দক্ষিণ আমেরিকার মাছ এঞ্জেল (Angel, Pterophyllum scalare) এ্যাকুয়ারিয়ামের বাহারি মাছ হিসেবে থাইল্যান্ড ও ভারত থেকে প্রথম আমাদের দেশের নিয়ে আসে বাহারি মাছের ব্যবসায়ীরা। বর্তমানে ঢাকা ছাড়াও দেশের অন্যান্য বড় শহরের (যেমন চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী ইত্যাদি) বাহারি মাছের দোকানে এই মাছের দেখা মেলে।
শ্রেণীতাত্ত্বিক অবস্থান (Systematic position)
পর্ব: Chordata (chordates)
শ্রেণী: Actinopterygii (Ray-finned fishes)
বর্গ: Perciformes (perch-like fishes)
পরিবার: Cichlidae (cichlids)
গণ: Pterophyllum
প্রজাতি: Pterophyllum scalare Schultze, 1823
ভ্যারাইটি (Variety):
মার্বেল এঞ্জেল (Marble Angel), সাদা এঞ্জেল (White Angel), কালো এঞ্জেল (Black Angel) এবং রূপালী এঞ্জেল (Silver Angel)।
সমনাম (Synonyms)
Platax scalaris Cuvier and Valenciennes, 1831
Plataxoides dumerilii Castelnau, 1855
Pterophyllum dumerilii (Castelnau, 1855)
Pterophyllum eimekei Ahl, 1928
Zeus scalaris Schultze, 1823
সাধারণ নাম (Common name)
বাংলা: এঞ্জেল। এছাড়া ভ্যারাইটি অনুসারে এদের সাধারণ নাম ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে যেমন- মার্বেল এঞ্জেল, সাদা এঞ্জেল, কালো এঞ্জেল এবং রূপালী এঞ্জেল।
English: Angel; Marble Angel, White Angel, Black Angel, Silver Angel etc. (according to variety)
বিস্তৃতি (Distribution)
Loe (2014) অনুসারে প্রকৃতিতে এদের বিস্তার দক্ষিণ আমেরিকার আমাজন নদী ও নদী সংলগ্ন জলাশয় (Amazon River basin), পেরু (Peru), কলম্বিয়া (Colombia), ব্রাজিল (Brazil), ফরাসি গিয়ানা (French Guiana) ও গায়ানা (Guyana)।
তবে বাহারি মাছ হিসেবে এঞ্জেল পৃথিবীর দেশে দেশে বিস্তার লাভ করেছে যেমনটা করেছে বাংলাদেশ।
Fishbase (2014) অনুসারে প্রকৃতিতে এদের বিস্তৃতি 6°N – 10°S, 78°W – 51°W ।
সংরক্ষণ অবস্থা (Conservation status)
IUCN 2013 অনুসারে আইইউসিএন এর হুমকিগ্রস্ত প্রজাতির লাল তালিকায় (The IUCN Red List of Threatened Species) এদের অবস্থান Not Evaluated অর্থাৎ এই মাছের সংরক্ষণ অবস্থা এখনও মূল্যায়ন করা হয়নি।
দৈহিক গঠন (Morphology)
ডিস্ক আকৃতির (disc-shaped) দেহ পার্শ্বীয়ভাবে বেশ চাপা। এদের শ্রোণীপাখনায় একটিমাত্র পাখনা রশ্মি দেখতে পাওয়া যায় যা সুতার মত লম্বা হয়ে প্রায় পুচ্ছ পাখনা পর্যন্ত পৌঁছায়। পৃষ্ঠ ও পায়ু পাখনার বিস্তৃত পাখনা রশ্মি সাঁতারের সময় এদেরকে উড়ন্ত পাখির ডানার মতই সৌন্দর্যমণ্ডিত করে তোলে।
সাধারণত রূপালী বর্ণের দেহে ক্ষুদ্রাকার অসংখ্য কালো ফোটা বা দাগ দেখতে পাওয়া যায়। ভ্যারাইটি অনুসারে এই কালো ফোটার ঘনত্ব স্থানভেদে ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে (Galib and Mohsin, 2011)। যেমন মার্বেল এঞ্জেলে এই কালো ফোটা এমনভাবে বিন্যস্ত যে তা সারা দেহেই অনিয়মিতভাবে ডোরাকাটা দাগ (band) তৈরি করে যা পৃষ্ঠ, অঙ্কীয় ও পাচ্ছ পাখনাতেও বিদ্যমান। রূপালী এঞ্জেলে কালো ফোটা এমনভাবে বিস্তৃত যে মাথায় চোখ বরাবর একটি, ধড়ে দুটি (যার মধ্যে একটি পৃষ্ঠ ও অঙ্কীয় পাখনা পর্যন্ত বিস্তৃত) এবং লেজে পাঁচটি ডোরাকাটা দাগ তৈরি করে। কালো এঞ্জেলে পাখনাসহ প্রায় সারা দেহেই কালো ফোটার ঘনত্ব সমভাবে বিস্তৃত হওয়ার ফলে সম্পূর্ণ মাছকেই কালো দেখায়। অন্যদিকে সাদা এঞ্জেলে কালো ফোটা অনুপস্থিত বা নেই বললেই চলে।
