আফ্রিকার হ্রদ ও নদীর মাছ তেলাপিয়া ১৯৫৪ সালে সর্ব প্রথম থাইল্যান্ড থেকে আমাদের দেশে নিয়ে আসা হয় মশা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে ম্যালেরিয়া রোগের প্রকোপ কমানোর জন্য (Rahman, 2007)। এরা আফ্রিকার দেশ মোজাম্বিকের (Mozambique) স্থানীয় মাছ এবং মোজাম্বিকের নামানুসারেই এর প্রজাতির নাম শেষাংশ mossambicus এসেছে (Khaleque, 2002)। বাংলাদেশে যেসব বিদেশী মাছ উন্মুক্ত জলাশয়ে প্রবেশ করছে তার মধ্যে তেলাপিয়া অন্যতম। বাংলাদেশের নদী, নালা, খাল, বিল, ঝিল, হাওড়, বাঁওড়, হ্রদ ইত্যাদির মত উন্মুক্ত জলাশয়ে ব্যাপকভাবে বিস্তার লাভ করেছে।
শ্রেণীতাত্ত্বিক অবস্থান (Systematic position)
পর্ব: Chordata
শ্রেণী: Actinopterygii (Ray-finned fishes)
বর্গ: Perciformes (Perch-likes)
পরিবার: Cichlidae (Cichlids)
গণ: Oreochromis
প্রজাতি: Oreochromis mossambicus (Peters, 1852)
শব্দতত্ত্ব (Etymology):
Oreochromis শব্দটি এসেছে ল্যাটিন (Latin) শব্দ aurum যার অর্থ সোনা (gold) এবং গ্রিক শব্দ chromis যার অর্থ মাছ, বিশেষত পার্চ জাতীয় মাছ (fish, perhaps a perch)।
সমনাম (Synonyms)
Chromis dumerilii Steindachner, 1864
Chromis mossambicus Peters, 1852
Chromis natalensis Weber, 1897
Chromis niloticus var. mossambicus Peters, 1852
Chromis vorax Pfeffer, 1893
Sarotherodon mossambicus (Peters, 1852)
Sarotherodon mossambicus natalensis (Weber, 1897)
Tilapia arnoldi Gilchrist and Thompson, 1917
Tilapia dumerilii (Steindachner, 1864)
Tilapia mossambica (Peters, 1852)
Tilapia mossambica mossambica (Peters, 1852)
Tilapia mossambicus (Peters, 1852)
Tilapia natalensis (Weber, 1897)
Tilapia vorax (Pfeffer, 1893)
সাধারণ নাম (Common name)
বাংলা: তেলাপিয়া
English: Tilapia, Mozambique tilapia, Mozambique cichlid, Java tilapia
বিস্তৃতি (Distribution)
তেলাপিয়ার আদিবাস আফ্রিকার মালাউই (Malawi), মোজাম্বিক (Mozambique), সাউথ আফ্রিকা (South Africa) (পূর্ব কেপ প্রদেশ (Eastern Cape Province), কোয়াজুলু-নাটাল (KwaZulu-Natal)), সোয়াজিল্যান্ড (Swaziland), জাম্বিয়া (Zambia), ও জিম্বাবুয়েতে (Zimbabwe)।
Fishbase (2014) অনুসারে এদের বিস্তার 13°S – 35°S।
বর্তমানে চাষ ও মশা নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে পৃথিবীর প্রায় ত্রিশটি দেশে এই মাছের বিস্তার ঘটেছে।
সংরক্ষণ অবস্থা (Conservation status)
Cambray J and Swartz E (2007) অনুসারে আইইউসিএন এর হুমকিগ্রস্ত প্রজাতির লাল তালিকায় (The IUCN Red List of Threatened Species) এদের অবস্থান Near Threatened (NT) অর্থাৎ এই মাছ এখনো হুমকিগ্রস্ত প্রজাতির তালিকার অন্তর্ভুক্ত নয় তবে হুমকিগ্রস্ত প্রজাতির তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার খুব নিকটে এর অবস্থান।
বাহ্যিক দৈহিক গঠন (External Morphology)
