বাংলাদেশে প্রায় ১৩ লক্ষ দিঘী পুকুর সর্বত্র ছড়িয়ে আছে (মৎস্য অধিদপ্তর, ২০০৪) এবং দেশের সর্বোচ্চ হারে (২৮৩৯ কেজি/হেক্টর) মাছের উৎপাদন আসে চাষের পুকুর ও ডোবা থেকে (FRSS, 2009)। বাংলাদেশে অন্যান্য মাছের চাষ অপেক্ষা কার্প বা রুই জাতীয় মাছের মিশ্রচাষ এখনও সর্বাধিক প্রচলিত চাষ পদ্ধতি। আমাদের দেশে চাষকৃত কার্প বা রুই জাতীয় মাছগুলির মধ্যে অন্যতম হল:
দেশীয় কার্প: রুই, কাতলা, মৃগেল ও বাটা।
বিদেশী কার্প: সিলভার কার্প, বিগহেড কার্প, কমন কার্প, মিরর কার্প, স্কেল কার্প, ব্লাক কার্প ও গ্রাস কার্প। এছাড়া বিদেশী সরপুঁটি, তেলাপিয়া ইত্যাদি মাছও এসকল প্রজাতির সাথে মজুদ করা হয়।
এখানে পর্যায়ক্রমে রুই জাতীয় মাছের মিশ্রচাষের মজুদপূর্ব ব্যবস্থাপনার বিভিন্ন বিষয়াবলী সংক্ষেপে তুলে ধরা হল-
পুকুরের স্থান নির্বাচন
যেকোনো মাছ চাষের ক্ষেত্রে পুকুরের অবস্থান একটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মাছ চাষ যাতে সহজভাবে করা যায় সেজন্য পুকুর নির্বাচন বা খননের সময় নিম্নোক্ত বিষয়সমূহ লক্ষ্য রাখতে হবে-
- নিজস্ব মালিকানাধীন (একক) হলে সবচেয়ে ভাল। লীজ নেয়া পুকুরের ক্ষেত্রে মেয়াদ কমপক্ষে ৩ বছর হলে ভাল হয়। তবে ৫ বছর হলে সবচেয়ে ভাল হয়।
- বন্যা মুক্ত স্থান ও ভাল যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং মাছ বাজারের কাছাকাছি হওয়া উচিত।
- বাড়ির নিকটে হলে ভাল, দূরে হলে যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ হতে হবে।
- দিনে পর্যাপ্ত সূর্যালোক (৬-৮ ঘণ্টা) পানিতে পড়বে এমন স্থান।
- অল্প কাদাযুক্ত দোআঁশ বা বেলে দোআঁশ মাটি পুকুরের জন্য সবচেয়ে উত্তম।
পুকুর খনন
যদি নতুন করে পুকুর খনন করতে হয় তাহলে পুকুরটি যাতে আয়তাকার বা বর্গাকার হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। আবার পুকুরের আয়তন খুব বড় হলে ব্যবস্থাপনা কঠিন হয়ে পড়ে। এজন্য ০.৩৩ একর (১ বিঘা) হতে ০.৫০ একর (১.৫ বিঘা) পুকুর উত্তম (মৎস্য অধিদপ্তর, ২০০৪)। পুকুরটিতে যাতে সবসময় কমপক্ষে ১.৫-২ মিটার পানি থাকে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। পুকুরের পাড়ের ঢাল কমপক্ষে ১.৫:২ এবং উপরিভাগ ২.৫ মিটার চওড়া হতে হবে (মৎস্য অধিদপ্তর, ২০০৪)।
পুকুর প্রস্তুতকরণ
পুকুরের পাড় ও তলা মেরামত
পানির তলদেশে ১৫ সেমি এর অধিক কাদা থাকলে তা অপসারণ করতে হবে। পুকুরের পাড় ভাঙ্গা বা ছিদ্রযুক্ত হলে তা মেরামত করতে হবে।
জলজ আগাছা নিয়ন্ত্রণ
