কৃষি নির্ভর বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে মৎস্য খাতের অবস্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও সম্ভাবনাময়। জাতীয় অর্থনীতিতে ও দারিদ্র বিমোচনে এ সম্ভাবনাময় সেক্টরের ভূমিকা ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। মোট দেশজ উৎপাদনের প্রায় ৩.৭০% মৎস্য খাতের অবদান। দেশের মোট কৃষিজ আয়ের ২২.২৩% মৎস্য খাত থেকে আসে। দেশের রপ্তানি আয়ের প্রায় ৩% আসে মৎস্য খাত থেকে। দেশের জনগোষ্ঠীর প্রায় ১০% এ খাতের বিভিন্ন কার্যক্রমে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে নিয়োজিত থেকে জীবিকা নির্বাহ করে থাকে।
সহস্রাব্দের উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় (এমডিজি) ২০১৫ সালের মধ্যে অর্জিত নির্দিষ্ট আটটি লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে দারিদ্র বিমোচন, পুষ্টির চাহিদা পূরণ, শিক্ষাক্ষেত্রে জেন্ডার সমতা আনয়ন এবং নারীর ক্ষমতায়ন অন্যতম। এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বাংলাদেশ সরকার প্রণীত দারিদ্র বিমোচন কৌশল-পত্রে মৎস্য খাতকে দারিদ্র বিমোচন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও দরিদ্র-বান্ধব অর্থনৈতিক উন্নয়নে অন্যতম প্রধান ক্ষেত্র হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। দারিদ্র বিমোচনে মৎস্য খাতের বিশেষ করে মাছ চাষ সম্প্রসারণ ও মুক্ত জলাশয়ে মৎস্য সম্পদের জৈবিক ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করার মাধ্যমে দরিদ্র-বান্ধব অর্থনৈতিক উন্নয়নের বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে।
বৃহৎ ও দ্রুত বর্ধনশীল জনসংখ্যা এবং নিম্ন মাথাপিছু আয় বাংলাদেশের অর্থনীতিতে অধিকাংশ লোকের চরম দরিদ্রতা নির্দেশ করে। ব্যাপক অর্থে দারিদ্র বলতে জনগণের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও মানবিক বঞ্চনাকে বোঝায় যা বেঁচে থাকার জন্য ন্যূনতম সম্পদের নিয়ন্ত্রণ এবং যথার্থ পরিমাণ মালিকানা না থাকায় উদ্ভূত হয়। বাংলাদেশের উন্নয়নের তথা মানব সম্পদ উন্নয়নের প্রধান অন্তরায় হল দরিদ্রতা।
বাংলাদেশের দারিদ্রের প্রধান কারণসমূহ মূলত: নিম্ন অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, অসম আয় বণ্টন, উৎপাদনশীল সম্পদের অসম বণ্টন, বেকারত্ব, জনসংখ্যার উচ্চ প্রবৃদ্ধি-হার, প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং গণ সেবায় সীমিত প্রবেশাধিকার। যার ফলে দেশের এক শ্রেণীর জনগোষ্ঠীকে জীবনের অধিকাংশ সময় অনেক দুঃখ-দুর্দশা সয়ে খেয়ে না খেয়ে জীবন ধারণ করতে হয়। কিন্তু দারিদ্রের এই করুন পরিণতির কারণগুলোকে দূরে সরিয়ে জাতিকে উন্নয়নের জোয়ারে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারে মৎস্য চাষ যার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রয়েছে জয়পুরহাট জেলার অন্তর্গত পুরানাপৈল গ্রামে।
জয়পুরহাট জেলা সদরের একটি ছায়া সুনিবিড় গ্রাম পুরানাপৈল। ২০০১ সালের কথা। শুকুন মন্ডল ছিলেন ঐ গ্রামের একজন হত দরিদ্র চাষি। প্রায় ভূমিহীন অবস্থার এ চাষির ছিল চার ছেলে ও দুই মেয়ে। বড় ছেলের নাম আব্দুল হাসান মন্ডল, বয়স প্রায় ২৫ বছর। বাবা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ায় বড় ভাই হিসেবে তাকেই পুরো সংসারের দায়িত্ব নিতে হল। সম্পদ বলতে তাদের কিছুই ছিল না। ছিল একটি মাত্র ছনের ঘর, বৃষ্টি আসলেই চাল বেয়ে পানি পড়ত। খুবই অভাব ছিল তাদের যেন নুন আনতে পান্তা ফুরায় অবস্থা।
