বাংলাদেশের বিদেশী বাহারি মাছের মধ্যে অন্যতম আকর্ষণীয় মাছ হচ্ছে পার্ল গোউরামি। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মাছ পার্ল গোউরামি (Trichogaster leerii) আমাদের দেশে আনা হয় থাইল্যান্ড থেকে। বর্তমানে ঢাকা ছাড়াও দেশের বড় বড় শহরের বাহারি মাছের দোকানে এই মাছের দেখা মেলে।
শ্রেণীতাত্ত্বিক অবস্থান (Systematic position)
পর্ব: Chordata (chordates)
শ্রেণী: Actinopterygii (Ray-finned fishes)
বর্গ: Perciformes (perch-like fishes)
পরিবার: Osphronemidae (giant gouramis)
গণ: Trichogaster
প্রজাতি: Trichogaster leerii (Bleeker, 1852)
সমনাম (Synonyms)
Trichogaster leeri (Bleeker, 1852)
Trichopodus leeri (Bleeker, 1852)
সাধারণ নাম (Common name)
বাংলা: পার্ল গোউরামি, মুক্তা গোউরামি
English: Pearl Gourami, Lace Gourami, Diamond Gourami, Leeri Gourami, Mosaic Gourami
বিস্তৃতি (Distribution)
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া প্রধানত থাইল্যান্ড (Thailand) ও ইন্দোনেশিয়ার (Indonesia) জাভা (Java) ও সুমাত্রা (Sumatra)। তবে ব্রুনাই (Brunei) এর বোর্নিও (Borneo) এবং মালয়েশিয়াতেও (Malaysia) এদের দেখতে পাওয়া যায়। বাহারি মাছ হিসেবে এই মাছ পৃথিবীর দেশে দেশে বিস্তার লাভ করেছে যেমনটা করেছে বাংলাদেশ।
সংরক্ষণ অবস্থা (Conservation status)
IUCN, 2014 অনুসারে এরা Near Threatened (NT) অর্থাৎ হুমকির নিকটবর্তী প্রজাতি।
দৈহিক গঠন (Morphology)
লম্বা দেহ পার্শ্বীয়ভাবে বেশ চাপা। বাদামী-রূপালী বর্ণের সারা দেহে (এমনকি পাখনাতেও) মুক্তার মত চকচকে উজ্জ্বল দাগ উপস্থিত। এই উজ্জ্বল দাগগুলো মুক্তার মত চকচক করে বলে বলেই এর নাম হয়েছে পার্ল গোউরামি।
দেহের উভয় পাশে মাঝ বরাবর মাথা থেকে লেজের পূর্ব পর্যন্ত লম্বালম্বিভাবে একটি কালো রেখা দেখতে পাওয়া যায়। রেখাটির শেষের দিকে যেয়ে কিছুটা অস্পষ্ট। পুচ্ছ পাখনার শুরুতে একটা কালো দাগ দেখতে পাওয়া যায়।
এদের শ্রোণীপাখনা (pelvic fin) একটি মাত্র পাখনা-রশ্মি বিশিষ্ট হয়ে থাকে। এই পাখনা-রশ্মিটি অনেকটাই লম্বা।
সর্বোচ্চ দৈর্ঘ্য (Maximum length)
বাংলাদেশে এই মাছের রেকর্ডকৃত সর্বোচ্চ দৈর্ঘ্য তের সেমি (Galib and Mohsin, 2011)।
আবাস্থল (Habitat)
উপকূলীয় এলাকার নিচু জলাভূমি যেমন- সোয়াম্প (swamps), ঝর্ণাধারা (streams) ইত্যাদি (Seriouslyfish, 2014) যেখানে সামান্য অম্লীয় পানির উপস্থিতি রয়েছে এমন জলাশয়ে এরা বাস করে। জলাশয়ের মধ্যতল থেকে উপরিতলের মধ্যে এদের বিচরণ সবচেয়ে বেশি পরিলক্ষিত হয়। জলজ উদ্ভিদের উপস্থিতি এরা পছন্দ করে (Fishbase, 2014)।
