মিঠাপানির মৎস্যচাষের ক্ষেত্র হিসেবে বাংলাদেশ পৃথিবীর প্রথম সারির দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। নদী-নালা, খাল-বিল, হাওড়-বাঁওড়ে ভরপুর বিশাল জলরাশি সমৃদ্ধ এদেশে মাছচাষের অফুরান সম্ভাবনা বিদ্যমান। এদেশের আভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়ে ২৬০ প্রজাতির স্বাদু পানির মাছ বিদ্যমান। তনুমধ্যে শিং ও মাগুর বাংলাদেশের খুবই জনপ্রিয় মাছ। এ দুটি মাছ দেশের হারিয়ে যেতে বসা মাছের মধ্যে অন্যতম। দেশী শিং মাগুর মাছ সুস্বাদ, পুষ্টিকর ও কম চর্বিযুক্ত। আবার জীবিত অবস্থায় বিক্রি করা হয় বলে এর বাজার মূল্যও অন্যান্য মাছের তুলনায় অনেক বেশী।
পুষ্টিমান বিবেচনায় শিং ও মাগুর মাছের পুষ্টিগুণ বড় মাছের তুলনায় অনেক বেশি। এ মাছদ্বয়ে প্রোটিন, ভিটামিন, ক্যালসিয়াম ও অন্যান্য মাইক্রো-নিউট্রিয়েন্ট প্রচুর পরিমাণ রয়েছে। প্রতি ১০০ গ্রাম ভক্ষণযোগ্য মাছের পুষ্টিগুণ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, শিং মাছে আছে প্রোটিন- ২২.৮০ গ্রাম, স্নেহ- ০.৬০ গ্রাম, লোহা- ০.৮০ গ্রাম, ক্যালসিয়াম- ০.৬৭ গ্রাম এবং ফসফরাস -০.৬৫ গ্রাম। মাগুর মাছের ক্ষেত্রে রয়েছে প্রোটিন- ৩২ গ্রাম, স্নেহ- ২.০০ গ্রাম, লোহা- ০.৭০ গ্রাম, ক্যালসিয়াম- ০.১৭২ গ্রাম এবং ফসফরাস- ০.৩০ গ্রাম। অপূর্ব স্বাদ ও পুষ্টিগুণ, উচ্চ বাজারমূল্য এবং ব্যাপক চাহিদা বিবেচনা করলে এসব মাছ চাষ সম্প্রসারণের অপার সম্ভাবনা রয়েছে। বিজ্ঞানসম্মতভাবে আধা-নিবিড় পদ্ধতিতে চাষ করলে দেশী শিং ও মাগুরের উৎপাদন ৫-৬ মেট্রিক টন অর্জন করা সম্ভব ।
শিং মাছের পরিচিতি
সাধারণ নাম: বাংলা- শিং, ইংরেজি- Stinging Catfish
বৈজ্ঞানিক নাম: হেটেরোপনিউসটিস ফসিলিস (Heteropneustes fossilis)
দৈহিক বিবরণ:
- শিং মাছের দেহ লম্বা, সামনের দিক নলাকার, পেছনের দিক দুপাশে চাপা, আঁইশ বিহীন, মাথার উপর-নীচে চ্যাপ্টা।
- নরম ও পাতলা চামড়া দিয়ে গা ঢাকা।
- দেহের রং ছোট অবস্থায় বাদামী লাল এবং বড় অবস্থায় ধূসর কালচে।
- মুখে চার জোড়া গোঁফ (Barbel) থাকে।
- মাথার দুইপাশে বিষাক্ত দুটি কাঁটা (Spine) রয়েছে যা প্রকৃতপক্ষে বক্ষ পাখনার (Pectoral fin) প্রথম পাখনা-রশ্মির (Fin ray) রূপান্তর।
- পৃষ্ঠ পাখনা (Dorsal fin) ছোট এবং প্রান্তভাগ গোলাকৃতি।
- পায়ু পাখনা (Anal fin) বেশ লম্বা, পুচ্ছ পাখনার (Caudal fin) শেষ প্রান্ত গোলাকৃতি।
- পৃষ্ঠদেশের ত্বকের নীচ দিয়ে উভয় পাশে দুটি অতিরিক্ত শ্বসনযন্ত্র (Accessory respiratory organ) রয়েছে যা বায়ু থেকে অক্সিজেন গ্রহণে সক্ষম।