অনেকাংশে চ্যাপ্টা দেহ কিছুটা লম্বা। দেহের অঙ্কীয় প্রান্তের চেয়ে পৃষ্ঠ প্রান্ত অপেক্ষাকৃত বেশি উত্তল। প্রান্তীয় মুখ প্রস্ত। উপরের ও নীচের চোয়াল সমান। তুণ্ড গোলাকৃতির। এদের পার্শ্বরেখা সম্পূর্ণ।
বক্ষপাখনার ভিত্তি বরাবর বিপরীত পাশে পৃষ্ঠপাখনা শুরু হয়েছে। পৃষ্ঠপাখনার অগ্র প্রান্তের পাখনা-রশ্মিগুলো কাঁটায় পরিণত হয়েছে কিন্তু পশ্চাৎ প্রান্তের পাখনা-রশ্মিগুলো নরম প্রকৃতির। পুচ্ছপাখনার শেষপ্রান্ত গোলাকৃতির।
Perciformes বর্গের অন্যান্য মাছে টেনয়েড (Ctenoid) আঁইশ দেখতে পাওয়া গেলেও তেলাপিয়ায় গোলাকার সাইক্লয়েড (Cycloid) আঁইশ দেখতে পাওয়া যায়। পার্শ্বরেখায় ৩০-৩১টি আঁইশ থাকে। তবে Talwar and Jhingran (1991) এর মতে তেলাপিয়ার পার্শ্বরেখায় ৩০-৩২টি আঁইশ বর্তমান। পার্শ্বরেখায় উপরের দিকে ১১-১৩টি এবং নিচের দিকে ১০-১১টি আঁইশ উপস্থিত।
স্ত্রী ও অপরিণত পুরুষ তেলাপিয়ার গায়ের বর্ণ হালকা ধুসর থেকে হলদে হয়ে থাকে। প্রজনন ঋতুতে পরিণত পুরুষ তেলাপিয়ার গায়ের রং গাঢ় সবুজ থেকে কালচে বর্ণের হয়ে থাকে। সেই সাথে পৃষ্ঠপাখনার বর্ণ কালচে এবং এর প্রান্তভাগ লালচে বর্ণের হয়ে থাকে। বক্ষ পাখনা স্বচ্ছ লাল বর্ণ ধারণ করে। পুচ্ছ পাখনার শেষ প্রান্তে লাল আভা বিস্তৃত থাকে।
Galib and Mohsin (2011) অনুসারে এদের আদর্শ দৈর্ঘ্য, দেহ উচ্চতা, মাথার দৈর্ঘ্য ও পুচ্ছদণ্ড মোট দৈর্ঘ্যের যথাক্রমে ৭৯, ৩০, ২৯ ও ৮ শতাংশ। চোখের ব্যাস মাথার দৈর্ঘ্যের ২০ শতাংশ।
পাখনা সূত্র:
D. 28; P1. 14; P2. 7; A. 11. (Galib and Mohsin, 2011)
D. XV-XVI/10-12, P1. 14-15, P2. I/5, A. III/10-12 (Sultana, 2014).
D. XV-XVI/10-12, P1. 14-15, P2. I 5 A. III 10-11 (Talwar and Jhingran, 1991)
সর্বোচ্চ দৈর্ঘ্য, ওজন ও বয়স (Maximum length, Weight and Age)
বাংলাদেশে এই মাছের নথিবদ্ধ সর্বোচ্চ দৈর্ঘ্য ১৮ সেমি। Fishbase (2014) অনুসারে এই মাছের সর্বোচ্চ দৈর্ঘ্য ৩৯ সেমি এবং ওজন ১.১ কেজি এবং বয়স ১১ বছর।
খাদ্য এবং খাদ্যাভ্যাস (Food and feeding habit)
এরা সর্বভুক মাছ (Yadav, 1997) অর্থাৎ উদ্ভিদ ও প্রাণী উভয় প্রকারের খাবার (প্রধানত প্ল্যাঙ্কটন, plankton) খেয়ে থাকে। তবে পরিণত তেলাপিয়া সাধারণত উদ্ভিদভোজী হয়ে থাকে (Shammi and Bhatnagar, 2002)। এরা প্রধানত শেওলা (algae) বিশেষত ডায়াটমস (diatoms), জলজ পতঙ্গ (insects), ক্রাস্টেশিয়ানস (crustaceans), মাছের ডিম পোনা (larvae) এবং উদ্ভিদ ও প্রাণীর মৃত দেহাংশ (detritus) ইত্যাদি খেয়ে বেঁচে থাকে (Yadav, 1997)।
আবাস্থল (Habitat)
তেলাপিয়া মূলত উষ্ণ জলের জলাশয়ের উপরি স্তরে (পরিসর: ১-১২ মিটার) বিচরণকারী মাছ। তবে শক্র-প্রাণী দ্বারা আক্রান্ত হলে এদের কাদার নিকটে এমন কি কাদার মধ্যে আশ্রয় নিতে দেখা যায়। এরা স্বাদু ও লবণাক্ত উভয় পরিবেশের পানিতে বসবাস করতে সক্ষম (Yadev, 1997)। অভিপ্রয়াণ বৈশিষ্ট্যের দিকে থেকে এরা amphidromous মাছ অর্থাৎ এরা প্রজননের উদ্দেশ্য ছাড়াই স্বাদুপানি থেকে লোনা পানিতে এবং লোনা পানি থেকে স্বাদুপানিতে অভিপ্রয়াণ করে থাকে।
প্রকৃতিতে এদের অনুকূল তাপমাত্রা ১৭-৩৫ °সে. (Fishbase, 2014)।
প্রজনন (Breeding)