মনে অনেক আশা, অনেক স্বপ্ন যুবক হাসানের। ছোট একটা ঝাঁকি জাল ছিল তার। সে জাল দিয়ে খালে-বিলে মাছ ধরত আর সেসব মাছ বাজারে বিক্রি করে কোন রকমে খেয়ে না খেয়ে সংসার চালাত। এমন সময় হাসান তাদের গ্রামের ইউপি সদস্য বিশ্বনাথ সরকারের বাড়িতে জমিজমা দেখাশোনার জন্য এক বছরের কাজ পায়। এভাবে জীবন চলার একটা সাময়িক পথ খুঁজে পায় এবং এক বছরে সে প্রায় হাজারখানেক টাকা জমাতে সক্ষম হয়। এই টাকাই ছিল তার জীবনের বড় হয়ে ওঠার সিঁড়ি।
২০০৩ সালে এই হাজারখানেক টাকাকে মূলধন করে সে গ্রামের মোঃ জলিল মণ্ডলের একটি বন্যায় ডোবা পুকুর ২০০০ টাকার (যার মধ্যে নগদ ১০০০ টাকা এবং বাকী ১০০০ টাকা) বিনিময়ে এক বছরের জন্য ইজারা নেয়। পুকুর নেয়ার পর সে জেলা মৎস্য অফিসে যায় এবং জেলা মৎস্য কর্মকর্তার পরামর্শ অনুসারে মাছ চাষ শুরু করে। মাছ চাষের মূলধন হিসেবে কিছুই ছিল না তার। অন্যের বাড়িতে দিন মজুরের বিনিময়ে যা আসত তার একটা অংশ দিয়ে সে সার কিনে পুকুরে দিত। বিভিন্ন জায়গা থেকে গোবর কুড়িয়ে এনে সে পুকুরে দেওয়ার চেষ্টা করতো। এভাবে মাছ চাষ করে প্রথম বছরে সে ১৫০০০ টাকা মুনাফা করে।
পরবর্তী বছর এই ১৫ হাজার টাকা দিয়ে সে জলিল মণ্ডলের আরও তিনটি পুকুর তিন বছরের জন্য ইজারা নেয়। এভাবে মাছ চাষ করে পরের বছর সে খরচ বাদ দিয়ে প্রায় ৪০,০০০ টাকার মত মুনাফা করে। তখন সে কিছুটা স্বচ্ছলতার মুখ দেখে এবং সে বছর অন্যদের সহযোগিতায় সে তার প্রথম বোনের বিয়ে দেয়। সে একটি বেড় জাল সহ কয়েকটি ঝাঁকি জাল কেনেন। এর পর তাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয় নি। পরের বছরগুলি তার জন্য হয়ে আসে সমৃদ্ধির বছর হয়ে। এসময়ে (২০০৫-২০০৭) তার চাষকৃত পুকুর সংখ্যা ৪ থেকে ৭-এ আসে।
সে সময় জেলা মৎস্য অফিস, জয়পুরহাট এই উদ্যমী যুবকটির পাশে দাঁড়ায় এবং দারিদ্র বিমোচন প্রকল্পের আওতায় তাকে ৫০,০০০ টাকা ঋণ দেওয়া দেয়। সেই টাকায় মাছ চাষ করে সে যথেষ্ট লাভের মুখ দেখে এবং ঋণকৃত টাকা এক বছরের মধ্যে পুরোটাই শোধ করে দেয়। এরপর তাকে আর কোন ঋণ নিতে হয়নি।
আব্দুল হাসানের বর্তমানে ১০টি পুকুর রয়েছে। সম্প্রতি সে তার ২য় ছোট বোনের বিয়ে দিয়েছে এবং একটি পাকা বাড়ি তৈরি করেছে। বাড়িতে গবাদি পশু পালন করছে এবং কিছু পরিমাণ জমিও ক্রয় করেছে। এছাড়াও সে তার ছোট ভাইদের তার ফার্মে কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দিয়েছে। বর্তমানে সে একজন ধনী ও সফল মৎস্যচাষি।
মৎস্যচাষের মাধ্যমে ভাগ্যের উন্নয়নের এরকম উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত আমাদের আশে পাশে আরও অনেক আছে। তাই শুধু মিছে বুলি নয়, দারিদ্র বিমোচনে তথা দেশের দরিদ্র ও অতি দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন ও আর্থিক সক্ষমতায় মৎস্যচাষ পূর্বেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এসেছে, এখনও করছে এবং ভবিষ্যতেও এর প্রয়োজন অনস্বীকার্য।
Visited 812 times, 1 visits today | Have any fisheries relevant question?