পটকা

প্রায় গোলাকার দেহাকৃতির এই মাছের মুখ আকারে ক্ষুদ্র ও কিছুটা নিম্নমুখী। স্বাদুপানিতে ২ প্রজাতির পটকা মাছ পাওয়া গেলেও যে প্রজাতির পটকা মাছ সবচেয়ে বেশী পাওয়া যায়, তার বৈজ্ঞানিক নাম Tetraodon cutcutia এবং ইংরেজী নাম Ocellated pufferfish। স্থানীয়ভাবে এটি টেপা মাছ নামেও পরিচিত। এদের এ মাছের দেহের উপরের অংশের বর্ণ হলুদ মিশ্রিত সবুজ এবং উদর অংশ সাদাটে। এদের দেহের পার্শ্বরেখায় কালো রংয়ের একটি ফোঁটা বিদ্যমান এবং পার্শ্বরেখা অঙ্গ ২টি। এদের সকল পাখনা গোলাকার এবং ধূসর বর্ণের।

চলনবিল এলাকায় প্রাপ্ত পটকা মাছ দৈর্ঘ্যে প্রায় ১৫ সে.মি. হওয়ার রেকর্ড রয়েছে কিন্তু সচরাচর ৫-৯ সে.মি. আকারের পটকাই বেশী চোখে পড়ে। বর্ষাকালে বিল এলাকার প্রায় সর্বোত্রই এই মাছ পাওয়া যায়। এ বিলে প্রাপ্ত পটকা মাছের প্রজাতিটি সাধারণত নদী-নালা, খাল-বিল, হাওর-বাওড় সহ অন্যান্য স্বাদুপানির জলাশয়েও বাস করে। বর্ষাকালে প্লাবিত ধান ও পাট ক্ষেতে এদের উপস্থিতি লক্ষণীয়। পটকা মাছ ধরার পর পানি থেকে ডাঙায় আনলে এরা এদের অন্ননালী বাতাস দ্বারা বলের মত ফুলিয়ে রাখে যার ফলে এরা ডাঙায় বেশ কিছু সময় বেঁচে থাকতে সক্ষম হয়। আমাদের দেশে সামুদ্রিক পটকা মাছের প্রায় ২০ টি প্রজাতি পাওয়া যায় বলে ধারণা করা হলেও সঠিক ও সুনির্দিষ্ট কোন তথ্য বর্তমানে নেই।

আমাদের দেশে অধিকাংশ মানুষ পটকা মাছ না খেলেও নদী, বিল, হাওর, মোহনা ও উপকূলীয় এলাকার অনেকেই এ মাছটি খেয়ে থাকেন। পটকা মাছ খেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়া বা মারা যাবার ঘটনাও খুবই সাধারণ। সমপ্রতি নাটোর, কিশোরগঞ্জ, নরসিংদী ও ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পটকা মাছ খেয়ে মানুষ মারা যাবার ঘটনা ঘটেছে। উল্লেখ্য যে, আমাদের দেশে প্রাপ্ত স্বাদুপানির সব পটকা মাছই বিষাক্ত এবং এর বিষাক্ততার মাত্রা বিভিন্ন ঋতুতে বিভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে। যেমন বর্ষাকালে একটি পটকা মাছ বিষাক্ত হলেও গ্রীষ্মকালে সেই মাছটি বিষাক্ত নাও হতে পারে। তবে বর্ষাকালে অর্থাৎ পটকা মাছের প্রজনন ঋতুতে এদের বিষাক্ত হবার সম্ভাবনা ও মাত্রা বেশী থাকে। গবেষণায় দেখা গেছে যে, বিষাক্ত পটকা মাছের চামড়া, ডিম্বাশয় বা শুক্রাশয় এবং যকৃৎ -এ বিষাক্ততার মাত্রা সর্বাধিক হয়। বর্ষাকালে কালে সাধারণত পটকা মাছ বংশবৃদ্ধির উদ্দেশ্যে ডিম দিয়ে থাকে। অর্থাৎ এসময় পটকা মাছের পেটে ডিম থাকে এবং বিষ সমৃদ্ধ এ ডিমওয়ালা মাছ খেলে প্রথমত অসুস্থ এবং পরবর্তীতে মারা যাবার সম্ভবনাও থাকে।