তেলাপিয়া মাত্র দুই মাস বয়সেই প্রজননে সক্ষম হয়ে থাকে। এরা বছরে ৪-৬ বার প্রজননে অংশ নেয় (Yadev, 1997)। অবশ্য Shammi and Bhatnagar (2002) অনুসারে এরা বছরে প্রায় আট বার প্রজনন করে থাকে।
এদের স্ত্রী ও পুরুষ মাছ আলাদা। একই বয়সের পুরুষেরা স্ত্রীদের চেয়ে আকারে বড় হয়ে থাকে। প্রজনন ঋতুতে স্ত্রীদের দেহের বর্ণ রূপালী ও হলদে (Khaleque, 2002) আর পুরুষদের দেহ গাঢ় সবুজ থেকে কালচে বর্ণের হয়ে থাকে এবং পুচ্ছ ও পায়ু পাখনার বর্ণ লালচে (reddish) বা লাল হয়ে থাকে।
গ্রীষ্মে এরা প্রজনন করে থাকে। প্রজননের উদ্দেশ্যে এদের বাবারা জলাশয়ের বালিময় তলদেশে বাসা তৈরি করে। এক প্রজনন ঋতুতে মায়েরা প্রতি ৩-৪ সপ্তাহ অন্তর অন্তর প্রজননে অংশ নেয়। প্রতিবারই নতুন নতুন প্রজনন-সঙ্গী বেছে নেয়। মায়েরা মুখগহ্বরে নিষিক্ত ডিমকে তা দেয় এবং মুখ গহ্বরেই ডিম ফুটে ডিমপোনা বের হয়। মায়েরা তাদের মুখগহ্বরে নিষিক্ত ডিম, ডিমপোনা ও বাচ্চার আশ্রয় দেয় যতদিন না তারা স্বনির্ভর হয় (Bailey and Stanford, 1999)। মুখে ডিম ও বাচ্চার আশ্রয় দেয়ায় এদের mouthbroods বা mouthbreeders বলে।
রোগ (Diseases)
এদের ব্যাকটেরিয়া (Bacteria) জনিত রোগ যথা- Myxobacterial infections, abdominal dropsy ইত্যাদি দেখতে পাওয়া যায়। Chilodonella sp., Trichodina sp., Myxobolus sp., Argulus sp. এবং Lernaea sp. ইত্যাদি পরজীবী দ্বারা আক্রান্ত হয়ে থাকে (Hussain, 2004)।
অর্থনৈতিক গুরুত্ব (Economic Important):
বাংলাদেশে বর্তমানের চাষের মাছ তথা খাবারের মাছ হিসেবে এই মাছের গুরুত্ব রয়েছে। এরা স্বাদুপানি (<০.৫ পিপিটি) ও লোনা পানি (৩৪-৪৮ পিপিটি) উভয় পরিবেশেই টিকে থাকতে পারে ফলে বাংলাদেশের স্বাদুপানির এলাকা ছাড়াও উপকূলীয় এলাকায় এই মাছের চাষ করা সম্ভব হয়েছে।
তেলাপিয়া একটি কষ্টসহিষ্ণু মাছ। সারা পৃথিবীতে মৎস্য খাদ্য হিসাবে এর গুরুত্ব দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। সহজে প্রজনন করে ও উচ্চ ফলনশীল হওয়ায় তেলাপিয়া চাষের জন্যও উপযুক্ত হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে।
খাবারের মাছ হিসেবে এর যেমন গুরুত্ব রয়েছে তেমনই এ্যাকুয়ারিয়ামের বাহারি মাছ হিসেবেও এর গ্রহণযোগ্যতা দেখতে পাওয়া যায়।
বাস্তুতাত্ত্বিক গুরুত্ব (Ecological Important):
এরা পরিণত বয়সে খাদ্যচক্রে প্রথম স্তরের খাদক এবং তরুণ মাছ দ্বিতীয় বা তৃতীয় স্তরের খাদক হিসেবে বিবেচিত।
তেলাপিয়া সর্বভুক মাছ বিধায় এরা জলজ পরিবেশের সর্বপ্রকার খাদ্য গ্রহণ করে ও বিশেষ করে চাষ যোগ্য পুকুর পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে সহায়তা করে। এই প্রেক্ষিতে তেলাপিয়া জলজ পরিবেশ রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
মশার লার্ভা নিধনে এই মাছের ব্যবহার করার সম্ভাব্যতা রয়েছে।