ল্যাবিরিন্থ (labyrinth) নামক অতিরিক্ত শ্বাস অঙ্গ থাকায় এরা উষ্ণ জলের কম অক্সিজেন রয়েছে এমন পরিবেশেও দিব্যি বেঁচে থাকতে পারে
খাদ্য এবং খাদ্যাভ্যাস (Food and feeding habit)
এরা প্রকৃতিতে মূলত পতঙ্গের লার্ভা খেয়ে (larvivorous) থাকে (Shammi and Bhatnagar, 2002)। তবে এ্যাকুয়ারিয়ামে এরা ডাফনিয়া (Daphnia), টিউবিফেক্স (Tubifex), ব্রাইন শ্রিম্প (brine shrimp), ছোট ছোট পতঙ্গ (insects) এবং প্যাকেটজাত বাণিজ্যিক খাবার খেয়ে থাকে (Akhter, 1995)।
জীবনকাল ও প্রজনন (Lifecycle and Breeding)
সাধারণত এদের জীবনকাল তিন থেকে চার বছর বা তার কিছু বেশি (Fishlore, 2014)। তবে এ্যাকুয়ারিয়ামে এরা ৮ বছরেরও বেশি বেঁচে থাকতে পারে (Seriouslyfish 2014)।
একই বয়সের পুরুষদের পৃষ্ঠপাখনা স্ত্রীদের চেয়ে লম্বা হয়ে থাকে। পুরুষের বক্ষদেশ লাল বর্ণের হয়ে থাকে যা প্রজননকালে আরও গাঢ় বর্ণ ধারণ করে। এই বৈশিষ্ট্য দেখে সহজেই স্ত্রী ও পুরুষ আলাদা করা যায়।
এরা ডিম পাড়া মাছ। এ্যাকুয়ারিয়ামে এই মাছের প্রজননের উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করতে পারলে সহজেই প্রজনন করানো যায়। প্রজনন এ্যাকুয়ারিয়ামে পানির গভীরতা কম (৬-৮ ইঞ্চি) রাখা প্রয়োজন। পানির তাপমাত্রা হওয়া উচিৎ ৮২° ফা. বা ২৮° সে. বা এর কাছাকাছি। জলজ ভাসমান উদ্ভিদের ঘন উপস্থিতি আবশ্যক। প্রজননের পূর্বে পর্যাপ্ত খাবার সরবরাহ করা প্রয়োজন। তবে পুরুষেরা বাসা তৈরি শুরু করলে খাবার সরবরাহ কমিয়ে দিতে হয় কারণ সেসময় এরা খাবার গ্রহণ করেনা বললেই চলে। স্ত্রীদের উদর যখন ডিম ধারণের কারণে স্ফীত হয়ে যায় তখন পুরুষেরা জলজ উদ্ভিদের ফাঁকে ফাঁকে পানির উপরিতলে বাতাস ও মিউকাস ব্যবহার করে বুদবুদের বাসা (bubble nest) তৈরি করে যার ব্যাস ১০ ইঞ্চি পর্যন্ত হতে পারে। বুদবুদের বাসার নীচেই এরা প্রজননে অংশ নেয়। পুরুষেরা পায়ু পাখনা স্পর্শ করে স্ত্রীদের ডিম পাড়তে উদ্বুদ্ধ করে। স্ত্রীরা ডিম পাড়ার পর পুরুষেরা সেই ডিম প্রথমে নিষিক্ত করে এবং পরবর্তীতে বুদবুদের বাসায় সংরক্ষণ করে যতদিন না ডিম ফুটে বাচ্চা বের না হয়। বাবারা ডিম ও বাচ্চা পাহারা দেয়। সাধারণত এক থেকে দুই দিনের মধ্যেই ডিম ফুটে বাচ্চা বের হয় এবং পাঁচ দিনের মধ্যেই বাচ্চারা বাসা থেকে বের হয়ে আসতে শুরু করে এবং সাঁতার ও শিকারে পটু হতে থাকে। তখন বাচ্চার জন্য খাবার (ডিমের কুসুম মিহি করে পানিতে গুলিয়ে) সরবরাহ করতে হয়।
একবার জুটি বাঁধার পর স্ত্রীরা কয়েক দফায় ডিম দেয় যা স্ত্রী মাছের আকার ও বয়সের উপর নির্ভর করে সাত বার পর্যন্ত হতে পারে (Aquaticcommunity, 2014)। ডিম দেয়া শেষ হলে মা মাছকে আলাদা এ্যাকুয়ারিয়ামে সরিয়ে নিতে হয় কারণ ডিম পাড়া শেষ হলে মা মাছের মধ্যে ডিম ও পোনাকে খেয়ে ফেলার প্রবণতা দেখতে পাওয়া যায়। বাচ্চারা বাসা থেকে বের হতে শুরু করলে বাবাদেরও অন্য এ্যাকুয়ারিয়ামে সরিয়ে নিতে হয়।
