সহজ কথায় মাছ শুকিয়ে সংরক্ষণ করার প্রক্রিয়াকে শুঁটকীকরণ বলা হয়ে থাকে। সাধারণত মাছের মধ্যস্ত জলীয় অংশ সুর্যের আলো বা তাপ প্রয়োগ অথবা অন্য কোন পদ্ধতিতে শুকিয়ে দীর্ঘ্য দিন সংরক্ষণ করা হয়ে থাকে। আমাদের দেশের বেশিরভাগ শুঁটকি তৈরি করা হয় সনাতন পদ্ধতিতে।
মাছের শুঁটকী প্রস্তুত, সংরক্ষণ, মজুদ ও বাজারজাতকরণ প্রক্রিয়াটি ধারাবাহিকভাবে নিচে দেয়া হল (চিত্র-১) –
ধাপ-১। মাচা, বাঁশের রেলিং বা মই তৈরী
ধাপ-২। মাছ সংগ্রহ বা মাছ আহরণ
ধাপ-৩। সতেজ মাছ বাছাই ও গ্রেডিং
ধাপ-৪। আঁইশ ছাড়ানো ও পরিষ্কারকরণ
ধাপ-৫। ধৌতকরণ ও লবন মিশ্রিতকরণ ও পুনঃধৌতকরণ
ধাপ-৬। আবহাওয়া খারাপ হলে সরবিকম মিশানো
ধাপ-৭। মাছ রোদে শুকানো
- মাচায় বিছিয়ে দেওয়া বা রেলিং/মইয়ে ঝুলিয়ে দেয়া
- ওলট-পালট করে দেয়া
- পচন পরীক্ষা করা
ধাপ-৮। মাছ মজুদকরণ
- মাছকে স্বাভাবিক তাপমাত্রায় নিয়ে আসা
- ঠান্ডা ও শুষ্কস্থানে প্যাকেট নিয়ে আসা
ধাপ-৯। বাজারজাতকরণ
.
নিচে সনাতন পদ্ধতিতে দেশের উপকূলীয় এলাকায় সামুদ্রিক মাছ শুঁটকীকরণের প্রক্রিয়াটি বিস্তারিত বর্ণনা দেয়া হল যার প্রধান প্রধান ধাপ হচ্ছে-
ক. মাচা ও বাঁশের রেলিং বা মই তৈরী
খ. মাছ সংগ্রহ
গ. শুঁটকীর জন্য ব্যবহৃত মাছের প্রজাতি নির্বাচন
ঘ. সতেজ মাছ বাছাই ও গ্রেডিং
ঙ. আঁইশ ছাড়ানো, পরিষ্কারকরণ ও লবন মিশ্রিতকরণ
চ. মাছ রোদে শুকানো
ক. মাচা ও বাঁশের রেলিং বা মই তৈরী:
প্রতি বছর শুকনা মৌসুমে বাঁশের বড় বড় মাচা তৈরী করা হয়। এসকল বাঁশের মাচা তৈরিতে জাল, রশি ও দড়ি ব্যবহৃত হয়। বাঁশের রেলিং বা মই এর ক্ষেত্রে বাঁশ শক্ত করে খুঁটির ন্যয় মাটিতে পুঁতে সেই বাঁশগুলির সাথে আড়াআড়িভাবে আরও বাঁশ বেধে দেওয়া হয়। বাঁশের মাচাগুলো সাধারণত পূর্ব-পশ্চিম বরাবর স্থাপন করা হয় এবং বাঁশের মই বা রেলিংগুলোকে উত্তর-দক্ষিণ বরাবর স্থাপন করা হয় যেন সর্বাধিক সূর্যালোক পাওয়া যায়। প্রতিটি মাচা ২০-২৫ ফুট প্রস্থ, ৩০-৪০ ফুট দীর্ঘ এবং ৪-৫ ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট হয়ে থাকে। বাঁশের মইগুলো সাধারণত ২০-২৫ ফুট উচ্চতা ও ৪০-৫০ ফুট দৈর্ঘ্য বিশিষ্ট হয়ে থাকে।
খ. মাছ সংগ্রহ:
বঙ্গোপসাগরের নিকটবর্তী এলাকায় সামুদ্রিক মাছই ব্যবহৃত হয়ে থাকে। সাগর থেকে বিভিন্ন ধরনের মৎস্যযান ও মাছ আহরণের সরঞ্জাম ব্যবহার করে এসকল মাছ সংগ্রহ করা হয়।
গ. শুঁটকী জন্য ব্যবহৃত মাছের প্রজাতি নির্বাচন:
উপকূলীয় এলাকায় যে সকল সামুদ্রিক মাছ শুঁটকী তৈরিতে সবচেয়ে বেশী ব্যবহৃত হয় সেগুলো হচ্ছে- ছুরি, লইট্যা, চাপা, পোয়া, রূপচাঁদা, ফেসা প্রভৃতি।
ঘ. সতেজ মাছ বাছাই ও গ্রেডিং:
ভাল সতেজ মাছগুলি বাছাই করে তা আকার ও প্রজাতি অনুসারে পৃথক বা গ্রেডিং করা হয়।
ঙ. আঁইশ ছাড়ানো, পরিষ্কারকরণ ও লবন মিশ্রিতকরণ:
মাসসমূহ গ্রেডিংয়ের পর প্রয়োজন অনুসারে আঁইশ ছাড়ানো হয় এবং পেট কেটে অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গসমূহ ফেলে দেওয়া হয়। সাধারণত মহিলারা এই কাজটি করে থাকেন। এরপর মাছগুলি ধুয়ে লবন মিশিয়ে সারারাত রেখে দেওয়া হয় এবং পরবর্তীতে আবারও পরিষ্কার পানি দিয়ে ধুয়ে রোদে শুকানো হয়।
চ. মাছ রোদে শুকানো:
মাছ পরিষ্কার করে সেগুলোকে প্রজাতিভেদে মাচায় ও বাঁশের মই বা রেলিং-এ সাজানো হয়। রেলিংয়ে মাছ সাজানোর পূর্বে মাছগুলোকে চিড়ে ফাঁকা করে দেয়া হয় যেন ভালভাবে সূর্যালোকে শুকাতে পারে। সাধারণত ছুরি মাছ সূতা দ্বারা বেধে রেলিংয়ে ঝুলিয়ে দেয়া হয়। মাচায় সাজানো মাছগুলোকে সার্বক্ষণিক ওলট-পালট করে দেয়া হয় যাতে মাছের সম্পূর্ণ শরীরে ভালভাবে রোদ পায়। এর মাঝে আবার কোন মাছে পচন ধরেছে কিনা তা লক্ষ্য রাখা হয়। ছোট আকারের মাছ শুকাতে ৫-৬ দিন এবং বড় মাছ শুকাতে ১০-১২ দিন বা কমপক্ষে এক সপ্তাহ সময় লাগে। কখনো কখনো আবহাওয়া খারাপ থাকলে (৩-৪ দিন রোদ না থাকলে) তারা পরিস্কার মাছগুলোর সাথে ’সরবিকাম’ অর্থাৎ ক্যালসিয়াম প্রোপিওনেট ব্যবহার করে যা মাছের পচন রোধে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। মাছ শুকানোর সময় মাচার চারপাশে বা কখনও কখনও মাচার মাছগুলির উপর জাল বিছিয়ে দেয়া হয় পাখি বা অন্য কোন মাংসাশী প্রাণী হতে রক্ষা করার জন্য।
মাছ শুঁটকীকরণের পাশাপাশি উৎপাদিত শুঁটকী সংরক্ষণ তথা মজুদ ও বাজারজাত করণ খুবই পারস্পারিক সম্পর্কিত একটি বিষয়। নিচে শুঁটকী মজুদ ও বাজারজাতকরণের পদ্ধতিটি সংক্ষেপে বর্ণনা করা হল-
শুঁটকী মজুদকরণ:
মাছ রোদে শুকানোর পর সেগুলোকে রোদ হতে উঠিয়ে সাথে সাথে মজুদ করা হয় না। স্বাভাবিক তাপমাত্রায় আনার পর তাদের মজুদ করা হয়। শুঁটকী মাছগুলোর গুণগত মান বিচার করে চটের বস্তা, নাইলনের বস্তা বা বাঁশের ডালি অথবা ঝুড়িতে মজুদ করা হয় এবং ঠান্ডা ও শুষ্ক স্থানে রাখা হয়।
বাজারজাতকরণ:
নাজিরারটেক শুঁটকী পল্লীর মৎস্যজীবীগণ তাদের উৎপাদিত বা প্রস্তুতকৃত শুঁটকী সরাসরি পাইকারের কাছে বিক্রি করে আবার খুচরা বিক্রেতাগণও যদি সেখানে যায় তাহলে তাদের কাছেও বিক্রি করে। পাইকার কিংবা খুচরা বিক্রেতাগণ এর কাছে বাড়ি থেকে শুঁটকী বিক্রির কাজে প্রধানত মহিলারা নিযোজিত থাকেন। কখনও কখনও পাইকারগণ এর সাথে পূর্বে থেকেই বন্দোবস্ত করা থাকে এবং শুঁটকী তৈরী হলে মৎস্যজীবী পুরুষেরা নির্দিষ্ট পরিমাণ শুঁটকী ভ্যান, ঠেলা গাড়িতে করে পাইকারের কাছে পৌঁছিয়ে দেন। তবে একসাথে অনেক বেশি পণ্য পাইকারের কছে পৌঁছাতে হলে কয়েকজন মিলে মিনি ট্রাক ভাড়া করে তা নির্দিষ্ট স্থানে স্থানে পাইকারদের নিকট পৌঁছিয়ে দেয়।
.
Visited 890 times, 2 visits today | Have any fisheries relevant question?