প্রাপ্তি স্থান: বাংলাদেশ, নেপাল, শ্রীলংকা, মায়ানমার, ভারত ও পাকিস্তানে পাওয়া যায়।
বাসস্থান:
- শিং মাছ স্রোতহীন আবদ্ধ পানিতে এদের বেশি দেখতে পাওয়া যায়। আগাছা, কচুরিপানা, পচা লতা-পাতা, ডাল-পালা অধ্যুষিত জলাশয়ে স্বাচ্ছন্দ্যে বসবাস করতে পারে।
- খাল, বিল, প্লাবনভূমি, হাওড়-বাঁওড়, পুকুর, ডোবা- নালা, জলে নিমজ্জিত ধানক্ষেত ইত্যাদি শিং মাছের প্রিয় বাসস্থান।
- এ ছাড়াও প্রতিকূল পরিবেশে (খরার সময়) জলাশয়ের কর্দমাক্ত তলার মাটিতে, গর্তে নিমজ্জিত গাছের গুড়ির তলায় বা সুড়ঙ্গে এরা বসবাস করতে পারে।
রোগবালাই: বিভিন্ন পরজীবীর আক্রমণে শিং মাছের শরীরে ক্ষত রোগ দেখা দেয়।
খাদ্য:
- এরা জলাশয়ের তলদেশ থেকে খাদ্য খেয়ে থাকে। এ মাছ পুকুরের তলায় বসবাসকারী কীট, পোকা ও জৈব পদার্থ খায়। এমনকি পচা কাদামাটিও খেয়ে থাকে।
- এ মাছ প্রয়োগকৃত সম্পূরক খাদ্যও খায়।
- শিং মাছ উচ্চ আমিষ সমৃদ্ধ খাবার খেতে পছন্দ করে।
- প্রকৃতপক্ষে শিং মাছ সাধারণত সর্বভুক (Omnivorous) হয়ে থাকে অর্থাৎ এরা উদ্ভিদ ও প্রাণী উভয় ধরণের খাবার খেয়ে থাকে।
- ছোট অবস্থায় ফাইটোপ্ল্যাঙ্কটন খায় তবে বড় হলে পোকামাকড় খেয়ে থাকে।
- শিং মাছ তাদের জীবনচক্রের বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন ধরনের খাদ্য খেয়ে থাকে। যথা-
- রেণু পর্যায় (Fry): আর্টেমিয়া এবং জু-প্ল্যাঙ্কটন, ক্ষুদ্র জলজ পোকা-মাকড় ইত্যাদি এদের আকর্ষণীয় খাদ্য।
- যৌবন পর্যায় (Juvenile): জুপ্ল্যাঙ্কটন ও ক্ষুদ্র জলজ পোকা, টিউবিফেক্স (Tubifex)।
- বয়ঃপ্রাপ্ত অবস্থা (Adult): জলজ পোকা-মাকড়, তলাবাসী প্রাণী (Benthos), টিউবিফেক্স (Tubifex), ক্ষুদ্র চিংড়ি ও মাছ, ডেট্রিটাস (Detritus), পচা প্রাণীজ দ্রব্যাদি।
চাহিদা:
- এ মাছ সকলের কাছে খুব প্রিয়।
- খেতে সুস্বাদু এবং অধিক পরিমাণে সহজপাচ্য আমিষে সমৃদ্ধ হওয়ায় এটি রোগীর সুস্বাস্থ্যের জন্য উপকারী বলে বিবেচিত হয়।
- ফলে আপামর জনগণের কাছে এর চাহিদা প্রচুর ।
বাজারজাতকরণ:
- শিং মাছ ২৫-৩০ সেমি লম্বা হয়ে থাকে।
- ১৫-২০ সেমি আকারের শিং মাছ প্রায় ৬০০-৮০০ টাকা কেজি দরে বর্তমানে বিক্রি হতে দেখা যায়।
- শিং মাছ এ আকারের হলে জাল দিয়ে ধরে জীবন্ত অবস্থায় বিক্রি করা অধিক লাভজনক। কারণ মরা শিং এর বাজার দর একদম কম।
দেশী মাগুর মাছের পরিচিতি
সাধারণ নাম: বাংলা- মাগুর, ইংরেজি- Walking Catfish।
বৈজ্ঞানিক নাম: ক্লারিয়াস ব্যাট্রাচাস (Clarias batrachas)
দৈহিক বিবরণ:
- মাগুর অস্থিময়, আঁইশ বিহীন, গোঁফ (Barbel) বিশিষ্ট জিওল মাছ।
- মাগুরের মাথা চ্যাপ্টা, মুখ প্রশস্ত।
- পৃষ্ঠ (Dorsal fin) ও পায়ু পাখনা (Anal fin) লম্বা এবং লেজের অংশ পর্যন্ত বিস্তৃত।