উপযোগী পরিবেশ (Suitable Environment)
প্রকৃতিতে এই মাছের অনুকূল পরিবেশ হচ্ছে- পিএইচ (pH): ৬-৮, হার্ডনেস (Hardness): ৫-১৯ dH এবং তাপমাত্রা ২৪-২৮ ডিগ্রী সে (Fishbase, 2014)।
Seriouslyfish (2014) অনুসারে এদের জন্য ন্যুনতম এ্যাকুয়ারিয়ামের আকার ৩৬x১২x১২ ইঞ্চি বা ৯০x৩০x৩০ সেমি এবং এ্যাকুয়ারিয়ামের পানির তাপমাত্রা ৭৫-৮৬ ° ফা. বা ২৪-৩০ ° সে., হার্ডনেস ২-৩০ dH এবং পিএইচ ৫.৫-৮।
Fishlore (2014) অনুসারে এ্যাকুয়ারিয়ামে এদের অনুকূল তাপমাত্রা ৭৭-৮২° ফা. বা ২৫-২৮° সে., হার্ডনেস ৫-১৫ ° dH এবং পিএইচ ৬-৮।
রোগ (Diseases)
বাংলাদেশে এই মাছের রোগের উপস্থিতি বিষয়ক কোন তথ্য জানা যায় না।
অর্থনৈতিক গুরুত্ব (Economic importance)
এ্যাকুয়ারিয়ামের বাহারি মাছ হিসেবে পৃথিবীব্যাপী এর চাহিদা রয়েছে। শান্ত প্রকৃতির এই মাছের ব্যবস্থাপনা সহজ হওয়ার জন্য যারা এ্যাকুয়ারিয়ামে বাহারি মাছ পালন শুরু করতে আগ্রহী তারা এই মাছ নির্বাচন করতে পারেন। এছাড়াও অনাকাঙ্ক্ষিত জলজ প্রজাতির লার্ভা (larvae) নিয়ন্ত্রণে এদের ব্যবহার করা যেতে পারে। যেমন এরা এ্যাকুয়ারিয়ামের জন্য ক্ষতিকর প্রাণী হাইড্রা (hydra) খেয়ে উপকার করে থাকে (Seriouslyfish 2014)।
বাজার মূল্য:
বাংলাদেশে প্রতি জোড়া পার্ল গোউরামি পাওয়া যায় ৫০-২০০ টাকার মধ্যে (Galib and Mohsin, 2011)।
তথ্য সূত্র (References)
- Akhter, M.S., 1995. Aquarium Guide (in Bengali), published by Echo Aqua Fisheries Project, 1/6 Pallabi, Mirpur, Dhaka, Bangladesh, pp. 51-71.
- Aquaticcommunity 2014. Breeding the Pearl Gourami – Trichogaster leeri. Retrieved on March 17, 2014.
- Fishbase 2014. Species Summary: Trichopodus leerii (Bleeker, 1852) Pearl gourami. Retrieved on March 17, 2014.
- Fishlore 2014. Pearl Gourami (Trichogaster leeri). Retrieved on March 17, 2014.
- Galib SM and Mohsin ABM 2011. Cultured and Ornamental Exotic Fishes of Bangladesh: Past and Present. LAP LAMBERT Academic Publishing. 176pp.
- IUCN Redlist 2014. Trichopodus leerii. Retrieved on March 17, 2014.
- Seriouslyfish 2014. Species Profile: Trichopodus leerii, Pearl Gourami. Retrieved on March 17, 2014.
- Shammi QJ and Bhatnagar S 2002. Applied Fisheries, Published by Agrobios (India), Agro House, Behind Nasrani Cinema, Chopasani Road, Jodhpur 342 002, India, 328 p.
Visited 1,547 times, 1 visits today | Have any fisheries relevant question?