Galib and Mohsin (2011) অনুসারে এদের আদর্শ দৈর্ঘ্য, দেহ উচ্চতা (body depth), মাথার দৈর্ঘ্য ও পুচ্ছদণ্ড (caudal peduncle) মোট দৈর্ঘ্যের যথাক্রমে ৪৬-৬৯, ৩২-৫০, ১৯-৩০ ও ৩-৬ শতাংশ। চোখের ব্যাস মাথার দৈর্ঘ্যের ২৪-৫৩ শতাংশ।
সর্বোচ্চ দৈর্ঘ্য (Maximum length)
এরা ৫ ইঞ্চি বা ১২.৭ সেমি পর্যন্ত লম্বা হতে পারে (Saxena, 2003)। Fishkeeping (2014) অনুসারে এদের সর্বোচ্চ দৈর্ঘ্য ১৫সেমি।
আবাস্থল (Habitat)
এরা উষ্ণ জলের স্বাদুপানির মাছ। সোয়াম্প (swamps) ও প্লাবনভূমির যে স্থানের তলদেশ বালিময় বা জল স্বচ্ছ এবং জলজ উদ্ভিদে পরিপূর্ণ সেসব স্থান এরা পছন্দ করে (Eol, 2014)।
খাদ্য এবং খাদ্যাভ্যাস (Food and feeding habit)
প্রকৃতিতে এরা প্রধানত মাংসাশী ও শিকারি। এরা প্রধানত জুবেন্থোস (zoobenthos) তলাবাসী ক্রাস্টেশিয়ানস (benthic crustaceans), আর্টিমিয়ার নাউপ্লি লার্ভা (Artemia nauplii), চিংড়ি (shrimps/prawns) লার্ভা ইত্যাদি খেয়ে থাকে। মাংসাশী হলেও এরা উদ্ভিদজাতীয় খাবারও খেয়ে থাকে।
এরা ধীরগতির ও লাজুক প্রকৃতির মাছ। সাধারণত ক্ষুধার্ত না থাকলে এরা আলো বা মানুষের উপস্থিতিতে খাবার গ্রহণ করে না। এ্যাকুয়ারিয়ামে ভাসমান ক্ষুদ্রাকার খাবার এদের প্রথম পছন্দ। তবে বাহারি মাছের দোকানে প্রাপ্ত বিভিন্ন ধরণের প্যাকেটজাত বাণিজ্যিক মাছের খাবার যেমন- ফ্লেকস (flakes), পিলেট (pellets) ইত্যাদিও এরা খেয়ে থাকে তবে এসব খাবার ভেঙ্গে ক্ষুদ্রাকারে প্রদান করা এদের জন্য সুবিধাজনক ।
এ্যাকুয়ারিয়ামে জীবন্ত খাবার যেমন- আর্টিমিয়ার লার্ভা, রক্তকীট (bloodworm) ইত্যাদিও খাওয়ানো যেতে পারে।
জীবনকাল ও প্রজনন (Lifecycle and Breeding)
এদের জীবনকাল আট থেকে দশ বছর বা তার কিছু বেশি (Fishlore 2014)।
এদের পুরুষ ও স্ত্রী মাছ আলাদা তবে প্রজননের ঋতু ব্যতীত অন্য সময় এদের মধ্যে পার্থক্য করা খুবই কঠিন। প্রজনন ঋতুতে স্ত্রীদের জনন-ছিদ্রের (vent) আকৃতি জলের ফোটার (tear-drop) ন্যায় হয়ে থাকে অন্যদিকে পুরুষের জনন-ছিদ্রের আকৃতি মোচাকার (cone) হয়ে থাকে। Thomas et al. (2003) অনুসারে স্ত্রীদের জনন-ছিদ্রের ব্যাস পুরুষদের চেয়ে দ্বিগুণ হয়ে থাকে।
প্রজননের শুরুতেই স্ত্রী ও পুরুষ মাছ জুটিবদ্ধ হয় এবং প্রজননচক্র শেষ না হওয়া পর্যন্ত তারা একত্রে ডিম ও বাচ্চার সুরক্ষার দায়িত্ব পালন করে। এরা জলজ উদ্ভিদের উপস্থিতি রয়েছে এমন স্থানে ডিম্বাকৃতির (ovoid) ডিম পাড়ে এবং স্ত্রীরা ডিম পাড়ার পর ডিমগুলো জলজ উদ্ভিদের উপরিভাগে আটকে যায়। পুরুষেরা ডিমগুলো নিষিক্ত করে। মা ও বাবা মাছেরা ডিমগুলো পাহারা দেয় যতক্ষণ না ডিম ফুটে বাচ্চা বের হয়।
