প্রতিকূল পরিবেশ এবং খাদক ও ক্ষতিকর প্রাণী থেকে রক্ষার উদ্দেশ্যে ডিম ও অপত্যের স্বনির্ভরতা অর্জনের পূর্ব পর্যন্ত মা-বাবা কর্তৃক যে বিশেষ ব্যবস্থাপনা গ্রহণ করা হয় তাই পিতৃমাতৃযত্ন (Parental Care)। এটি এক ধরণের সহজাত আচরণ। অন্যান্য প্রাণীর মত মাছেও পিতৃমাতৃযত্ন দেখতে পাওয়া যায়। তবে সকল প্রজাতির মাছে সমভাবে পিতৃমাতৃযত্ন দেখতে পাওয়া যায় না। ডিম পাড়া (oviparous) মাছের চেয়ে বাচ্চা প্রসবকারী (viviparous) মাছে পিতৃমাতৃযত্ন প্রবল। অন্যদিকে ডিম পাড়া মাছের মধ্যে যাদের ফিকানডিটি (Fecundity) কম তাদের মধ্যে বেশী মাত্রায় এবং যাদের ফিকানডিটি বেশী তাদের মধ্যে কম মাত্রায় পিতৃমাতৃযত্ন প্রদর্শিত হতে দেখা যায়।
মা-বাবা মাছেরা তাদের ডিম ও অপত্যের জন্য যে বিশেষ ব্যবস্থাপনা গ্রহণ করে থাকে তা প্রজননের পূর্বেও হতে পারে আবার প্রজনন উত্তরও হতে পারে। যদি ব্যবস্থাপনা প্রজননের পূর্বে গ্রহণ করা হয়ে থাকে তবে তাকে প্রজনন পূর্ব পিতৃমাতৃযত্ন অন্যদিকে যদি তা প্রজননের পরে গ্রহণ করা হয়ে থাকে তবে তাকে প্রজনন পরবর্তী পিতৃমাতৃযত্ন হিসেবে বিবেচনা করা হয়। অনেক মাছ তার ডিম ও বাচ্চাকে দেহের ভেতরে বা বাহিরে আশ্রয় দেয়া, সাথে নিয়ে অবস্থান করা ইত্যাদি পদ্ধতিতে সরাসরি তত্ত্বাবধানের মাধ্যমে পিতৃমাতৃযত্ন প্রদর্শন করে থাকে। এজাতীয় পিতৃমাতৃযত্নকে প্রত্যক্ষ পিতৃমাতৃযত্ন বলা হয়ে থাকে। আবার অনেক মাছ রয়েছে যারা দেহের ভেতরে বা বাহিরে আশ্রয় দেয়া, সাথে নিয়ে অবস্থান করা ইত্যাদি পদ্ধতিতে সরাসরি যত্ন না নিয়ে বরং তাদের ডিম ও বাচ্চার নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করার জন্য প্রজননক্ষেত্র নির্বাচন, বাসা নির্মাণ ইত্যাদি বিশেষ ব্যবস্থাপনা গ্রহণ করে থাকে। এজাতীয় পিতৃমাতৃযত্নকে পরোক্ষ পিতৃমাতৃযত্ন বলা হয়ে থাকে। অনেক মাছ রয়েছে যাদের মধ্যে কেবলমাত্র পরোক্ষ পিতৃমাতৃযত্ন দেখতে পাওয়া যায় আবার অনেক মাছের মধ্যে কেবলমাত্র প্রত্যক্ষ পিতৃমাতৃযত্ন দেখতে পাওয়া যায়। কিছু কিছু মাছ রয়েছে যাদের মধ্যে একই সাথে পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষ উভয় ধরনের পিতৃমাতৃযত্নই দেখতে পাওয়া যায়। বেশীরভাগ ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ পিতৃমাতৃযত্নে বাবারা অগ্রণী ভূমিকা পালন করে থাকে।