এই মাছ ইতোমধ্যেই বিল, ঝিল, হাওড়, বাঁওড়, নদী, হ্রদ ইত্যাদি উন্মুক্ত জলাশয়ে ব্যাপকভাবে বিস্তার লাভ করেছে যা এ দেশীয় প্রজাতির ছোট মাছের সাথে খাদ্য ও বাসস্থানের পরিসর নিয়ে প্রতিযোগিতা করে থাকে। ফলে দেশীয় ছোট মাছের উপর এরা ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে এবং অদূর ভবিষ্যতে এই প্রভাব আরও ভয়ঙ্কর হবে বলে পরিবেশ বিজ্ঞানীরা মতামত প্রকাশ করেছেন।
সারা বছর ধরে প্রজনন করার বৈশিষ্ট্যের কারণে সহজেই জলাশয়ে এদের ঘনত্ব বেড়ে যায় যা রুই জাতীয় মাছ চাষের ক্ষেত্রে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে থাকে।
এর মধ্যেই পৃথিবীর অনেক দেশে এই মাছ বাস্তুতাত্ত্বিক ক্ষতিকর প্রভাব ফেলেছে বলে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে।
Fishbase 2014 অনুসারে এরা মানুষের জন্য Potential pest হিসেবে বিবেচিত।
বিপণন অবস্থা (Market status):
আকারের উপর ভিত্তি করে তেলাপিয়ার বাজার মূল্য কেজি প্রতি ৬০-১২০ টাকার মধ্যে থাকে (Galib and Mohsin, 2011)।
তথ্য সূত্র (References)
- Bailey M and Stanford G (1999) Practical Fishkeeping, published by Sebastian Kelly, 2 Rectory Road, Oxford OX4 IBW, 128 p.
- Cambray J and Swartz E (2007) Oreochromis mossambicus. In: IUCN 2013. IUCN Red List of Threatened Species. Version 2013.2. Downloaded on 11 May 2014. www.iucnredlist.org.
- Fishbase (2014) Species Summary: Oreochromis mossambicus (Peters, 1852), Mozambique tilapia. Retrieved on May 11, 2014.
- Galib SM and Mohsin ABM (2011) Cultured and Ornamental Exotic Fishes of Bangladesh: Past and Present. LAP LAMBERT Academic Publishing. 176pp.
- Hussain MG (2004) Farming of Tilapia Breeding Plans, Mass Seed Production and Aquaculture Techniques, published by Habiba Akter Hussain, 55 Kristawpur, Mymensingh 2200, Bangladesh, 149 p.
- Khaleque MA (2002) Bideshee Maachher Chas O Bebasthapana (A book on Fish Culture and Management of Exotic Fishes; in Bengali), published by Mahmuda Begum Jusi, Pallabi, 8/A Jamir Munshi Lane, Mymensingh 2200, Bangladesh, 93 p.
- Rahman AKA (2007) Exotic fishes and their impact on environment, 16th Annual General Meeting and National Conference 2007, Zoological Society of Bangladesh, 30 March, Dhaka, Bangladesh, pp.26-39.
- Shammi QJ and Bhatnagar S (2002) Applied Fisheries, Published by Agrobios (India), Agro House, Behind Nasrani Cinema, Chopasani Road, Jodhpur 342 002, India, 328 p.
- Sultana S (2014) Mozambique Tilapia, Oreochromis mossambicus. BdFISH Feature. Retrieved on May 11, 2014.
- Talwar PK and Jhingran AG (1991) Inland Fishes of India and Adjacent Countries, Vol. 2, Oxford and IBH Publishing Co. Pvt. Ltd. New Delhi-Calcutta, India, pp. 533-1158.
- Yadav BN (1997) Fish and Fisheries, Daya Publishing House, 1123/74 Deva Ram Park, Tri Nagar, Delhi 110035, India, 366 p.
Visited 2,968 times, 1 visits today | Have any fisheries relevant question?