পানি হতে অতিরিক্ত জলজ উদ্ভিদ বিশেষ করে ভাসমান জলজ উদ্ভিদ সরিয়ে ফেলতে হবে। কিছু পরিমাণ ভাসমান উদ্ভিদ পানিতে রেখে দেওয়া ভাল কারণ গরমের সময় যখন পানির তাপমাত্রা বেড়ে যায় তখন মাছ সেখানে আশ্রয় নিতে পারে।
আমাদের দেশে জলজ আগাছা অপসারণের জন্য সাধারণত শ্রম শক্তির উপর নির্ভর করা হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে কায়িক পরিশ্রমের সাথে অতিসাধারণ যন্ত্রপাতি যেমন- হাঁসুয়া, কাস্তে, কোদাল, ছাকনি, ঝুড়ি, দড়ি ইত্যাদি ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
অনাকাঙ্ক্ষিত মাছ/প্রাণী দূরীকরণ
পানি শুকিয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত প্রাণী (মাছ/সাপ/ব্যাঙ ইত্যাদি) দূর করা সবচেয়ে কার্যকরী। তবে সেটি অনেক সময় সম্ভব হয় না এবং ব্যয়বহুলও বটে। সেজন্য নিম্নোক্ত পদ্ধতিসমূহের যে কোন একটি প্রয়োগ করা যেতে পারে (মৎস্য অধিদপ্তর, ২০০৪):
উপাদান | মাত্রা/শতাংশ | পানির গভীরতা | প্রয়োগ পদ্ধতি | অবশিষ্ট বিষক্রিয়ার মেয়াদকাল |
রোটেনন | ১৮-২৫ গ্রাম | ৩০ সেমি | ৩ ভাগের বিভক্ত করে ২ ভাগ পানিতে গুলে সমস্ত পুকুরে ছিটিয়ে ও ১ ভাগ কাঁই করে ছোট ছোট বল তৈরি করে ছিটিয়ে দিতে হবে। | ৭ দিন |
তামাকের গুড়া | ০.৮-১.৫ গ্রাম | ৩০ সেমি | পাত্রে ১২-১৫ ঘণ্টা ভিজানোর পর সূর্যালোকিত দিনে ছিটিয়ে দিতে হবে। | ৭-১০ দিন |
চা বীজের খৈল | ১ কেজি | ৩০ সেমি | বালতিতে ৩-৪ গুন পানির সাথে ভালভাবে মিশিয়ে সূর্যালোকিত দিনে পানিতে ছিটাতে হবে। | ৩-৪ দিন |
সিদ্দিকী ও চৌধুরীর (১৯৯৬) অনুসারে অনাকাংঙ্খিত বা অপ্রয়োজনীয় মাছ ও ক্ষতিকর জলজ প্রাণী নিয়ন্ত্রণের জন্য নিম্নোক্ত টেবিলে উপস্থাপিত উপাদান (এক বা একাধিক) ব্যবহার করা যেতে পারে-
দ্রব্য |
মাত্রা (গ্রাম/শতক/ফুট গভীরতা) |
অবশিষ্ট বিষক্রিয়ার মেয়াদকাল (দিন) |
রোটেনন |
৩৫-৫০ |
৭-১০ |
চা-বীজের খৈল |
৩০০-৩৫০ |
৫-১০ |
মহুয়ার খৈল |
৩০০০ |
১৪-১৫ |
তেঁতুল বীজের গুড়া |
১২৫-১৭৫ |
২০-২৫ |
ব্লিচিং পাউডার |
৩৭০ |
৭-৮ |
শুকনো এমোনিয়া |
৩০০ |
২৮-৪২ |
তবে বর্তমানে আমাদের দেশের অনেক মৎস্য চাষি ফসটক্সিন ট্যাবলেট বা গ্যাস ট্যাবলেট ব্যবহার করে থাকেন। এক্ষেত্রে প্রতি শতকে ১-২ টি ট্যাবলেট প্রয়োগ করা হয়।
চুন প্রয়োগ
পানির পি.এইচ. ঠিক রাখার জন্য চুন প্রয়োগ করা হয়ে থাকে। এছাড়াও চুন নানাভাবে পানিকে মাছ চাষের উপযোগী করে, যেমন, চুন পানির তলদেশে কাদা হতে বিষাক্ত গ্যাস বের করে দেয়, চুন রোগ-জীবাণু নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে, পানি পরিষ্কার করে ইত্যাদি।