সবকিছু মিলিয়ে সংক্ষেপে বলা যায় মাছ অভিপ্রয়াণ ও প্রজননক্ষেত্র নির্বাচন, বাসা নির্মাণ ও নির্মিত বাসায় ডিম পাড়া ও সংরক্ষণ, বিশেষায়িত অবকাঠামোর মাঝে অথবা গায়ে ডিম পাড়া এবং দেহের ভেতরে বা বাহিরে ডিম ও বাচ্চার আশ্রয় প্রদানের মাধ্যমে পিতৃমাতৃযত্ন প্রদর্শন করে থাকে। পর্ব-১ এ অভিপ্রয়াণ ও প্রজননক্ষেত্র নির্বাচন এবং বাসা নির্মাণ ও নির্মিত বাসায় ডিম পাড়া ও সংরক্ষণ বিষয়ে আলোচনা করা হল। পর্ব-২ এ থাকবে- বিশেষায়িত অবকাঠামোর মাঝে অথবা গায়ে ডিম পাড়া এবং দেহের ভেতরে বা বাহিরে ডিম ও বাচ্চার আশ্রয় প্রদানের মাধ্যমে পিতৃমাতৃযত্ন প্রদর্শনের বিস্তারিত বিবরণ।
অভিপ্রয়াণ ও প্রজননক্ষেত্র নির্বাচন:
ডিম ও বাচ্চার উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করার জন্য অধিকাংশ মাছই অভিপ্রয়াণ করে তার বসবাসের স্থল হতে প্রজননস্থলে আসে। যেমন- ইলিশ (Tanualosa ilisha), পেট্রোমাইজোন (Petromyzon), স্যামন (Salmon) ইত্যাদি মাছ সামুদ্রিক হলেও প্রজননের সময় স্বাদুপানিতে আসে। অন্যদিকে স্বাদু পানির ইল (Freshwater eel) প্রজননের জন্য সমুদ্রে যায়। আমাদের দেশের বেশীরভাগ মাছই ডিম ও বাচ্চার উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করার জন্য এক নদী থেকে নদী থেকে অন্য নদীতে, নদী থেকে বিল, হাওড় বা প্লাবনভূমিতে, বিল বা হাওড় থেকে নদীতে অভিপ্রয়াণ করে থাকে। যেমন-
তীব্র স্রোত বিশিষ্ট স্থান নির্বাচন:
- রুই, কাতলা, মৃগেল ইত্যাদি মাছ হাওড় ও নদীর তীব্র স্রোত যুক্ত স্থানে ডিম পেড়ে থাকে। আমাদের দেশে হালদা ছাড়াও পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্র ইত্যাদি নদীতে বৈশাখ থেকে শ্রাবণ মাস পর্যন্ত এসব মাছের ডিম পাড়ার তথ্য পাওয়া যায়।
- ইলিশ মাছ সামুদ্রিক হলেও প্রজননের জন্য স্বাদুপানির নদীর যেসব স্থানে তীব্র স্রোত বিদ্যমান সেসব স্থানে অভিপ্রয়াণ করে।
হালকা স্রোতযুক্ত স্থান নির্বাচন:
- গনিয়া, কালিবাউস, ভাঙ্গন, সরপুঁটি, চাপিলা, কাচকি ইত্যাদি মাছ বৈশাখ-শ্রাবণ মাসে হাওর, বিল ও প্লাবনভূমির হালকা স্রোতযুক্ত স্থানে ডিম পাড়ে।
জলজ উদ্ভিদ বিশিষ্ট স্থান নির্বাচন:
- সরপুঁটি ছাড়া অন্যান্য পুঁটি, গুলশা, বাতাসি, কাজলি, পাবদা, বোয়াল, চান্দা, ঢেলা, ভেদা ইত্যাদি মাছকে প্লাবনভূমি বা বিলের জলজ উদ্ভিদ বিশিষ্ট স্বল্প পানিতে ডিম ছাড়তে দেখা যায়।
পাথর, গাছের গুড়ি বা কোন অবকাঠামোর ফাঁকে ডিম পাড়া:
- পুতুল, রাণী, গুতুম ইত্যাদি মাছ চৈত্র থেকে আষাঢ় পর্যন্ত প্লাবনভূমি, বিল, নদী, খালের মত জলাশয়ের একেবারে কিনারায় অবস্থিত পাথর বা গাছের শাখা-প্রশাখা বিশিষ্ট গুড়ি বা অন্য কোন অবকাঠামোর ফাঁকে স্থির পানিতে ডিম পাড়ে। সেখানেই ডিম ফুটে বাচ্চা বের হবার পর স্বল্প পানিতেই বাচ্চাগুলো ছড়িয়ে পড়ে।