এ্যাকুয়ারিয়ামে এদের প্রজনন করাতে চাইলে প্রজনন ঋতু শুরু হওয়ার কয়েক (৮-১০) মাস পূর্বেই কয়েক জোড়া তরুণ (juvenile) এঞ্জেলকে একটি এ্যাকুয়ারিয়ামে স্থানান্তর করতে হবে। এদের জীবন্ত খাবার যেমন রক্তকীট (bloodworms, হিমায়িত ব্রাইন শ্রিম্প (frozen brine shrimp), গরুর হৃদযন্ত্রের টুকরা (beef heart mixture) ইত্যাদির পাশাপাশি ফ্লেকস (flakes) বা পিলেট (pellets) খাওয়াতে হবে। প্রজনন ঋতুতে এদের মধ্যে জোড় বাধার প্রবণতা পরিলক্ষিত হলে তাদের নিয়মিত পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে। সেখান থেকে জোড় বাধা এক জোড়া এঞ্জেলকে প্রজনন এ্যাকুয়ারিয়ামে স্থানান্তর করতে হবে। প্রজনন এ্যাকুয়ারিয়ামের পানির তাপমাত্রা ৭৮-৮০° ফা. বা তার চেয়ে কম এবং পিএইচ ৭.৫ বা তার চেয়ে কম হওয়া ভাল। প্রজনন এ্যাকুয়ারিয়ামে জলজ উদ্ভিদ বা কাঠের টুকরা বা ফুলদানী বা পিভিসি পাইপ স্থাপন করা আবশ্যক যাতে ডিমগুলো এসবের তলের সাথে আটকে যেতে পারে। পুরুষেরা ডিম নিষিক্ত করলে মা ও বাবা মাছকে অন্য এ্যাকুয়ারিয়ামে স্থানান্তর করা আবশ্যক।
Bishnoi (2013) অনুসারে এ্যাকুয়ারিয়ামে এক প্রজনন ঋতুতে এরা গড়ে ১৮০ থেকে ২৯০টি ডিম পাড়ে। ডিম পাড়ার পরিমাণ মা মাছের আকার, এ্যাকুয়ারিয়ামের পরিসর ও পরিবেশ, মা-বাবা মাছের লালন-পালনের সময়কাল ইত্যাদির উপর নির্ভরশীল।
উপযোগী পরিবেশ (Suitable Environment)
স্বাদুপানির এই মাছ জলাশয়ের তলদেশের কাছাকাছি থাকতে পছন্দ করে। প্রকৃতিতে এই মাছের অনুকূল পরিবেশ হচ্ছে- পিএইচ (pH): ৬-৮, হার্ডনেস (Hardness): ৫-১৩ dH, এবং তাপমাত্রা: ২৪-৩০ ডিগ্রী সে (Fishbase, 2014)।
Fishlore (2014) অনুসারে এ্যাকুয়ারিয়ামে এদের অনুকূল তাপমাত্রা ৭৪-৮৪° ফা. বা ২৩-২৯° সে., হার্ডনেস (Hardness): ৫-১৩ dH এবং পিএইচ ৬-৭.৫।
Fishkeeping (2014) অনুসারে এঞ্জেলের জন্য এ্যাকুয়ারিয়ামের আয়তন কমপক্ষে ৩৬x১৮x১৫ ইঞ্চি এবং পানি ধারণ ক্ষমতা ১৬০ লিটার হওয়া আবশ্যক এবং জলজ উদ্ভিদ ও হালকা পানির প্রবাহের উপস্থিতি এদের বসবাসস্থল হিসেবে সুবিধাজনক । প্রজনন ঋতু ব্যতীত অন্যান্য সময় এরা শান্ত প্রকৃতির মাছ। তাই এদেরকে অন্যান্য মাছের সাথে সহজেই রাখা যায় তবে খুব ছোট আকারের মাছের সাথে না রাখাই ভাল।
এদের ঠাণ্ডা সহ্য করার ক্ষমতা কম। আমাদের দেশে ডিসেম্বর ও জানুয়ারিতে এ্যাকুয়ারিয়ামে জল-উনান (water heater) ব্যবহার করা আবশ্যক।
রোগ (Diseases)
বাংলাদেশে এই মাছে র রোগের উপস্থিতি বিষয়ক কোন তথ্য পাওয়া যায় না। তবে এ্যাকুয়ারিয়ামে অন্য শিকারি মাছ দ্বারা আক্রান্ত হলে পাখনা পচা (Fin rot) রোগ দেখা দিতে পারে (fishkeeping, 2014)। Eol (2014) অনুসারে এদের পরজীবী (প্রোটোজোয়া (protozoa), কীট (worms, Nematode) ইত্যাদি) ঘটিত সংক্রমণ, ব্যাকটেরিয়া (যেমন- Pseudomonas) ঘটিত সংক্রমণ, ছত্রাকজনিত রোগ, পপ-আই রোগ (Pop-eye disease) ইত্যাদি হতে পারে।
অর্থনৈতিক গুরুত্ব (Economic importance)
