দক্ষিণ ও মধ্য আমেরিকার শান্ত (peaceful) ও শক্ত (hardy) প্রকৃতির ছোটমাছ গাপ্পি। সারা পৃথিবীর মত আমাদের দেশেও এটি একটি জনপ্রিয় বাহারি মাছ (Akhter, 1995)। শুরুতে সিঙ্গাপুর ও থাইল্যান্ড থেকে আমাদের দেশে আমদানি করা হলেও বর্তমানে দেশেই সফলভাবে এর প্রজনন করানো সম্ভব হয়েছে।
শ্রেণীতাত্ত্বিক অবস্থান (Systematic position)
পর্ব: Chordata
শ্রেণী: Actinopterygii (Ray-finned fishes)
বর্গ: Perciformes
পরিবার: Poeciliidae
গণ: Poecilia
প্রজাতি: Poecilia reticulata
শব্দতত্ত্ব (Etymology):
Seriouslyfish (2014) অনুসারে Poecilia শব্দটি এসেছে গ্রীক শব্দ poikilos যার অর্থ বর্ণিল (with a lot of colours) এবং reticulata শব্দটি এসেছে ল্যাটিন শব্দ reticulatus যার অর্থ জালিকাময় (reticulated, having a network-like pattern)।
সমনাম (Synonyms)
Acanthophacelus guppii (Günther, 1866)
Acanthophacelus reticulatus (Peters, 1859)
Girardinus guppii Günther, 1866
Girardinus reticulatus (Peters, 1859)
Lebistes poecilioides De Filippi, 1861
Lebistes reticulatus (Peters, 1859)
Poecilioides reticulatus (Peters, 1859).
সাধারণ নাম (Common name)
বাংলা: গাপ্পি
English: Guppy, Fancy Tail Guppy, Millions Fish, Rainbow Fish
বিস্তৃতি (Distribution)
দক্ষিণ আমেরিকার উত্তর-পূর্ব এবং দক্ষিণ ক্যারিবিয়ানে (southern Caribbean) এদের দেখা মেলে। দেশ অনুসারে এদের পাওয়া যায়- ভেনিজুয়েলা (Venezuela), গায়ানা (Guyana), সুরিনাম (Suriname), ফ্রেঞ্চ গায়ানা (French Guiana) এবং ত্রিনিদাদ ও টোবাগো (Trinidad and Tobago) দ্বীপপুঞ্জ, বার্বাডোস (Barbados), অ্যান্টিগুয়া (Antigua), বারবুডা (Barbuda), নেদারল্যান্ড এন্টিলিস (Netherlands Antilles) ইত্যাদি।
তবে এ্যাকুয়ারিয়ামের বাহারি মাছ হিসেবে গাপ্পি মাছ পৃথিবীর দেশে দেশে বিস্তার লাভ করেছে যেমনটা করেছে বাংলাদেশ।
সংরক্ষণ অবস্থা (Conservation status)
গাপ্পি হুমকিগ্রস্ত (Threatened) প্রজাতির অন্তর্ভুক্ত নয়।
দৈহিক গঠন (Morphology)
লম্বা দেহ পার্শ্বীয়ভাবে চাপা। পুচ্ছ পাখনা বেশ লম্বা ও বাহারি। পৃষ্ঠ পাখনা ও পায়ু পাখনা পরস্পরের বিপরীতে অবস্থান করে। অসংখ্য বর্ণের ও বিভিন্ন আকৃতির পাখনা বিশিষ্ট গাপ্পি মাছ দেখতে পাওয়া যায়।
পাখনা সূত্র (Fin formula): D. 4 P1. 4 P2. 5 A. 4 C. 15-20 (Galib and Mohsin, 2011)
সর্বোচ্চ দৈর্ঘ্য (Maximum length)
Fishbase (2014) অনুসারে পুরুষেরা ৩.৫ সেমি এবং স্ত্রীরা ৬ সেমি পর্যন্ত হয়ে থাকে।
আবাস্থল (Habitat)
শক্ত প্রকৃতির মাছ হিসেবে এর খ্যাতি রয়েছে কারণ কম অক্সিজেন ও দূষিত পানিতেও এরা দিব্যি বেঁচে থাকতে পারে।
গাপ্পি স্বাদুপানি ও ঈষৎ-নোনা জলের মাছ যারা জলাশয়ের তলদেশের নিকটবর্তী স্থানে বসবাস করতে পছন্দ করে (Fishbase, 2014)।
ডোবা, জলা (swamps), ঝর্ণাধারা যেখানে শেওলাসহ অন্যান্য জলজ উদ্ভিদ ও জলাশয়ে বিস্তার-লাভকারী উদ্ভিদ রয়েছে এমন জলাশয়ই এদের প্রথম পছন্দ।
খাদ্য এবং খাদ্যাভ্যাস (Food and feeding habit)
