প্রতিকূল পরিবেশ এবং খাদক ও ক্ষতিকর প্রাণী থেকে রক্ষার উদ্দেশ্যে ডিম ও অপত্যের স্বনির্ভরতা অর্জনের পূর্ব পর্যন্ত মা-বাবা কর্তৃক যে বিশেষ ব্যবস্থাপনা গ্রহণ করা হয় তাই পিতৃমাতৃযত্ন। মাছ সাধারণত অভিপ্রয়াণ ও প্রজননক্ষেত্র নির্বাচন, বাসা নির্মাণ ও নির্মিত বাসায় ডিম পাড়া ও সংরক্ষণ, বিশেষায়িত অবকাঠামোর মাঝে অথবা গায়ে ডিম পাড়া এবং দেহের ভেতরে বা বাহিরে ডিম ও বাচ্চার আশ্রয় প্রদানের মাধ্যমে পিতৃমাতৃযত্ন প্রদর্শন করে থাকে। পর্ব-১ এ অভিপ্রয়াণ ও প্রজননক্ষেত্র নির্বাচন এবং বাসা নির্মাণ ও নির্মিত বাসায় ডিম পাড়া ও সংরক্ষণ বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। এ পর্বে থাকলো- বিশেষায়িত অবকাঠামোর মাঝে অথবা গায়ে ডিম পাড়া এবং দেহের ভেতরে বা বাহিরে ডিম ও বাচ্চার আশ্রয় প্রদানের মাধ্যমে পিতৃমাতৃযত্ন প্রদর্শনের বিস্তারিত বিবরণ।

 

বিশেষায়িত অবকাঠামোর মাঝে অথবা গায়ে ডিম পাড়া:
অনেক মাছ রয়েছে যারা বাসা নির্মাণ না করে উদ্ভিদাংশ বা যে কোন অবকাঠামোর গায়ে অথবা ভিতরে, ফিতার মত গঠন তৈরি করে অথবা ডিম্ব-থলির মাঝে ডিম পাড়ে ফলে ডিমগুলো ক্ষতিকর ও খাদক প্রাণী থেকে সহজেই রক্ষা পায়। যেমন-

জলজ উদ্ভিদ বা কোন অবকাঠামোতে ডিম আটকে রাখা:

  • মিরর কার্প মাঘ-চৈত্র মাসে প্রায় স্রোতহীন উন্মুক্ত এবং বদ্ধ জলাশয়ের জলজ আগাছায় বা কোন অবকাঠামোতে তাদের ডিম আটকে রাখে।
  • কৈ মাছ বছরের প্রথম বৃষ্টির সময় বা পরে প্রজননের উদ্দেশ্যে তার বসবাসের স্থল হতে স্বল্প পানির স্রোতের বিপরীতে অভিপ্রয়াণ করে স্বল্প পানি বিশিষ্ট জলাশয়ের জলজ উদ্ভিদের মাঝে প্রবেশ করে ডিম ছাড়ে। এদের আঠালো ডিম ফুটে বাচ্চা বের হবার আগ পর্যন্ত জলজ উদ্ভিদের সাথে লেগে থাকে।

 

ফিতার ন্যায় গঠনে ডিম আটকে রাখা:

  • ইয়োলো পার্স (Yellow perch) মাছ তার ডিম এমন ভাবে পাড়ে যে তা পরপর সজ্জিত হয়ে একটি ফিতার মত গঠন তৈরি করে। ডিম ফুটে বাচ্চা বের হবার আগ পর্যন্ত ডিমের পরিস্ফুটন এর মাঝে নিরাপদে সম্পন্ন হয়ে থাকে।

 

ঝিনুকের ম্যান্টল গহ্বরে ডিম পাড়া ও সংরক্ষণ:

  • ডিম পাড়ার আগে বিটারলিং (Rhodeus) নামক আমেরিকান ছোট মাছের ডিম্ব নালী (Ovipositor tube) প্রলম্বিত হয়ে দেহের বাইরে বেড়িয়ে এসে দীর্ঘ নালী (Siphon) গঠন করে এবং এর শেষ প্রান্ত ঝিনুকের ম্যান্টল গহ্বরে প্রবেশ করিয়ে দেয়। এ নালীর মাধ্যমে মা মাছ উক্ত গহ্বরে ডিম পাড়ে। ডিম ফুটে বাচ্চা বের হবার হবার পূর্ব পর্যন্ত ডিমগুলো সেখানে নিরাপদে পরিস্ফুটিত হয়।

মার্মেডের পার্সে (Mermaid’s purses) ডিম পাড়া ও সংরক্ষণ:

  • ডিমপাড়া হাঙ্গর যেমন- স্কাইলিয়াম (Scyllium) -দের অন্তঃনিষেক দেখতে পাওয়া যায় অর্থাৎ এদের নিষেক দেহের অভ্যন্তরে হয়ে থাকে। এরা নিষিক্ত ডিম একটি শক্ত ডিম্বথলিসহ পাড়ে। থলিটি মার্মেডের পার্স (Mermaid’s purses) নামে পরিচিত। পার্সগুলো একটি ক্যাপসুল এবং একাধিক টেনড্রিল (Tendril) নিয়ে গঠিত। টেনড্রিলগুলো আকর্ষীর ন্যায় জলজ আগাছার সাথে আটকে থাকে। নিষিক্ত ডিম ও ভ্রূণের পরিস্ফুটন সম্পন্ন হবার পর বাচ্চারা পার্স থেকে বের হয়ে আসে।

 

দেহের ভেতরে বা বাহিরে ডিম ও বাচ্চার আশ্রয় প্রদান:

অনেক মাছ রয়েছে যারা সরাসরি তার ডিম ও বাচ্চাকে আশ্রয় প্রদানের মাধ্যমে পিতৃমাতৃযত্ন প্রদর্শন করে। এ জাতীয় আশ্রয় দেহের ভেতরেও হতে পারে আবার বাহিরেও হতে পারে। নিচে এ ধরণের প্রত্যক্ষ পিতৃমাতৃযত্নের কয়েকটি উদাহরণ বিস্তৃতভাবে নিচে দেয়া হল-

 

ডিমকে পেঁচিয়ে অবস্থান করা:

  • ফলিস (Pholis gunnellus) নামক বাটার ফিশের (Butter fish) মায়েরা ডিম পাড়ার পর বাবারা ডিমগুলোকে প্রথমে নিষিক্ত করে এবং পরবর্তীতে একত্রে জড়ো করে গোলাকার বল তৈরি করে। এরপর ডিম ফুটে বাচ্চা বের হবার আগ পর্যন্ত সেই ডিমের বলকে পেঁচিয়ে অবস্থান করে।

 

ডিমকে উদরীয় অঞ্চলে সংযুক্ত করে রাখা:

  • ব্রাজিলের প্লাটিস্টাকাস (Platystacus) এবং অ্যাসপ্রিডো (Aspredo) নামের ক্যাট ফিশের মায়েরা নিষিক্ত ডিমকে নিজেদের উদরের স্পঞ্জের ন্যায় তুলতুলে ত্বকে আটকে রাখে যতদিন না সেই ডিম ফুটে বাচ্চা বের হয়। প্রথমে মা মাছ ডিম পাড়ে। পরবর্তীতে বাবা মাছ ডিমগুলোকে নিষিক্ত করে। মায়েরা নিষিক্ত ডিমের উপর তাদের স্পঞ্জের মত নরম উদরীয় ত্বক চেপে ধরে ফলে ডিমগুলো ত্বকের গায়ে প্রোথিত হয়ে আটকে যায় এবং ডিম ফুটে বাচ্চা বের হবার আগ পর্যন্ত ডিমগুলো সেখানেই অবস্থান করে।

 

ডিমকে মস্তক অঞ্চলে সংযুক্ত করে রাখা:

  • নতুন গায়ানার (New Guinea) কারটাস (Kurtus) নামক মাছের বাবাদের পৃষ্ঠ পাখনার ১ম কাঁটা (রূপান্তরিত রশ্মি) বর্ধিত হয়ে মস্তকের ওপরে হুকের মত একটা গঠন তৈরি হয়। সেখানে এরা ডিমগুলো পিণ্ডাকারে আটকে রাখে যত দিন না ফুটে বাচ্চা বের হয়।

 

শাবক থলি (Brood pouch) গঠন:

  • সমুদ্র ঘোড়া (Sea horse) তথা হিপ্পোক্যাম্পাস (Hippocampus) এবং সিংন্যাথাস (Syngnathus) নামক পাইপ ফিশের বাবাদের উদরে একটি শাবক থলি দেখতে পাওয়া যায়। মায়েরা ডিমগুলো সেই শাবক থলিতে স্থানান্তর করে। ডিমগুলোর পরিস্ফুটন সেখানেই হয় এবং ডিম ফুটে বাচ্চা বের হবার পূর্ব পর্যন্ত সেখানেই অবস্থান করে।

 

ডিম ও বাচ্চাকে মুখ গহ্বরে আশ্রয় প্রদান:

  • তেলাপিয়ার (Tilapia) মায়েরা এবং অ্যারিয়াস (Arius) নামক ক্যাটফিশের বাবারা মুখ গহ্বরে ডিমের পরিস্ফুটন ঘটায়। ডিম ফুটে বাচ্চা বের হবার পর সেগুলো মুখের বাইরে আসলেও যে কোন ধরণের বিপদের সম্মুখীন হলে তারা আবার মুখ গহ্বরে আশ্রয় নেয়।

ওভো-ভিভিপ্যারাস (Ovo-viviparous) পরিস্ফুটন:

  • ওভো-ভিভিপ্যারাস মাছে অন্তঃনিষেক দেখতে পাওয়া যায় অর্থাৎ এদের নিষেক দেহাভ্যন্তরে ঘটে থাকে এবং নিষিক্ত ডিমের পরিস্ফুটন মায়ের দেহের অভ্যন্তরস্থ ডিমের মধ্যে সম্পন্ন হয়ে থাকে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পরিস্ফুটনের জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান কুসুম (yolk) থেকে পেয়ে থাকে (কোন কোন ক্ষেত্রে কুসুমের পাশাপাশি মায়ের কাছ থেকে পুষ্টি উপাদান পেলেও তা অতি সামান্য)। গাপ্পি (Guppies), এনজেল সার্ক (Angel sharks) ইত্যাদি ওভো-ভিভিপ্যারাস মাছের উদাহরণ।
  • ওভো-ভিভিপ্যারাস মাছের ডিমের নিষেক ও ভ্রূণের পরিস্ফুটন দেহের অভ্যন্তরস্থ ডিমের মধ্যে সম্পন্ন হয় বিধায় অপত্যের নিরাপত্তা ডিম পাড়া (oviparous) মাছের চেয়ে অনেক বেশী নিশ্চিত হয়। তাই ডিম পাড়া মাছের চেয়ে ওভো-ভিভিপ্যারাস মাছের পিতৃমাতৃযত্ন তুলনামূলক বেশী বলে বিবেচিত হয়।

 

জরায়ুজ বা ভিভিপ্যারাস (Viviparous) পরিস্ফুটন:

  • ওভো-ভিভিপ্যারাস মাছের মত জরায়ুজ মাছেও অন্তঃনিষেক দেখতে পাওয়া যায় অর্থাৎ এদের নিষেক দেহাভ্যন্তরে ঘটে থাকে। এদের নিষিক্ত ডিমের পরিস্ফুটন মায়ের দেহাভ্যন্তরস্থ প্লাসেন্টায় (placenta) সম্পন্ন হয়ে থাকে। পরিস্ফুটনের জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদানের সম্পূর্ণ অংশই মায়ের কাছ পেয়ে থাকে। লেমন সার্ক (Lemon shark), সার্ফ-পার্চ (Surf-perch),  স্প্লিট-ফিনস্ (Split-fins), একথুইট্টা (Halfbeak, Nomorhamphus ebrardtii) ইত্যাদি জরায়ুজ বা ভিভিপ্যারাস (Viviparous) মাছের উদাহরণ।
  • জরায়ুজ তথা ভিভিপ্যারাস মাছের ডিমের নিষেক ও ভ্রূণের পরিস্ফুটন দেহের অভ্যন্তরস্থ প্লাসেন্টার (placenta) মধ্যে সম্পন্ন হয়, এমন কি পরিস্ফুটনরত বাচ্চার প্রয়োজনীয় পুষ্টিও মায়ের কাছ থেকে আসে বিধায় পিতৃমাতৃযত্নের সর্বোচ্চ উদ্দেশ্য পূরণ নিশ্চিত হয়। তাই অপত্যের নিরাপত্তা ডিম পাড়া (oviparous) মাছ, এমন কি ওভো-ভিভিপ্যারাস মাছের চেয়েও অনেক বেশী নিশ্চিত হয়। তাই ডিম পাড়া মাছ ও ওভো-ভিভিপ্যারাস মাছের চেয়ে ভিভিপ্যারাস মাছের পিতৃমাতৃযত্ন তুলনামূলক বেশী বলে পরিগণিত হয়।

 

পর্ব-১ এ অভিপ্রয়াণ ও প্রজননক্ষেত্র নির্বাচন এবং বাসা নির্মাণ ও নির্মিত বাসায় ডিম পাড়া ও সংরক্ষণ বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে


Visited 894 times, 1 visits today | Have any fisheries relevant question?
মাছের পিতৃমাতৃযত্ন: পর্ব-২

Visitors' Opinion

এ বি এম মহসিন

প্রফেসর, ফিশারীজ বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী-৬২০৫, বাংলাদেশ। বিস্তারিত ...

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.