পৃথিবীর অসংখ্য প্রাণীর কথা আমাদের জানা থাকলেও একস্থানে সব প্রাণীর দেখা পাওয়া অসম্ভব। কিন্তু সে সুযোগ করে দেয়াই প্রাণী জাদুঘরের মহত্ব। সে প্রাণীজগতের গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ মাছ, পৃথিবীজুড়ে যার প্রজাতির সংখ্যা ৩২ হাজারেরও বেশি আর এর মধ্যে বাংলাদেশে রয়েছে ৭৫০ প্রজাতি। মৎস্য প্রজাতির সংখ্যার দিক থেকে এশিয়ায় চিন এবং ভারতের পরই বাংলাদেশের অবস্থান। মৎস্যবৈচিত্র্যে ভরপুর এদেশের সব প্রজাতিকে সম্ভব না হলেও স্বাদুপানির ২৬৫ প্রজাতির মাছের মধ্যে ২৩০ প্রজাতিকে একস্থানে দেখার বিরল সুযোগ করে দিয়েছে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাৎস্যবিজ্ঞান অনুষদের মৎস্য জাদুঘর যার নাম দেয়া হয়েছে- ফিশ মিউজিয়াম এন্ড বায়োডাইভার্সিটি সেন্টার, সংক্ষেপে এফএমবিসি।
সহজেই মাছের সঙ্গে পরিচিত হতে পারা, বিলুপ্ত এবং বিলুপ্তপ্রায় সব স্বাদুপানির ও সামুদ্রিক মাছ এবং জলজ প্রাণী সংরক্ষণের মাধ্যমে ভবিষ্যৎ গবেষণা কার্যক্রম এগিয়ে নেয়া এ মৎস্য জাদুঘর প্রতিষ্ঠার অন্যতম উদ্দেশ্য। সে লক্ষ্যে গত বছরের আগস্টে সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া জাদুঘরটির অবকাঠামোগত কাজ শুরু হয় সে বছরেরই জুনে। কিন্তু এর দশ বছর আগে থেকেই নমুনা সংগ্রহের কাজ শুরু করেন বাকৃবির ফিশারিজ বায়োলজি এন্ড জেনেটিক্স বিভাগের প্রফেসর ড. মোস্তাফা আলী রেজা হোসেন ও যুক্তরাজ্যের স্টারলিং বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়ন লেকচারার ড. সিন। মূলত তাঁদের উদ্যোগেই জাদুঘরটি এই পর্যায়ে আসতে পেরেছে। উদ্যোক্তাদের সহযোগিতায় ছিলেন কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাৎস্যবিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন নজরুল ইসলাম ও বর্তমান ডিন আবদুল ওহাবসহ অনুষদের অন্যান্য শিক্ষক ও গবেষকেরা। এপর্যায়ে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের সিনিয়র ইনস্ট্রাক্টর, ফিশারিজ বায়োলজি এন্ড জেনেটিক্স বিভাগের পিএইচডি ফেলো ও ফিশ মিউজিয়ামের কার্যক্রমের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নাহিদুজ্জামান এর নামটি উল্লেখ না করলেই নয়।
মোট পাঁচটি কক্ষ নিয়ে সাজানো এ জাদুঘরটির প্রথম কক্ষটির শিরোনাম ফ্রেশওয়াটার ডলফিন এন্ড ফিশ, দ্বিতীয়টির এনসিয়েন্ট সি এন্ড মিডিয়া, তৃতীয়টির সিলোরিফরমিস বা বিড়াল জাতীয় মাছ, চতুর্থটির সিপ্রিনিফরমিস বা কার্প জাতীয় মাছ এবং পঞ্চম কক্ষের শিরোনাম পার্সিফরমিস বা কই জাতীয় মাছ। এছাড়াও জাদুঘরের করিডোরে আছে আবহমানকাল ধরে এ দেশের জেলেদের ব্যবহার্য বিভিন্ন ধরনের মাছ ধরার উপকরণ আর দেশের মাৎস্য ঐতিহ্যের ইতিহাস ও নিদর্শন। বিভিন্ন স্থান থেকে আসা শিক্ষার্থী ও দর্শনার্থীর জন্য জাদুঘর ও মাছ-সম্পর্কিত অডিও ভিজ্যুয়াল চিত্র প্রদর্শনের জন্য রয়েছে একটি সম্মেলনকক্ষ।
মাছের নমুনাগুলো বিভিন্ন আকারের কাচের জারে ফরমালিনে ডুবিয়ে রাখা হয়েছে। প্রতিটি মাছের জার বরাবর ওপরে দেয়ালে সাঁটা পোস্টারে প্রদর্শন করা হয়েছে ঐ মাছেরই পরিপক্ক বয়সের আলোকচিত্রসহ প্রচলিত ও বৈজ্ঞানিক নাম এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ তথ্য যা দর্শনার্থীদের জানার চাহিদা মেটাতে যথেষ্ট। এখানে মাছ ছাড়াও রয়েছে হাঙর, ডলফিন ও কুমিরের কঙ্কাল এবং কচ্ছপ ও বিভিন্ন প্রজাতির কাঁকড়ার নমুনা। রয়েছে বিভিন্ন বিলুপ্ত মাছের দূর্লভ সংগ্রহ। আর এই নমুনাগুলো সংগ্রহ করা হয়েছে লন্ডনের ব্রিটিশ ন্যাচারাল মিউজিয়াম, যুক্তরাজ্যের স্টারলিং বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি জেলা থেকে।