প্রকৃতিতে এরা মূলত পতঙ্গের লার্ভা খেয়ে থাকে তবে অন্যান্য অমেরুদণ্ডী প্রাণীও এরা খেয়ে থাকে। এছাড়াও এরা শেওলা, ডায়াটমস (diatoms), উদ্ভিদের অংশবিশেষ ইত্যাদি খেয়ে থাকে।
এ্যাকুয়ারিয়ামে এরা চালের আটা, সুজি, শুকনো প্যাকেটজাত খাবার এমনকি জীবন্ত খাবারও (মশার লার্ভা ইত্যাদি) খেয়ে থাকে (Galib and Mohsin, 2011)। প্যাকেটজাত খাদ্যের গুণগত মানের উপর নির্ভর করে এদের দেহের বর্ণের বৈচিত্র্যতা দেখা যায়।
জীবনকাল ও প্রজনন (Lifecycle and Breeding)
এর জীবনকাল ৩-৪ বছর। Magurran AE (2005) অনুসারে এদের পুরুষেরা জন্মের সাত সপ্তাহের মধ্যেই পরিণত হয়ে থাকে, স্ত্রীরা জন্মের ১০-২০ সপ্তাহের মধ্যেই বাচ্চা প্রসবে সক্ষমতা অর্জন করে এবং টানা ২০-৩৪ মাস পর্যন্ত এই সক্ষমতা বজায় থাকে।
একই বয়সের স্ত্রীরা পুরুষের চেয়ে দৈহিকভাবে বড় ও হৃষ্টপুষ্ট তবে তুলনামূলক কম বর্ণিল ও ক্ষুদ্রাকার পুচ্ছ পাখনা বিশিষ্ট হয়ে থাকে। পরিণত পুরুষেরা স্ত্রীদের চেয়ে অনেক বেশী বর্ণিল দেহ এবং বৃহৎ ও রঙ্গিন পুচ্ছপাখনা বিশিষ্ট হয়ে থাকে। এই একটি বৈশিষ্ট্যই পুরুষ গাপ্পিকে স্ত্রীদের থেকে আলাদা করেছে। পরিণত পুরুষের পায়ু পাখনা গনোপোডিয়ামে (gonopodium) রূপান্তরিত হয় যা প্রজননের সময় শুক্রাণু স্থানান্তরে বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে (Bailey and Stanford, 1999)। এরা পরিণত হওয়ার পর থেকে প্রায় প্রতি মাসেই বাচ্চা প্রসব করে থাকে (Galib and Mohsin, 2011)।
এরা অণ্ডজরায়ুজ (Ovoviviparous) অর্থাৎ মায়ের দেহাভ্যন্তরে এদের ভ্রূণীয় পরিস্ফুটন সম্পন্ন হয় এবং পরিস্ফুটন শেষে পূর্ণাঙ্গ বাচ্চা প্রসব করে তবে পরিস্ফুটনের সময় প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান মায়ের কাছ থেকে না পেয়ে কুসুম থেকে পেয়ে থাকে। স্ফীত উদর দেখে সহজেই গর্ভবতী মা মাছ চেনা যায়। এদের ভ্রূণীয় পরিস্ফুটনের জন্য চার-ছয় সপ্তাহ সময় প্রয়োজন হয়। এক দফায় মায়েরা পাঁচ থেকে একশতটি পর্যন্ত বাচ্চা প্রসব করে থাকে (Thomas et al., 2003)।
মায়েরা একবার প্রজননে অংশ নেয়ার পর প্রাপ্ত শুক্রাণু একসাথে ব্যবহার না করে কয়েক দফায় ব্যবহার করতে পারে। প্রাপ্ত শুক্রাণু এরা পরবর্তীতে ব্যবহারের উদ্দেশ্যে ছয় মাস পর্যন্ত ডিম্বনালীতে সঞ্চিত করে রাখতে পারে।
এ্যাকুয়ারিয়ামে সহজেই এদের প্রজনন করানো যায়। তবে পরিণত মাছেরা সদ্যজাত বাচ্চা খেয়ে ফেলে বিধায় নিষেকের পরপরই পুরুষদের এবং প্রসবের পরপরই মায়েদের আলাদা এ্যাকুয়ারিয়ামে স্থানান্তর করতে হয়। গাপ্পি মাছের প্রজনন নিয়ে বিস্তারিত রয়েছে এই লেখায়: এ্যাকুয়ারিয়ামে গাপ্পি মাছের প্রজনন
উপযোগী পরিবেশ (Suitable Environment)
এরা শান্তশিষ্ট মাছ। টাইগার বার্ব (tiger barbs) জাতীয় মাছ ছাড়া অন্যান্য মাছের সাথে একই এ্যাকুয়ারিয়ামে রাখা যায়। জলজ উদ্ভিদ রয়েছে এমন এ্যাকুয়ারিয়াম এদের জন্য ভাল।
Seriouslyfish (2014) অনুসারে এদের জন্য ন্যুনতম এ্যাকুয়ারিয়ামের আকার ১৮x১২x১২ ইঞ্চি বা ৪৫x৩০x৩০ সেমি। পানির তাপমাত্রা ১৭-২৮ ° সে. পিএইচ ৭-৮.৫ এবং হার্ডনেস ৯০-৫৩৬ পিপিএম। Fishlore (2014) অনুসারে এদের অনুকূল তাপমাত্রা ৬৬-৮৪° ফা. বা ১৯-২৯° সে., হার্ডনেস ১০-২০ ° dH ও পিএইচ ৭-৮।
