে রোদ দেবার প্রয়োজন রয়েছে।

 

সিদল রান্নার পদ্ধতি:
বিভিন্ন ভাবে সিদল রান্না করা যায়। আবার অঞ্চল ভেদে সিদল রান্নাতে ভিন্নতা দেখতে পাওয়া যায়। কাতলা বা বোয়াল মাছের সাথে সিদল মিশিয়ে প্রচণ্ড ঝাল দিয়ে রান্না করা হয়। শাক দিয়ে সিদল রান্নার প্রচলন সুপরিচিত। মাছের মাথা রান্নায় সিদল তরকারির স্বাদ যেমন বাড়িয়ে দেয় তেমনি পুষ্টি মানও বৃদ্ধি করে। তবে সব থেকে জনপ্রিয় সিদল রান্নার পদ্ধতি হচ্ছে সিদল ভর্তা।

  • সিদল ভর্তা প্রস্তুত:
    • ভাত নামানোর ৫ মিনিট আগে সিদল ভাতে দিয়ে সিদ্ধ করে নিতে হবে।
    • পরবর্তীতে সেটি হালকা তেলে ভেজে ভাজা মরিচ, পিঁয়াজ, রসুন, লবণ, সরিষার তেল দিয়ে ভালো করে হাত দিয়ে বা পাঠায় পিষে ভর্তা তৈরি করতে হবে।

 

কৃতজ্ঞতা:

  • নাজমা বেগম, গৌরীপুর, শেরপুর: যিনি ছবির সিদল গুলো তৈরি করেছেন এবং তৈরির পদ্ধতি বর্ণনা করেছেন।
  • গাজালা: যিনি ছবি তুলে দিয়েছেন।

Visited 7,368 times, 1 visits today | Have any fisheries relevant question?
উত্তরাঞ্চলের সিদল: গ্রাম বাংলার মুখরোচক খাবার

Visitors' Opinion

আয়েশা আবেদীন আফরা

প্রাক্তন শিক্ষার্থী, বি.এস-সি. ফিশারিজ (অনার্স) ৬ষ্ঠ ব্যাচ (সেশনঃ২০০৪-২০০৫), শেখ ফজিলাতুননেছা মুজিব ফিশারীজ কলেজ মেলান্দহ, জামালপুর। বিস্তারিত

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.