মাছচাষের বিভিন্ন ধরণের পুকুরের মধ্যে আঁতুড় পুকুরে (Nursery pond) শিকারি ও অনাকাঙ্খিত মাছের উপস্থিতি মারাত্মক ক্ষতিকর বলে বিবেচিত হয়ে থাকে কারণ শিকারি (Predatory) মাছ ডিমপোনা, রেণুপোনা, ধানীপোনা ও আঙ্গুলিপোনাকে সহজেই শিকার করে খেয়ে ফেলতে পারে আবার এরা চাষের মাছের সাথে স্থান, খাবার ও অক্সিজেন ব্যবহারের মত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়েও প্রতিযোগিতা করে থাকে। অন্যদিকে অনাকাঙ্ক্ষিত মাছ (Unwanted fish) বা অবাঞ্ছিত মাছ (Undesirable fish) বা আমাছা মাছ (Weed fish) চাষের মাছকে শিকার করে না খেলেও তাদের সাথে স্থান, খাবার ও অক্সিজেন ব্যবহারের মত rপ্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক বিষয়ে প্রতিযোগিতা করে থাকে। উভয় প্রকৃতির মাছের উপস্থিতিই চাষের পুকুরে মাছের কাঙ্ক্ষিত বৃদ্ধি তথা উৎপাদনের অন্যতম অন্তরায় হয়ে দেখা দেয়। তাই আঁতুড় পুকুরসহ অন্যান্য সকল ধরনের মাছ চাষের পুকুরে উভয় প্রকৃতির মাছ না থাকাটাই সমীচীন বলে বিবেচিত হয়ে থাকে। এ জন্য পুকুরে পোনা ছাড়ার পূর্বেই শিকারি ও অনাকাঙ্ক্ষিত মাছ নিয়ন্ত্রণ করা আবশ্যক এবং কাজটি সাধারণত পুকুর প্রস্তুতের সময়ই করা হয়ে থাকে।

পুকুরে শিকারি ও অনাকাঙ্ক্ষিত মাছ নিয়ন্ত্রণের বিভিন্ন পদ্ধতি জানার পাশাপাশি উভয় ধরণের মাছ সম্পর্কে একটা ধারণা থাকা প্রয়োজন। সে উদ্দেশ্যে আমাদের দেশে পুকুর ও এ জাতীয় জলাশয়ে সচরাচর দেখতে পাওয়া যায় এমন শিকারি ও অনাকাঙ্ক্ষিত মাছের এর তালিকা নিচে দেয়া হল-

শিকারি (Predatory) মাছ:

বাংলা নাম ইংরেজি নাম বৈজ্ঞানিক নাম বর্গ
গজার, গজাল, সাল Great/Giant snakehead Channa marulius Channiformes
ঘাইরা, গাচুয়া, রাগা, চ্যাং, রাগা, তেলো টাকি Walking snakehead Channa orientalis ,,
টাকি, লাটা, ছাইতান, শাটি Spotted snakehead Channa punctata ,,
শোল Striped snakehead Channa striata ,,
ফলি, ফলুই Bronze featherback Notopterus notopterus Osteoglossiformes
চিতল Humped featherback Chitala chitala ,,
কই Climbing perch Anabas testudineus Perciformes
মেনি, ভেদা, রয়না Mud perch Nandus nandus ,,
বেলা, বাইলা Tank goby Glossogobius giuris ,,
ভেটকি, কোরাল Barramundi Lates calcarifer ,,
বাইম, বাম, সাল বাইম Spiny eel Mastacembelus armatus Mastacembeliformes
গুচি, পাঙ্কাল, তুরি, চিরকা Striped Spiny Eel Mastacembelus pancalus ,,
মাগুর, জিওল Walking catfish Clarias batrachus Siluriformes
শিং, শিংহি, জিওল Stinging catfish Heteropneustes fossilis ,,
বোয়াল, বোল Freshwater shark Wallago attu ,,
কানি পাবদা Butter catfish Ompok bimaculatus ,,
মধু পাবদা, পাবদা Pabdah catfish Ompok pabda ,,
পাবদা Pabo catfish Ompok pabo ,,
শিলং Silond catfish Silonia silondia ,,
কাজুলি, বাঁশপাতা Gangetic ailia Ailia coila ,,
গারুয়া বাচা Garua bachcha Clupisoma garua ,,
বাচা Batchwa vacha Eytropiichthys vacha ,,
ছেনিয়া, জংলা, কাউয়া, টেংরা Indian gagata Gagata cenia ,,
তেলি, তেলচিটা Telchitta Glyptothorax telchitta ,,
বানেহারা, বামোশ, বোয়া, তেলকোমা, বাও বায়েম, বোয়া বায়েম Indian mottled eel Anguilla bengalensis Anguilliformes
কুচিয়া, কুইচা, কানচি Cuchia Monopterus cuchia Synbranchiformes