প্রকৃতিতে এই মাছের অনুকূল তাপমাত্রা ১৮-২৮ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড (°C), হার্ডনেস ৯-১৯ dH এবং পিএইচ ৭-৮ (FishBase, 2014)।
রোগ (Diseases)
গাপ্পি সহজেই পরজীবী দ্বারা আক্রান্ত হয়ে থাকে। উচ্চ মজুদ ঘনত্বে এরা Tetrahymena sp. নামক পরজীবী দ্বারা এরা মারাত্মকভাবে আক্রান্ত হতে পারে। খারাপ পরিবেশ ও দুর্বল শারীরতাত্ত্বিক অবস্থায় এরা সহজেই Tetrahymena sp. দ্বারা আক্রমণের শিকার হয়ে থাকে (Leibowitz et al., 2005)। কেবলমাত্র কম মজুদ ঘনত্বে লালনপালনের মাধ্যমে এই সমস্যা উত্তরণ করা সম্ভব।
অর্থনৈতিক গুরুত্ব (Economic importance)
এ্যাকুয়ারিয়ামের বাহারি মাছ হিসেবে পৃথিবীব্যাপী এর চাহিদা রয়েছে। সারা পৃথিবীতেই এর চাহিদা থাকায় এবং সহজেই প্রজনন করানো যায় বিধায় এ্যাকুয়ারিয়ামের বাহারি মাছ হিসেবে এর উৎপাদন বাড়িয়ে দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রপ্তানি করা সম্ভব।
এই মাছ বাহারির মাছ হিসেবে ব্যবহৃত হলেও প্রকৃতিতে মশা নিয়ন্ত্রণে এই মাছ ব্যবহারের সম্ভাব্যতা যাচাই এর গবেষণা চলছে। গবেষণাগার প্রাণী হিসেবেও এই মাছের চাহিদা রয়েছে।
অত্যন্ত প্রজননক্ষম হওয়ায় প্রাকৃতিক পরিবেশে দৈবক্রমে অবমুক্ত হয়ে গেলে দেশীয় মাছের উপর ক্ষতিকর প্রভাব পড়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে।
বাজার মূল্য:
বাংলাদেশের সবচেয়ে সস্তা বিদেশী বাহারি মাছের মধ্যে গাপ্পি অন্যতম। প্রতি জোড়া গাপ্পি বর্ণ, বয়স ও আকার অনুযায়ী ১০-৩০ টাকায় বিক্রি হয়ে থাকে (Galib and Mohsin, 2011)।
তথ্য সূত্র (References)
- Akhter MS 1995. Aquarium Guide (in Bengali), published by Echo Aqua Fisheries Project, 1/6
- Bailey M and Stanford G 1999. Practical Fishkeeping, published by Sebastian Kelly, 2 Rectory Road, Oxford OX4 IBW, 128p
- Fishbase 2014. Species Summary: Poecilia reticulata Peters, 1859, Guppy. Retrieved on March 3, 2014.
- Fishlore 2014. Guppy, Fancy Guppy – Poecilia reticulate. Retrieved on March 3, 2014.
- Galib SM and Mohsin ABM 2011. Cultured and Ornamental Exotic Fishes of Bangladesh: Past and Present. LAP LAMBERT Academic Publishing. 176pp.
- Leibowitz MP, Ariav R and Zilberg D 2005. Environmental and physiological conditions affecting Tetrahymena sp. infection in guppies, Poecilia reticulata Peters, Journal of Fish Diseases, 28(9): 539-547.
- Magurran AE 2005. Evolutionary Ecology: The Trinidadian Guppy. New York: Oxford University Press. ISBN 0198527861.
- Seriouslyfish 2014. Poecilia reticulata Peters,1859 Guppy. Retrieved on March 3, 2014.
- Thomas PC, Rath SC and Mohapatra KD 2003. Breeding and Seed Production of Fin Fish & Shell Fish (Foreword by Dr. TVR Pillay), Daya Publishing House, Delhi 110035, India, 377p
Visited 6,837 times, 1 visits today | Have any fisheries relevant question?