নুড়ি পাথর ও বালুকণায় ডিম ছড়িয়ে রাখা:
- ট্রাউট (Trout), হোয়াইট ফিশ (White fish) ইত্যাদি মাছ স্বচ্ছ পানির তলদেশের নুড়ি পাথর এবং বালুকণায় ডিম ছড়িয়ে রাখে।
বাসা নির্মাণ এবং নির্মিত বাসায় ডিম পাড়া ও সংরক্ষণ:
যেসব মাছ বাসা নির্মাণ করে তাদের মধ্যে অনেকই নির্মিত বাসা ডিম দেয়া ও ডিম নিষিক্ত করার পর বাসা ত্যাগ করে চলে যায় যেমন- পেট্রোমাইজোন (Petromyzon), অনকোরিনকাস (Oncorhynchus) ইত্যাদি। আবার অনেক মাছ ডিম পাড়া, ডিম নিষিক্ত করার সাথে সাথে ডিম পাহারা দেয়, ডিম ফুটে বাচ্চা বের হবার পরও তাদেরকে সাথে সাথে রাখে। যেমন- সান ফিশ (Sun fish: Lepomis), বোফিন ফিশ (Bowfin: Amia) ইত্যাদি। অনেকে আবার ডিমের পরিস্ফুটনের জন্য বাড়তি অক্সিজেন সরবরাহ করার জন্য বিশেষ ব্যবস্থাপনা গ্রহণ করে। এসব কাজে সাধারণত বাবাদেরই অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে দেখা যায়। যেমন-
জলজ আগাছার মাঝে জলজ আগাছা দিয়ে তৈরি বাসা:
- গভীর পানির চিতল মাছ জলজ আগাছার গোঁড়ায় জলজ আগাছা তথা এর জীবিত বা মৃত ডালপালা দিয়ে নির্মিত বাসায় ডিম পাড়ে। অনেক সময় এরা কাঠ জাতীয় অবকাঠামোতেও ডিম দিয়ে থাকে। এদের ডিম আঠালো বিধায় ডিম ফুটে বাচ্চা বের হবার আগ পর্যন্ত ডিমগুলো বাসার অবলম্বনের সাথে আটকে থাকে।
- উত্তর আমেরিকার বৃহৎ হ্রদে বসবাসকারী বোফিন মাছের (Bowfin: Amia calva) মায়েরা জলজ আগাছার মাঝে জলজ আগাছা দিয়ে নির্মিত বাসায় ডিম পাড়ে। বাবারা ডিম নিষিক্ত করা, পাহারা দেয়া এবং ডিম ফুটে বাচ্চা বের হবার পরও তাদের দেখভাল করে।
জলজ আগাছা ও দেহ নিঃসৃত আঠালো পদার্থে তৈরি বাসা:
- উত্তর আমেরিকার হ্রদ ও পুকুরে বসবাসকারী ছোট মাছ স্টিকলব্যাকের (Stickleback: Gasterosteus aculeatus) পুরুষেরা মৃত উদ্ভিদাংশ দিয়ে বাসা তৈরির পর বৃক্ক নিঃসৃত আঠালো পদার্থ সেই বাসার উপর ছড়িয়ে দেয় যাতে ঢেউ বা শত্রু প্রাণীর আক্রমণে বাসাটি সহজে নষ্ট না হয়ে যায়। একাধিক মা মাছ সেই বাসায় ডিম পাড়ে এবং বাবারা ডিম নিষিক্ত করার পর নিষিক্ত ডিম ফুটে বাচ্চা বের হওয়ার পরও কিছুদিন পর্যন্ত দেখভাল করে।
জলজ আগাছার মাঝে মাটিতে গর্ত করে বাসা নির্মাণ:
- চৈত্র থেকে আষাঢ় মাসে স্বল্প পানিতে ধান, পাট এবং এজাতীয় জলজ উদ্ভিদ রয়েছে এমন স্থানের মাটিতে গর্ত করে তার মধ্যে শিং, মাগুর, টাকি, সোল, গজার, চ্যাং, গুচি, বাইম, কুঁচিয়া, ফলির মা মাছকে ডিম পাড়তে দেখা যায়। মা মাছ ডিম পাড়ার পরপরই বাবা মাছকে শুক্রাণু নির্গত করে নিষেক ঘটায়। শিং, মাগুর এর মা ও বাবারা বিশেষত মায়েরা ডিম ফোটার পর কিছুদিন পর্যন্ত বাচ্চাকে সাথে নিয়ে ঘুরতে দেখা যায়। এসময় শিকারি মাছ থেকে রক্ষার জন্য মা-বাবা মাছদের নিজেদের বাচ্চাদের পাহারা দিতে দেখা যায়। টাকি, সোল, গজার, চ্যাং ইত্যাদি মাছের মা-বাবারা লেজের মাধ্যমে পানিতে ঝাপটা মেরে প্রচণ্ড শব্দ করে শত্রুদের ভয় দেখিয়ে দূরে রাখতে ভূমিকা রাখে।
- আফ্রিকার লাং ফিশের (Protopterus) বাবারা লম্বা লম্বা জলজ আগাছার গোঁড়ায় মাটিতে ডিম্বাকার গর্ত করে বাসা নির্মাণ করে। প্রতিটি গর্তে একাধিক মা মাছ প্রায় পাঁচ হাজার ডিম পাড়ে। বাবারা ডিম নিষিক্ত করে এবং পরবর্তীতে ডিমগুলো পাহারা দেয়ার সাথে সাথে মাঝেমধ্যে পাখনার ঝাপটা দিয়ে পানিতে আলোড়ন তুলো ডিমের পরিস্ফুটনের জন্য বাড়তি অক্সিজেন সরবরাহ করে।
- আমেরিকার লাং ফিশের (Lepidosiren) বাবারা মাটির নীচে সুরঙ্গের মত লম্বা বাসা নির্মাণ করে এবং মায়েরা সেখানে ডিম পাড়ে। বাবারা ডিম নিষিক্ত করে ও ডিমগুলোকে পাহারা দেয়। এছাড়াও বাবারা কিছুক্ষণ পরপর পানির উপরে উঠে এসে মুখ ভর্তি করে বাতাস নেয় যাতে করে রক্তে অক্সিজেনের পরিমাণ বাড়ে। এই বাড়তি অক্সিজেন তাদের পরিবর্তিত উদর পাখনার (Pelvic fin) মাধ্যমে পরিস্ফুটনরত ডিমের নিকটস্থ পানিতে ছড়িয়ে পড়ে যাতে পরিস্ফুটনরত ডিম প্রয়োজনমত অক্সিজেন পায়।
স্বচ্ছ পানি বিশিষ্ট স্থানের মাটিতে গর্ত করে বাসা নির্মাণ:
- চৈত্র থেকে আষাঢ় মাসে আইর মাছ বিল বা নদীর স্বচ্ছ পানি রয়েছে এমন স্থানে মাটিতে গর্ত করে ডিম ছাড়ে। আইর এর মা ও বাবারা বিশেষত মায়েরা ডিম ফোটার পর কিছুদিন পর্যন্ত বাচ্চাকে সাথে নিয়ে ঘুরতে দেখা যায়। এসময় শিকারি মাছ থেকে রক্ষার জন্য মা-বাবা মাছদের নিজেদের বাচ্চাদের পাহারা দিতে দেখা যায়।
মিউকাস ও বাতাসের বুদবুদে সৃষ্ট ফেনা দিয়ে বাসা নির্মাণ:
- খলিশা, বৈচা, বিট্টা (Betta), ম্যাক্রোপোডাস (Macropodus) ইত্যাদি মাছ বাতাস ও মিউকাসের বুদবুদ সৃষ্টি করে ভাসমান বাসা তৈরি করে। অনেক সময় বুদবুদের এই বাসা ছোট আকারের ভাসমান জলজ উদ্ভিদকে ঘিরে তৈরি হয়ে থাকে। মায়েরা ডিম পড়ার পর বাবার প্রথমে ডিমগুলো নিষিক্ত করে অতঃপর ডিমগুলো মুখে নিয়ে ফু দিয়ে বুদবুদের মধ্যে ছুড়ে দেয়। ডিম ফোটার আগ পর্যন্ত ডিমগুলো সেখানেই পরিস্ফুটিত হয় এবং ডিম ফুটে বাচ্চা বের হবার পর জলাশয়ে ছড়িয়ে পড়ে।
Visited 1,830 times, 1 visits today | Have any fisheries relevant question?