উজ্জ্বল কমলা বর্ণের মাঝে অসংখ্য কালো বিন্দুর উপস্থিতিই মাছটিকে বাংলাদেশের অন্যান্য টাকি মাছ থেকে আলাদা করেছে। টাকি মাছের দেহের মত গড়ন বিশিষ্ট হলেও মাছটি বাংলাদেশে এ যাবত প্রাপ্ত পাঁচ প্রজাতির টাকি মাছ থেকে অনেকটাই আলাদা। দেহের বর্ণ বৈশিষ্ট্য ছাড়া অন্যান্য বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে মাছটির সাথে সবচেয়ে বেশি মিল খুঁজে পাওয়া যায় দেশীয় তিলা সোলের (Channa barca) সাথে। কিন্তু দেহ কাঠামো ও কালো বিন্দুর উপস্থিতির ক্ষেত্রে মিল থাকলেও দেহের বর্ণের দিক থেকে উভয় প্রজাতির মধ্যে বিস্তর তফাৎ। তিলা সোলের ক্ষেত্রে দেহের বর্ণ ধুসর-কালো আর এর মাঝে উপস্থিত অসংখ্য কালো বিন্দু। অন্যদিকে প্রাপ্ত মাছটির দেহের বর্ণ উজ্জ্বল কমলা আর এর মাঝে উপস্থিত অসংখ্য কালো বিন্দু। তাহলে মাছটি কি তিলা সোলের প্রজননকালীন অবস্থা? তবে তা হবার সম্ভাবনা ক্ষীণ, কারণ তিলা সোলের উপর প্রকাশিত কোন ডকুমেন্টে বিষয়টির কোন উল্লেখ নেই এছাড়াও বর্তমান সময়টিও টাকি মাছে প্রজননকাল নয়। তাহলে মাছটি কি বাংলাদেশে নতুন প্রজাতির টাকি?
একটি মাত্র প্রাপ্ত নমুনার বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে তোলা ছবির উপর ভিত্তি করে আমার সহকর্মী ড. এবিএম মহসিনের সাথে আলোচনা এবং ফিসবেজসহ (FishBase) অন্যান্য বিখ্যাত ওয়েবসাইটের প্রজাতি শনাক্তকরণ কি (Taxonomic key) ও অন্যান্য তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে যে প্রাপ্ত মাছটির বেশিরভাগ বৈশিষ্ট্য Channa bleheri -এর সাথে মিলে যায়। Channa bleheri -এর আদিবাস ভারতের আসামে এবং সেখানে স্থানীয়ভাবে মাছটি লাল চেং নামে পরিচিত। তবে ইউরোপ ও আমেরিকার একুয়ারিয়ামের দোকানগুলোতে মাছটি Rainbow snakehead নামে অধিক পরিচিত। Rainbow snakehead বর্তমানে তারা নিজেরাই প্রজনন করিয়ে থাকে। তবে ঢাকার কাঁটাবনস্থ দেশী-বিদেশী বাহারি মাছের বাজারের দোকানগুলোতে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে তাদের কাছে এরকম কোন মাছ নেই এবং এর আগেও তারা এরকম কোন মাছ বিক্রি করেনি বা দেখেনি। তাহলে মাছটি কি আসাম থেকেই টাঙ্গাইল এলাকায় প্রবেশ করেছে?
তবে এ নিয়ে আরও তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণের প্রয়োজন রয়েছে। তাই এখনই মাছটি কোন প্রজাতির সে সম্পর্কে নিশ্চিত মন্তব্য করছি না। বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশের বিখ্যাত মৎস্য বিজ্ঞানীদের সাথে ইমেইলের মাধ্যমে আলোচনার সূচনা করা হয়েছে। আমরা প্রত্যাশা করি দ্রুতই মাছটির প্রজাতি নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। নমুনা মাছটির কয়েকটি ছবি এখানে দেয়া হলো যা থেকে নিশ্চিত হওয়া যায় যে বাংলাদেশে প্রাপ্ত পাঁচ প্রজাতির টাকি মাছ থেকে এটি আলাদা। উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশে যে পাঁচ প্রজাতির টাকি মাছ দেখতে পাওয়া যায় সেগুলো হচ্ছে-
- টাকি, Spotted snakehead, Channa punctata (Bloch 1793)
- সোল, Shol, Channa striatus (Bloch 1793)
- গজার, Great snakehead, Channa morulius (Hamilton 1822)
- চ্যাং, Walking snakehead, Channa orientalis Bloch and Schneider 1801, Channa gachua (Hamilton 1822)
- তিলা-সোল, Barca snakehead, Channa barca (Hamilton 1822)
নমুনা সংগ্রহের স্থান ও সময়কাল:
টাঙ্গাইল সদর উপজেলার বরুহা গ্রামের একটি পুকুর যেটি চাষের আওতায় না থাকায় হরেক রকম দেশীয় মাছের আশ্রয়স্থল। প্রতি বর্ষায় বৃষ্টি ও প্লাবনের পানিতে পুকুরটি ডুবে যায় এবং পুকুর সংলগ্ন নিচু জমির প্লাবিত পানিই হয়ে ওঠে দেশীয় ছোট মাছের প্রজনন ও চারণভূমি। অতি বন্যায় এই চারণভূমির সাথে একটি খালের মাধ্যমে সংযোগ ঘটে গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া “এলংজানী” নদীর, যেটি ধলেশ্বরী নদীর একটি শাখা নদী। অন্যান্য বছরের মত এবছরও অতি বর্ষায় এই সংযোগ ঘটে অনায়াসে। এরকম একটি পুকুরেই এ মাসের ১২ তারিখে ছিপে ধরা পড়ে মাছটি। জীবন্ত অবস্থায় বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে ছবি তোলার পর প্রাকৃতিকভাবে সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে মাছটিকে আবার সেখানেই ছেড়ে দেয়া হয় যাতে পরবর্তীতে আবার গবেষণার জন্য সংগ্রহ করা যায়। এছাড়াও উল্লেখিত পুকুরের আশেপাশের সকল পুকুর কড়া নজরদারির মধ্যে রাখা হয়েছে যাতে এরকম আরও কিছু নমুনা সংগ্রহ করা যায়।
তথ্যসূত্র:
- www.fishbase.org
- FishBase Fish Identification
- fl.biology.usgs.gov
- www.seriouslyfish.com
- www.aquaticcommunity.com
- www.jjphoto.dk
- Day F. 1958. The Fishes of India: being a Natural History of the fishes known to inhabit the seas and freshwater of India., Burma and Ceylon. Reproduced in 1958 by William Dowson andSons, London.
- IUCN Bangladesh (2000) Red book of threatened fishes of Bangladesh, IUCN- The world conservation union. xii+116 pp.
- Munro ISR (2000) The marin and freshwater fishes of Ceylon. Dept. of External affairs, Canberra.
- Rahman AKA (1989) Freshwater Fishes of Bangladesh, 1st edition, Zoological Society of Bangladesh, Department of Zoology, University of Dhaka, Dhaka-1000.
- Rahman AKA (2005) Freshwater Fishes of Bangladesh, 2nd edition, Zoological Society of Bangladesh, Department of Zoology, University of Dhaka, Dhaka-1000.
- Shafi M and Quddus MMA (2001) Bangladesher Matsho Shampad (Fisheries of Bangladesh) (in Bengali), Kabir publication. Dhaka, Bangladesh.
- Talwar PK and Jhingran AG (1991) Inland Fishes of India and Adjacent Countries, Vol. 2, Oxford & IBH Publishing Co. Pvt. Ltd. New Delhi-Calcutta.
কৃতজ্ঞতা স্বীকার:
- মো: জাকারিয়া ইসলাম, বরুহা, টাঙ্গাইল, যিনি এই দূর্লভ নমুনাটি সংগ্রহ করে আমাকে দেখিয়েছেন।
- ড. এবিএম মহসিন, সহযোগী অধ্যাপক, ফিশারীজ বিভাগ, রাবি এবং ফিচারটির সহ-লেখক।
- জনাব মাহবুব হক, মৎস্য কর্মকর্তা, মৎস্য অধিদপ্তর।
বিশেষজ্ঞবৃন্দের মতামত:
বিশেজ্ঞদের নিকট এ বিষয়ে মতামত চেয়ে আমাদের পাঠানো ইমেইল এর উত্তরে বেশ কিছু মূল্যবান মতামত পেয়েছি। মতামতগুলো ইংরেজিতে হওয়ায় তা এই ফিচারের ইংরেজী সংস্করণে দেয়া হল। যারা মূল্যবান মতামত দিয়ে আমাদের এই প্রচেষ্টাকে উৎসাহিত করেছেন তাদেরকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
আরও নমুনা প্রাপ্তির খবর:
মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল উপজেলার বাইক্কা বিলের নিকটবর্তী বাজারে এই মাছের একটি নমুনা প্রাপ্তির বিষয়টি আমাদের নিশ্চিত করেছেন মৎস্য অধিদপ্তরের (DoF) উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা জনাব মাহবুব হক। তিনি গত ২৭ নভেম্বরে ফেসবুকে নমুনাটির একটি ছবি প্রকাশ করেন যা তার অনুমতি সাপেক্ষে নিচে দেয়া হল।
পুনশ্চ:
প্রজাতি নিশ্চিতকরণের পূর্ব পর্যন্ত পাতাটি প্রতি নিয়ত হালনাগাদ (update) করা হবে। এ সম্পর্কে কারও কাছে কোন তথ্য থাকলে তা মন্তব্যে প্রকাশ করার জন্য বিশেষভাবে অনুরোধ করছি।
Visited 3,494 times, 1 visits today | Have any fisheries relevant question?