মানুষ ও অন্যান্য প্রাণী বেঁচে থাকার জন্য যেমন পরস্পরের উপর নির্ভরশীল তেমনি উভয়েই তার চারপাশের প্রাকৃতিক পরিবেশের উপরেও নির্ভরশীল। প্রকৃতিতে শক্তির রূপান্তরের প্রক্রিয়াটি আপন নিয়মেই চলে। কিন্তু গত কয়েক শত বছর ধরে মানুষ হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রকৃতির রূপান্তরের এক বড় নিয়ামক। সাম্প্রতিক সময়ে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রগতির ফলে পৃথিবীর বুকে গড়ে উঠেছে অসংখ্য কলকারখানা আর যান্ত্রিক বাহন। দুরন্ত গতিতে যেমন বেড়েছে খনিজ তেল, গ্যাস ও কয়লার ব্যবহার তেমনি আসবাবপত্র, ঘরবাড়ি, জ্বালানী ও কৃষি জমির জন্য উজাড় করে ফেলছে গাছপালা । নগরায়ন ও শিল্পায়নে খনিজ জ্বালানির ব্যবহার বেড়েছে অতি দ্রুত ফলে অসংখ্য কলকারখানার ক্ষতিকর গ্যাস ও বর্জ্য পদার্থ প্রকৃতিতে মিশে ব্যাহত করছে প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য। এর ক্ষতিকর প্রভাব দেখা দিচ্ছে আবহাওয়া ও জলবায়ুর উপর (পরিবেশ অধিদপ্তর, ২০০৯)। মূলত মানুষ কর্তৃক পরিচালিত নানা কর্মকাণ্ড থেকে দীর্ঘদিন ধরে উৎসারিত এবং বায়ুমণ্ডলে পুঞ্জীভূত গ্রীন হাউজ গ্যাসের কারণে বৈশ্বিক উষ্ণতা বেড়েছে (আহমদ, ২০০৮) । আইপিসিসি এর মতে আগামী শতকের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত যে পরিমাণ কার্বন-ডাই-অক্সাইড বায়ু মণ্ডলে সঞ্চিত হবে তার ফলে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা ১.৫ থেকে ৪.৫ ডিগ্রি পর্যন্ত বাড়বে। তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও অন্যান্য মানব সৃষ্ট কারণের ফলশ্রুতিতে ঘটে যাওয়া পরিবেশ পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশের মৎস্য খাতে নিম্নলিখিত সমস্যা দেখা দেবে যার অনেকগুলো এরই মধ্যে দেখা দিতে শুরু করেছে –
.
মৎস্য খাতের উপর পরিবেশ দুষনের প্রভাবঃ
- সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাবে ফলে বাংলাদেশের ১২০ হাজার বর্গ কিলোমিটার এলাকা প্লাবিত হবে। এছাড়া বাড়বে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ও সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা। যার ফলশ্রুতিতে নদীর পানি বাড়বে ফলে ভয়াবহ বন্যা দেখা দেবে যা চাষকৃত পুকুর, ডোবা, ঘের, পেন প্রভৃতি মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হবে।
- শুকনো মৌসুমে নদীর পানি হ্রাস পাবে ও ক্ষীণ প্রবাহের কারণে লোনা পানি দেশের অভ্যন্তরের নদীতে অনেক উজান পর্যন্ত প্রবেশ করবে ফলে মিঠাপানির জীববৈচিত্র্য হুমকীর সম্মুখীন হয়ে পড়বে।
- নদীতে অপরিকল্পিত বাঁধ দেয়ার ফলে নদীর প্রবাহ কমে যাচ্ছে। এতে করে নদীর গভীরতা হ্রাস, চরের সৃষ্টি ও মাছের প্রজনন ক্ষেত্র বিনষ্ট হচ্ছে, মাছের রেনু হ্রাস পাচ্ছে ফলশ্রুতিতে মাছের উৎপাদন কমছে (মৎস্য পক্ষ, ২০০২)।
- শিল্প কলকারখানার বর্জ্য সরাসরি নদী/নালার পানিতে ফেলা ও কৃষি জমিতে কীটনাশক ব্যবহারের কারণে মাছের স্বাভাবিক বাসস্থান নষ্ট হচ্ছে, অনেক ক্ষেত্রে মাছ বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছে ফলে অনেক মৎস্য প্রজাতিই আজ বিলুপ্তির পথে।
.