পুকুরে প্রতি শতকে ১ কেজি কলিচুন প্রয়োগ করতে হবে (মৎস্য অধিদপ্তর, ২০০৪)। চুন প্রথমে পানির সাথে মিশিয়ে তারপর তা সমভাবে পুকুরের পানিতে ছিটিয়ে দিতে হবে। পানিতে চুন মিশানোর সময় ও চুন প্রয়োগের সময় অবশ্যই সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। এটি মাটির পাত্রে চুন ঘোলানোর সময় প্রথমে পাত্রটি পানি-পূর্ণ করতে হবে এবং তারপর আস্তে আস্তে পানির মধ্যে চুন ছেড়ে দিতে হবে। চুন পুকুরে প্রয়োগের সময় অবশ্যই নাক-মুখ ঢেকে রাখতে হবে। নিম্নে চুন প্রয়োগের বিভিন্ন মাত্রা উল্লেখ করা হল (মৎস্য অধিদপ্তর, ২০০৪):
পানির পিএইচ মান |
পাথুরে চুন (কেজি/শতক) |
পোড়া চুন (কেজি/শতক) |
৩ -৫ |
১২ |
৬ |
৫ -৬ |
৮ |
৪ |
৬ -৭ |
২ |
১ |
সার প্রয়োগ
পুকুরের পানিতে ফাইটোপ্লাংকটন উৎপাদন বৃদ্ধি করার জন্য সার (জৈব এবং অজৈব/রাসায়নিক) প্রয়োগ করা হয়ে থাকে। পুকুরে চুন প্রয়োগের অন্ততঃ ৫-৭ দিন পরে রাসায়নিক সার ব্যবহার করতে হবে (মৎস্য অধিদপ্তর, ২০০৪)। টিএসপি সার পানিতে সহজে গলে না বিধায় ব্যবহারের ১০-১২ ঘণ্টা আগে এটিকে পানিতে ভিজিয়ে রাখতে হবে (মৎস্য অধিদপ্তর, ২০০৪)। পুকুর শুকনো হলে সার সমস্ত পুকুরে ছিটিয়ে লাঙ্গল বা আঁচড়ার সাহায্যে মাটিতে মিশিয়ে দিতে হবে। নিম্নে পুকুরে পোনা মজুদের পূর্বে বিভিন্ন সারের ব্যবহার মাত্রা উল্লেখ করা হল (মৎস্য অধিদপ্তর, ২০০৪)।
সারের ধরন |
সারের নাম |
প্রয়োগ-মাত্রা/শতাংশ |
জৈব সার |
গোবর অথবা মুরগীর বিষ্ঠা অথবা কম্পোষ্ট |
৫-৭ কেজি ৩-৫ কেজি ৮-১০ কেজি |
রাসায়নিক সার |
ইউরিয়া টিএসপি এমওপি//এমপি |
১০০-১৫০ গ্রাম ৫০-৭৫ গ্রাম ২০-৩০ গ্রাম |
পুনশ্চ:
রুই জাতীয় মাছের মিশ্রচাষ: মজুদ ব্যবস্থাপনা এখানে এবং মজুদ পরবর্তী ব্যবস্থাপনা এখানে।
কৃতজ্ঞতা:
লেখার ছবিগুলো দিয়ে সহায়তা করেছেন ড.এবিএম মহসিন।
তথ্যসূত্র:
বাংলা-
- মৎস্য অধিদপ্তর. ২০০৪. কার্প জাতীয় মাছের মিশ্র চাষ, সমন্বিত মৎস্য কার্যক্রমের মাধ্যমে দারিদ্র বিমোচন প্রকল্প (২য় পর্যায়), মৎস্য অধিদপ্তর, ঢাকা, পৃ. ১-২৪।
- সিদ্দিকী কা এবং চৌধুরী স.না. (সম্পা.). ১৯৯৬. মৎস্য পুকুরে মাছ চাষ ম্যানুয়াল, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব লোকাল গভর্নমেন্ট, ঢাকা, বাংলাদেশ, পৃ. ২৩৭-২৫৩।
ইংরেজি-
- FRSS (Fisheries Resource Survey System). 2009. Fisheries Statistical Yearbook of Bangladesh 2007-2008, Department of Fisheries, Ministry of Fisheries and Livestock, Bangladesh, 42 pp.
Visited 17,434 times, 2 visits today | Have any fisheries relevant question?