আমাদের দেশে অনেক মানুষের ধারণা সঠিকভাবে রান্না করলে পটকা মাছের বিষ নষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু গবেষণায় দেখা গেছে এই ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। উচ্চ তাপেও পটকা মাছের বিষাক্ততার তেমন কোন পরিবর্তন হয় না। পটকা মাছ খাওয়ার ফলে বিষাক্রান্ত মানুষের হৃদযন্ত্রের রক্ত সঞ্চালন খুবই অল্প সময়ের মধ্যে বন্ধ হয়ে যায় এবং এই সময়ের মধ্যে আক্রান্ত ব্যক্তিকে সঠিক চিকিৎসা প্রদান করা সম্ভব না হলে মারা যেতে পারে। আবার এ বিষ অম্লীয় পরিবেশে অধিক সক্রিয় হয়ে থাকে তাই খালি পেটে পটকা মাছ খেয়ে বিষক্রিয়ায় আক্রন্ত হয়ে মারা যাবার আনেক বেশী।

যেহেতু পটকা মাছের বিষাক্ততা স্থান ও কালভেদে বিভিন্ন হয়ে থাকে তাই কোন নির্দিষ্ট মাছ বিষাক্ত কিনা তা নির্ণয় করা বেশ কঠিন এবং সাধারণ মানুষের কাছে তা প্রায় অসম্ভব। তবে সহজ পরীক্ষার মাধ্যমে এর বিষাক্ততা সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া যেতে পারে। তা হচ্ছে রান্না করা পটকা মাছ মুরগী বা এ জাতীয় পোষা প্রাণিকে খাওয়ানোর পর যদি অল্প সময়ের মধ্যে (প্রায় ৫ মিনিট) সেটি মারা যায় তবে মাছটি খুবই বিষাক্ত বলে বিবেচিত হবে এবং কোন অবস্থাতেই এ মাছ খাওয়া যাবে না। আর যদি মাছ খাওয়ার প্রায় ২০-৩০ মিনিট পর অসুস্হ বা মারা গেলে সেটি অপেক্ষাকৃত কম বিষাক্ত বলে বিবেচিত হবে তবে অবশ্যই মানুষের খাওয়ার উপযোগী বলে বিবেচিত হবে না।

বর্তমানে বাংলাদেশ সরকারের মৎস্য ও পশুসম্পদ মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে দেশের বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে পটকা মাছ খাওয়া থেকে বিরত থাকার জন্য গণসচেতনামূলক প্রচারণা চললেও দেশের অনেক মানুষের কাছে বিশেষ করে গ্রামীণ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মানুষের কাছে সেটি অজানা থেকে যাচ্ছে এবং পটকা মাছ খেয়ে অসুস্থ বা মারা যাবার মত মর্মান্তিক দুর্ঘটনা অব্যহত আছে। এজন্য সরকারের পাশাপাশি এন.জি.ও এবং দেশের সচেতন নাগরিকদের এগিয়ে আসতে হবে এবং পটকা মাছের বিষক্রিয়া সম্পর্কে দেশের জনগোষ্ঠীর অসচেতন অংশকে সচেতন করতে হবে। সর্বোপরি পটকা মাছ খাওয়া হতে বিরত থাকাই সবচেয়ে নিরাপদ।

তথ্যসূত্রঃ
ইসলাম, শ. মো.; ১৭ জুন ২০০৮। একটি পটকা মাছের বিষে ৩০ জন মানুষের মৃত্যু হতে পারে। প্রথম পাতা, প্রথম আলো অনলাইন সংস্করণ।

মাহমুদ, ই.; ১৭ মে ২০০৮। পটকা মাছে বিষ। ক্ষেতখামার, প্রথম আলো অনলাইন সংস্করণ।

শফি, মো. এবং কুদ্দুস, মি. মু. আ.; ১৯৮২। বাংলাদেশের মাৎস্য সম্পদ। ১ম সংস্করণ। বাংলা একাডেমী, ঢাকা, বাংলাদেশ। মো. পৃ. xii+৪৪৪।

Rahman, A K M; 2005. Freshwater Fishes of Bangladesh, 2nd Edition. Zoological Society of Bangladesh, Department of Zoology, University of Dhaka, Dhaka, Bangladesh, XVIII+394 pp.

Talwar, P.K. and A.G. Jhingran; 1991. Inland Fishes of India and Adjacent Countries. Oxford and IBH Publishing Co. Pvt. Ltd., New Delhi, India. LIV + 1158 pp.

www.fishbase.org


Visited 2,926 times, 1 visits today | Have any fisheries relevant question?
পটকা

Visitors' Opinion

শামস মুহাম্মদ গালিব

প্রভাষক, ফিশারীজ বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী, বাংলাদেশ। প্রাক্তন শিক্ষার্থী, ফিশারীজ বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী-৬২০৫, বাংলাদেশ। বিস্তারিত ইমেল: thegalib@gmail.com

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.