এখানে ইতিমধ্যে বাংলাদেশের স্বাদুপানির ২৬৫টি প্রজাতির মাছের মধ্যে ২৩০ প্রজাতির মাছ সংরক্ষণ করা হয়েছে। অবশিষ্ট মাছ সংগ্রহের কাজ চলছে। সংরক্ষেণের এই উদ্যোগে মাছ ছাড়াও অন্যান্য জলজ প্রাণী সংগ্রহের পরিকল্পনাও রয়েছে। জাদুঘরটিতে মাৎস্যবিজ্ঞান শিক্ষার্থীদের ব্যবহারিক ক্লাস নেওয়া হবে আর জাদুঘরটি পরিদর্শনের জন্য আপাতত কোনো টিকিট লাগবে না।
সমকালকে দেয়া সাক্ষাৎকারে জাদুঘরের পরিচালক বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাৎস্যবিজ্ঞান অনুষদের ফিশারিজ বায়োলজি এবং জেনেটিক্স বিভাগের অধ্যাপক ড. মোস্তফা আলী রেজা হোসেন বলেন, “বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, ভুটান, মিয়ানমার তথা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় কয়েকটি জাদুঘরে কিছু প্রজাতির মাছ বা মৎস্য প্রজাতি সংরক্ষণ করা হলেও শুধু মৎস্য জাদুঘর এখন পর্যন্ত কোথাও নেই”। প্রথম আলোতে দেয়া সাক্ষাৎকারে এই জাদুঘরের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে বলতে যেয়ে তিনি বলেন, ‘আরও বড় পরিসরে এটিকে সম্প্রসারণের কাজ চলছে। আগামী বছর থেকে সমুদ্রে আমদের যে ৪৭৫ প্রজাতির মাছ রয়েছে, তা সংরক্ষণের কাজ শুরু করব। অ্যাকুয়ারিয়াম ও পুকুরের মাধ্যমে জীবিত মাছ সংরক্ষণের জন্য ইতিমধ্যেই বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে ৩০টি পুকুর বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। তবে এ জন্য সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর সহযোগিতা প্রয়োজন।
প্রথম আলোকে দেয়া সাক্ষাৎকারে মাৎস্যবিজ্ঞান অনুষদের ডিন আবদুল ওহাব বলেন, ‘দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজসহ কমপক্ষে ১০টি প্রতিষ্ঠানে মাৎস্য-সম্পর্কিত বিভিন্ন বিভাগ বা কোর্স চালু থাকলেও এত বিশাল সংগ্রহশালা কোথাও নেই। শুধু বই বা ছবি দেখেই চিনতে হতো অনেক মাছ। এ ছাড়া ইতিমধ্যেই বাংলাদেশ থেকে কমপক্ষে ২০ থেকে ২৫টি প্রজাতির মাছ বিলুপ্ত হয়ে গেছে এবং আরও ৫০ প্রজাতির মাছ বিলুপ্তির পথে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এ জাদুঘর বিলুপ্ত ও বিলুপ্তপ্রায় মাছ নিয়ে ভবিষ্যৎ গবেষণার ক্ষেত্রে দেশের মাৎস্য বিজ্ঞানীদের জন্য মাইলফলক হয়ে থাকবে।’
তথ্যসূত্র:
- জাদুঘরে ২৩০ প্রজাতির মাছ, প্রথম আলো, ১৬ আগষ্ট ২০১০
- মৎস্য জাদুঘর জুলাইয়ে চালু, সমকাল, ১৪ এপ্রিল ২০১০
- Fish Museum & Biodiversity Center – FMBC, Bangladesh, Wikipedia
- Stirling University sets up Bangladesh fish museum, BBC online, 20 January 2011
কৃতজ্ঞতা:
ছবিগুলো দিয়ে সহায়তা করার জন্য অধ্যাপক ড. মোস্তফা আলী রেজা হোসেন এবং নাহিদুজ্জামান এর কাছে চির ঋণী রইলাম।
- অধ্যাপক ড. মোস্তফা আলী রেজা হোসেন, পরিচালক, ফিশ মিউজিয়াম এন্ড বায়োডাইভার্সিটি সেন্টার, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের
- নাহিদুজ্জামান, ফিশারিজ বায়োলজি এন্ড জেনেটিক্স বিভাগের পিএইচডি ফেলো ও যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের সিনিয়র ইনস্ট্রাক্টর।
Visited 1,471 times, 1 visits today | Have any fisheries relevant question?