দুষণ প্রতিরোধ ও দূর্যোগ মোকাবেলায় করণীয়ঃ
- কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্যাস নির্গমনের পরিমান কমানো ও নির্গত গ্যাস শুষে নেবার ক্ষমতা বাড়ানো অত্যন্ত প্রয়োজন।
- বন্যা প্লাবিত নিম্নাঞ্চল ও লবনাক্ত অঞ্চলে মৎস্য চাষের বিশেষ পদ্ধতি/কৌশল প্রবর্তন ।
- লবন ও খরা সহিষ্ণু উন্নত জাতের মৎস্য উদ্ভাবনে কর্মসূচী হাতে নেয়া প্রয়োজন এবং সময়ে সময়ে তার মূল্যায়ন প্রয়োজন।
- ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের প্রাক পূর্বাভাস প্রদানে বিজ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে কম্পিউটার প্রোগ্রামের সাহায্যে বিভিন্ন মডেলের ব্যবহার করে আগাম সতর্ক সংকেতের প্রদানের সময়কাল বাড়িয়ে যথাস্থানে সহজ ভাষায় মানুষের কাছে পেঁছানো হলে তৃণমূলের চাষীসহ অন্যান্য মানুষ ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা ব্যাপকভাবে কমিয়ে আনা সম্ভব হবে (আহমেদ, ২০০৫) ।
- বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধে ফিশ পাসের ব্যবস্থা রাখা যাতে মাছ প্রয়োজনে বাঁধের দুপাশের জলাশয়ে চলাফেরা করতে পারে।
- কলকারখানার বর্জ্য পানিতে না ফেলা ও জমিতে কীটনাশক এর ব্যবহার কমিয়ে আনা এবং পরিবেশ বান্ধব কীটনাশক ব্যবহার।
- সর্বোপরি পরিবেশ দুষণ, দুষনের প্রভাব ও পরিবর্তিত পরিবেশ সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করা যাতে সকলের অংশগ্রহনের মাধ্যমে পরিস্থিতি মোকাবেলা করা সম্ভব হয়।
.
তথ্যসূত্রঃ
- আহমেদ, আ. উ. (২০০৫), এডাপটেশন অপশনস ফর ম্যানেজিং ওয়াটার রিলেটেড এক্সট্রিম ইভেন্টস আন্ডার ক্লাইমেট চেঞ্জ রেজিমঃ বাংলাদেশ পারস্পেকটিভস, অন্তর্ভূক্ত মোঃ ম. কা. মীর্জা ও কা. খ. আহমদ (সম্পাদিত), ক্লাইমেট চেঞ্জ এন্ড ওয়াটার রিসোর্সেস ইন সাউথ এশিয়া, বালকেমা প্রেস, লাইডেন, পৃষ্ঠাঃ ২৫৫-২৭৮।
- আহমদ, কা. খ. (২০০৮), জলবায়ু পরিবর্তন ও বাংলাদেশ, গ্রামীন জীবনযাত্রার স্থায়ীত্বশীল উন্নয়নের জন্য প্রচারাভিযান, বাড়ি-৪, সড়ক-৩, ব্লক- আই, বনানী, ঢাকা-১২০৩, পৃষ্ঠাঃ ১-১৪।
- পরিবেশ অধিদপ্তর, (২০০৯), জলবায়ু পরিবর্তন ও বাংলাদেশ, পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়, গনপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার, পৃষ্ঠাঃ ১-৬।
- মৎস্য অধিদপ্তর, (২০০২), মৎস্য পক্ষ সংকলন, মৎস্য ও পশু সম্পদ মন্ত্রণালয়, গনপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার, পৃষ্ঠা ৬৬।
Visited 556 times, 1 visits today | Have any fisheries relevant question?