- লেজের অংশ চাপা ও শেষ প্রান্ত গোলাকৃতি।
- এর গায়ের রং লালচে বাদামি বা ধুসর কালো।
- মুখে চার জোড়া গোঁফ (Barbel) আছে।
- পৃষ্ঠদেশের ত্বকের নীচ দিয়ে উভয় পার্শ্বে দুটো অতিরিক্ত শ্বসনযন্ত্র (Accessory respiratory organ) রয়েছে, যার ফলে এরা দীর্ঘক্ষণ পানি ছাড়াও বেঁচে থাকতে পারে
প্রাপ্তি স্থান: বাংলাদেশ, পাকিস্তান, মায়ানমার, ভারত, শ্রীলংকা, থাইল্যান্ড ইত্যাদি দেশের সর্বত্রই এ মাছ পাওয়া যায়।
বাসস্থান:
- ডোবা, পুকুর, জলাভূমি, ধানক্ষেত সর্বত্রই এদের অবস্থান।
- এরা কাদাযুক্ত পানিতে বাস করতে পছন্দ করে।
রোগবালাই: মাঝে মাঝে মাগুর মাছের গায়ে ক্ষতরোগ দেখা যায়।
খাদ্য:
- মাগুর মাছ পোকা, শূককীট বা মুককীট জাতীয় প্রাকৃতিক খাবার খেয়ে থাকে।
- কুঁড়া/গমের ভূমি ও অন্যান্য সম্পূরক খাদ্য খায়।
প্রাকৃতিক প্রজনন:
- এ মাছ এক বৎসর বা ২০ সেমি এর মত লম্বা হলেই প্রজনন ক্ষমতা অর্জন করে।
- মে-জুন থেকে আগস্ট-সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এরা বংশবিস্তার করে।
চাহিদা:
- অত্যন্ত সুস্বাদ বলে এ মাছ সকলের কাছে প্রিয়।
- বর্তমানে এর বাজার দর খুব বেশী হবার ফলে ধনী লোকেরাই এ মাছ খেতে পারছে। আমাদের দেশে রোগীর পথ্য হিসেবেও মাগুর মাছ খাওয়া হয়।
বাজারজাতকরণ:
- এ মাছ ২৫-৩০ সেমি লম্বা হলে জাল দিয়ে অথবা পুকুর/ডোবার পানি সেচের মাধ্যমে সব মাছ ধরে বাজারে বিক্রি করা হয়।
- বাজারে জীবিত মাগুরের চাহিদা প্রচুর।
- শহরাঞ্চলে ১৫-২০ সেমি আকারের মাগুর মাছ প্রায় ৭০০-৮০০ টাকা কেজি দরে বিক্রয় হয়।
- অন্যদিকে মরা মাগুরের দাম ও চাহিদা কম।
শিং-মাগুর মাছের প্রাকৃতিক প্রজনন
- শিং-মাগুর মাছ এক বছরেই পরিপক্বতা লাভ করে এবং প্রজননক্ষম হয়। এরা সাধারণত বছরে একবার প্রজনন করে থাকে।
- প্রথম বৎসরেই এ মাছ লম্বায় প্রায় ২০-৩০ সেমি হয়ে যৌবন প্রাপ্ত হয়।
- সাধারণত শিং-মাগুর মাছের উপযুক্ত প্রজননকাল এপ্রিল মাস থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। তবে মে-জুন-জুলাই মাসে সর্বোচ্চ প্রজনন সম্পন্ন করে থাকে।
- সাধারণত স্ত্রী শিং মাছ পুরুষের চেয়ে আকারে বড় হয়ে থাকে। সাধারণত ৬০ থেকে ১০০ গ্রাম ওজনের শিং অথবা ৮০-১৫০ গ্রাম ওজনের মাগুর মাছের ডিম ধারণ ক্ষমতা ৮-১২ হাজার।
- এরা প্লাবনভূমি, ধানক্ষেত, পাটক্ষেত এর মত প্রাকৃতিক পরিবেশের অগভীর ও উদ্ভিদময় এলাকার (জলজ ঝোপ-ঝাড়ে) জলাশয়ে অগভীর তলদেশে গর্তের মতো গঠন তৈরি করে তার মধ্যে মায়েরা ডিম পাড়ে। এর পরপরই বাবারা শুক্রাণু নির্গত করে ডিমকে নিষিক্ত করে থাকে।