দৃষ্টিনন্দন বৈশিষ্ট্যের কারণে এ্যাকুয়ারিয়ামের বাহারি মাছ হিসেবে অত্যন্ত জনপ্রিয় (Galib, 2011)। শক্ত প্রকৃতির এই মাছের ব্যবস্থাপনা সহজ হওয়ায় যারা এ্যাকুয়ারিয়ামে বাহারি মাছ পালন শুরু করতে আগ্রহী তারা এই মাছ নির্বাচন করতে পারেন নিশ্চিতভাবেই।
পৃথিবীব্যাপী এর চাহিদা থাকায় পোনা উৎপাদন করে দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রপ্তানি করা সম্ভব।
Shammi and Bhatnagar (2002) অনুসারে এরা শূককীট (larvae) খেয়ে থাকে বিধায় এদের মশা নিধনে ব্যবহার করা যেতে পারে।
এদের ঠাণ্ডা সহ্য করার ক্ষমতা কম। আমাদের দেশে ডিসেম্বর ও জানুয়ারিতে এ্যাকুয়ারিয়ামে জল-উনান (water heater) ব্যবহার না করলে এদের মৃত্যু হার বেড়ে যেয়ে বাহারি মাছের ব্যবসায়ীর আর্থিক ক্ষতি হতে পারে। অন্যদিকে বাহারি মাছের লালন-পালনকারীরা রঙ্গিন মাছ লালন-পালনে আগ্রহ হারিয়ে ফেলতে পারে।
শিকারি বৈশিষ্ট্যের কারণে এই মাছ প্রকৃতিতে উন্মুক্ত হয়ে পড়লে তা প্রাকৃতিক পরিবেশের উপর নানাবিধ বাস্তুতাত্ত্বিক ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে বলে ধারনা করা হয়।
বাজার মূল্য:
বাংলাদেশে ৫০-২০০ টাকায় এক জোড়া এঞ্জেল পাওয়া যায় (Galib and Mohsin, 2011)।
তথ্য সূত্র (References)
- Bishnoi RK. 2013. Study of rearing and breeding of angle fish (Pterophyllum scalare) in glass aquarium. Indian Journal of Fundamental and Applied Life Sciences. Vol. 3 (2) April-June, pp. 53-57
- Eol. 2014. Pterophyllum scalare, Freshwater Angelfish. Retrieved on May 04, 2014.
- Fishbase. 2014. Specie Summery: Pterophyllum scalare (Schultze, 1823), Freshwater angelfish. Retrieved on May 04, 2014.
- Fishkeeping. 2014. Freshwater Angelfish. Retrieved on May 04, 2014.
- Fishlore M. 2014. Fish Profile: Freshwater Angelfish – Pterophyllum scalare. Retrieved on May 04, 2014.
- Galib SM. 2011. Exotic Fishes of Bangladesh: Angelfish – Pterophyllum scalare Schultze, 1823. Retrieved on May 04, 2014.
- Galib SM and Mohsin ABM. 2011. Cultured and Ornamental Exotic Fishes of Bangladesh: Past and Present. LAP LAMBERT Academic Publishing. 176pp.
- IUCN 2013. IUCN Red List of Threatened Species. Version 2013.2. www.iucnredlist.org. Retrieved on May 04, 2014.
- Saxena A. 2003. Aquarium Management. Daya Publishing House, Delhi 110035, India, 230 p.
- Shammi QJ and Bhatnagar S. 2002. Applied Fisheries, Published by Agrobios (India), Agro House, Behind Nasrani Cinema, Chopasani Road, Jodhpur 342 002, India, 328 p.
- Thomas PC, Rath SC and Mohapatra KD. 2003. Breeding and Seed Production of Fin Fish & Shell Fish (Foreword by Dr. T.V.R. Pillay), Daya Publishing House, Delhi 110035, India, 377 p.
Visited 5,273 times, 1 visits today | Have any fisheries relevant question?