 

অনাকাঙ্ক্ষিত মাছ (Unwanted) বা অবাঞ্ছিত মাছ (Undesirable) বা আমাছা মাছ (Weed):

বাংলা নাম ইংরেজি নাম বৈজ্ঞানিক নাম বর্গ
মলা, মোয়া, মোশি Mola carplet Amblypharyngodon mola Cypriniformes
খোকসা, বারালি Barred baril Barilius barila ,,
খোকসা Vagra baril Barilius vagra ,,
জারুয়া, উত্তি Chaguni Chagunius chagunio ,,
চাপ চেলা, লব্বুকা, কাশ খায়রা Indian glass barb Chela laubuca ,,
ঘোড়া চেলা, চেলা Gora chela Securicula gora ,,
দারকিনা, দারকি, দারক্যা Flying barb Esomus danricus ,,
ঢেলা, মৌ, মোয়া, কেটি, কোটি Cotio Osteobrama cotio cotio ,,
কাঞ্চন পুঁটি, টাকা পুঁটি, পুঁটি Rosy barb, Red barb Puntius chonchonius ,,
ফুটানি পুঁটি, পুঁটি Spottedsail barb Puntius phutunio ,,
জাতি পুঁটি, পুঁটি Spotfin swamp barb Puntius sophore ,,
তিত পুঁটি, পুঁটি Barb Puntius ticto ,,
বউ, রাণী, বেটি Bengal loach, Necktie loach Botia dario ,,
খলিশা, খলিয়া Giant gourami Colisa fasciatus Perciformes
লাল খলিশা, রাঙ্গা খলিশা, বইচা Dwarf gourami Colisa lalius, Colisa lalia ,,
চুনা খলিশা, বৈচা, মধু খলিশা Honey gourami Trichogaster chuna, Colisa sota ,,
খরসুলা, খল্লা Corsula mullet Rhinomugil corsula ,,
কাচকি Yellowtail mullet Sicamugil cascasia ,,
কাঁকিলা, কাঁকলে, কাঁকিয়া Freshwater gar Xenentodon cancila Beloniformes
চাপিলা, খয়রা Indian river shad Gudusia chapra Clupeiformes
গনি চাপিলা, মুখ চোখা চাপিলা, করোটি, মাকুন্দি, চাপিলা Ganges river gizzard shad Gonialosa manmina ,,

 

শিকারি ও অনাকাঙ্ক্ষিত মাছ নিয়ন্ত্রণ
শিকারি ও অনাকাঙ্ক্ষিত মাছ নিয়ন্ত্রণের বেশ কয়েকটি পদ্ধতি রয়েছে। যেমন- পুকুর শুকিয়ে নেয়া, বারবার জাল টানা, বড়শি/টোপ/ফাঁদ ইত্যাদি ব্যবহার করা, রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার ইত্যাদি। উল্লেখিত পদ্ধতিগুলোর মধ্য থেকে যে কোন এক অথবা একাধিক পদ্ধতি ব্যবহার করে শিকারি ও অনাকাঙ্ক্ষিত মাছ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। নিচে উল্লেখিত পদ্ধতিসমূহ বিস্তৃতভাবে উপস্থাপন করা হল।

 

পানি অপসারণ (Dewatering)

পদ্ধতি:

  • এই পদ্ধতিতে প্রথমেই তেল অথবা বিদ্যুৎ চালিত বহনযোগ্য অগভীর পাম্প মেশিনের মাধ্যমে পুকুর থেকে সমস্ত পানি অপসরণ করা হয়।
  • এরপর পানি অপসারণ করা পুকুরটিকে ১-৩ সপ্তাহ ধরে সূর্যের রশ্মি ব্যবহার করে এমনভাবে শুকিয়ে নেয়া হয় যাতে তলদেশ ও তলদেশ সংলগ্ন পাড়ের মাটি ফেটে যায়।
  • এ অবস্থায় শতাংশ প্রতি ৩-৪ কেজি চুন প্রয়োগ করে গর্তে বা কাঁদার ভেতরে লুকিয়ে থাকা রাক্ষুসে এবং অনাকাঙ্ক্ষিত মাছ সম্পূর্ণরূপে দূর করা সম্ভব।
  • সম্ভব হলে চুন প্রয়োগে পূর্বে পুকুরের তলদেশ ও পাড়ের তলদেশ সংলগ্ন স্থানে লাঙ্গল দেয়া যেতে পারে। তাতে করে আরও ভাল ফলাফল পাওয়া যায়।
  • এর এক সপ্তাহ পরে অপসারণকৃত পানি পুনরায় ব্যবহার করে অথবা অন্য কোন জলাশয়ের পানি ব্যবহার করে পুকুরটি পুনরায় পূর্ণ করতে হবে। নতুবা বৃষ্টির পানির জন্য অপেক্ষা করতে হবে। বৃষ্টির পানি প্রাপ্তির বিষয়টি যদিও প্রকৃতি নির্ভর তবুও বৃষ্টির পানি ব্যবহার করে পুকুর পূর্ণ করা অধিক সুবিধাজনক।

 

সাবধানতা:

  • অপসারণকৃত পানি পুনঃব্যবহার করলে অথবা বাহিরের জলাশয়ের পানি ব্যবহারের ক্ষেত্রে অবশ্য অবশ্যই পানির প্রবেশের পথে সূক্ষ্ম ফাঁসের জাল বা কাপড় অতি সাবধানতার সাথে ব্যবহার করতে হবে যাতে করে কোন অনাকাঙ্খিত পতঙ্গের লার্ভা বা পতঙ্গ বা মাছ প্রবেশ করতে না পারে। এক্ষেত্রে সামান্য অসাবধানতা সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটিকেই ভণ্ডুল করে দেবার জন্য যথেষ্ট।

 

সুবিধা ও অসুবিধা:

  • পানি অপসারণের মাধ্যমে কার্যকর ভাবে শিকারি ও অনাকাঙ্ক্ষিত মাছ দূর করা সম্ভব।
  • ছোট থেকে মাঝারি আকারের পুকুরে এই পদ্ধতি প্রয়োগ বেশ সুবিধাজনক।
  • এই পদ্ধতি প্রয়োগে একই সাথে আগাছা, ক্ষতিকর জলজ পতঙ্গ এবং শিকারি ও অনাকাঙ্ক্ষিত মাছসহ অন্যান্য জলজ প্রজাতি সম্পূর্ণভাবে দূর করা যায় বিধায় সম্ভব হলে এই পদ্ধতি প্রয়োগই করা অধিক যুক্তিসঙ্গত।
  • আমাদের দেশের বেশিরভাগ পুকুরেই পানি প্রবেশের ও বাহির হবার পথের (Inlet and outlet) ব্যবস্থা থাকে না বিধায় এই পদ্ধতি প্রয়োগ কিছুটা সময় ও শ্রম সাপেক্ষ।
  • আবার বৃহৎ আকারের পুকুরের ক্ষেত্রে পদ্ধতিটি যথেষ্ট ব্যয়বহুলও বটে।

 

বারবার জাল টানা, বড়শি/টোপ/ফাঁদ ব্যবহার এবং রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করে শিকারি ও অনাকাঙ্ক্ষিত মাছ নিয়ন্ত্রণের পদ্ধতি রইল পরের পর্বে


Visited 2,164 times, 1 visits today | Have any fisheries relevant question?
মাছচাষের পুকুরের শিকারি ও অনাকাঙ্ক্ষিত মাছ নিয়ন্ত্রণ: পর্ব-১

Visitors' Opinion

এ বি এম মহসিন

প্রফেসর, ফিশারীজ বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী-৬২০৫, বাংলাদেশ। বিস্তারিত ...

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.