- পরিপক্ব ডিম হালকা সবুজ থেকে তামাটে বর্ণের হয়। নিষিক্ত ডিম আঠালো হয় এবং গর্ত সংলগ্ন নিমজ্জিত আগাছা, তৃণ, ডাল-পালা ইত্যাদিতে লেগে থাকে।
- মা-বাবা মাছ নিষিক্ত ডিমগুলো পাহারা দেয় যা ডিম ফুটে বাচ্চা বের হবার পর যতদিনে না তারা স্বনির্ভর হয় ততদিন পর্যন্ত চলে।
পরের পর্ব: হ্যাচারিতে দেশী শিং-মাগুর মাছের কৃত্রিম প্রজনন ব্যবস্থাপনা
তার পরের পর্ব: পুকুরে দেশী শিং-মাগুরের চাষ ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ
তথ্যসূত্র:
- ইনামুল হক, ২০০৬; বাংলাদেশের ছোট মাছ: জীববৈচিত্র্য, চাষ ব্যবস্থাপনা, পুষ্টিমান ও প্রক্রিয়াজাতকরণ; ময়মনসিংহ।
- কাজী ইকবাল আজম গং, ২০১২; দেশীয় শিং ও মাগুর মাছের প্রজনন ও রেণু উৎপাদন, জাতীয় মৎস্য সপ্তাহ ২০১২ সংকলন; মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ; পৃষ্ঠা ১০৯-১১১।
- বিএফআরআই, ১৯৯৭; উন্নত জাতের হাইব্রিড মাগুর উৎপাদন প্রযুক্তি (লিফলেট); বাংলাদেশ মাৎস্য গবেষণা ইনষ্টিট্যুট, স্বাদু পানি কেন্দ্র, ময়মনসিংহ।
- বিএফআরআই, ১৯৯৯; উন্নত জাতের হাইব্রিড মাগুর চাষের কলাকৌশল (লিফলেট); বাংলাদেশ মাৎস্য গবেষণা ইনষ্টিট্যুট, স্বাদু পানি কেন্দ্র, ময়মনসিংহ।
- মৎস্য অধিদপ্তর, ২০০২; দেশী মাগুর ও শিং মাছ এর চাষ, মাছ চাষ ম্যানুয়াল; মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ।
- মৎস্য অধিদপ্তর, ২০০৫; মাছের কৌলিতাত্ত্বিক উন্নয়ন ও ব্রুড স্টক ব্যবস্থাপনা (প্রশিক্ষণ ম্যানুয়াল); মৎস্য অধিদপ্তর, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ।
- মৎস্য অধিদপ্তর, ২০০৯; কৈ, শিং ও মাগুর মাছচাষ ব্যবস্থাপনা, প্রশিক্ষণ মডিউল; মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ।
- মৎস্য অধিদপ্তর, ২০১১; পুকুরে শিং ও মাগুর মাছ চাষ, বার্ষিক মৎস্য সংকলন, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ তথ্য দপ্তর, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়; পৃষ্ঠা ১২০-১২৫।
- মোঃ জাহাঙ্গীর আলম গং, ২০১০; বাণিজ্যিকভিত্তিতে পুকুরে শিং মাছের চাষ, জাতীয় মৎস্য সপ্তাহ ২০১০ সংকলন; মৎস্য অধিদপ্তর, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ; পৃষ্ঠা ৩২।
- সৈয়দ আলী আজহার, ২০১১; হাওর ও উন্মুক্ত জলাশয়ে মাছের প্রাকৃতিক প্রজনন এবং এদের সংরক্ষণ, জাতীয় মৎস্য সপ্তাহ ২০১১ সংকলন; মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ তথ্য দপ্তর, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়; পৃষ্ঠা ৯৬-১০০।
Visited 8,659 times, 1 visits today | Have any fisheries relevant question?