একটা সময় ছিল যখন নদী থেকে ধরা হোক আর বাজার থেকে আনাই হোক, ঢাউস সাইজের মাছ ঘরে নিয়ে আসার পর হুলুস্তুল পড়ে যেতো, সবাই মিলে মাছ কাটা উপভোগ করতো। এটি ছিল গ্রামবাংলার অন্যতম ঐতিহ্যের একটি। কিন্তু কালের বিবর্তনে শহুরে জনপদে মাছ কাটা আর তেমন কোন উপভোগ্য বিষয় নয়। ক্রয়-কৃত মাছ বড় হওয়া তো দুরের কথা ছোট হলেও চাকুরীরত দম্পতিদের বাসায় মাছ কাটাকুটি একটা বিরক্তিকর বিষয়। তাই শহর বা শহরতলীর বেশিরভাগ বাসিন্দারাই মাছ কিনে বাজার থেকেই কাটাকুটির ঝামেলা সম্পন্ন করে আনেন। দেশের বড় বড় শহরে মাছ কাটাকুটি একটা পেশা হিসেবেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যদিও এ পেশায় নিয়োজিতরা খুব কমই আয় করে থাকে। প্রচলিত বাজারদর অনুসারে প্রতি কেজি টেংরার জন্য গড়ে ৪০টাকা, রুইজাতীয় মাছসহ পাঙ্গাশের জন্যে ২০টাকা, বড় আকারে মাছ প্রতিটির জন্য ৫০-২০০ টাকা ইত্যাদি। কোন অনুষ্ঠানে চুক্তিতে কাজ হলে সাধারণত মন প্রতি হাজার টাকা। তবে সামান্য কিছু পরিমার্জন ও উন্নয়ন করা গেলে এই পেশা থেকে আয় অনেকাংশে বৃদ্ধি করা সম্ভব। সেই সম্ভাবনা নিয়েই আজকের এই আয়োজন।
এই পেশায় আয়-রোজগার কেমন:
মিরপুর ৬ নম্বর বাজারের ফরিদ (ছদ্ম নাম) সপ্তাহের প্রায় প্রতিদিনই কাজ করেন। সকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত কাজ চলে ক্রমাগত। একা পারছেন না, তাই তিন জন সহকারী রয়েছে যারা কাটাকুটির প্রথম পর্বের কাজ অর্থাৎ মাছের আইঁশ ছাড়িয়ে দেয়। বিনিময়ে মাছ প্রতি ৩-৫টাকা পর্যন্ত পায়। বাদবাকি কাটাকুটির কাজটা সে নিজে করে। দর মাছ প্রতি ২০ টাকা, তবে আকার বড় হলে আলোচনা সাপেক্ষে দর চূড়ান্ত হয়। সহকারীর মজুরীর টাকা, মসজিদ পরিষদকে পরিষ্কার খরচা ও বিদ্যুৎ বাবদ ১২০ টাকা দৈনিক দেয়ার পরও দের-দুই হাজার টাকা দৈনিক আয় থাকে। বিয়ে-শাদি বা এজাতীয় অনুষ্ঠানের মাছ কাটায় ভাল আয় হয়। অনুষ্ঠানের পরিধি অনুযায়ী যাওয়া-খাওয়ার বাইরে অন্ত:ত ২০০০-৪০০০ টাকা পর্যন্ত পাওয়া যায়। ঢাকার বাইরের চিত্রটা কিছুটা ভিন্ন। শহরের অনেক বাজার আছে যা প্রতি দিনই খোলা থাকে। তবে উপজেলা পর্যায়ে সাধারণত: সপ্তাহে দুদিন করে মাসে মোট ৮ দিন হাট বসে। আর বাজার বা হাটের দিনই ক্রেতা বেশী পাওয়া যায়। তাছাড়া এলাকায় বড় কোন বিয়ে-শাদি ও আচার-অনুষ্ঠানও মাছের পদ থাকলে এরকম কাজের সুযোগ পাওয়া যায়, যা থেকে অনুষ্ঠান প্রতি গড়ে ২০০০ টাকা আসে। তার বাইরেও দৈনিক গড়ে ৬০০-১০০০ টাকা আয় হয়, সে হিসাবে মাসিক আয় হয় ২৫০০০-৩০,০০০ টাকা। তবে শীতকালে আচার-অনুষ্ঠান বেশী হয় মাছের ক্রয়-বিক্রয়ও অপেক্ষাকৃত বেশী থাকায় এই পেশায় আয়ও ভাল থাকে। এছাড়াও বাড়তি আয়ের জন্য কেউ কেউ কলেজ বা পুলিশ হোস্টেলে নিয়মিত মাছ কাটার কাজ করেন। আবার কেউ কেউ আশপাশের অন্যান্য বাজারেও বাড়তি সময়ে এই কাজ করেন।
পরিমার্জন, উন্নয়ন ও সম্ভাবনা:
এ পেশায় যারা কাজ করেন তারা কাটা মাছের ছাড়ানো আঁইশ এবং মাছের মাথা থেকে পিজি সংগ্রহ করে (ক্রেতার অনুমোদন সাপেক্ষে) বিক্রিয় ব্যবস্থা করতে পারেন তবে মাছ কাটাকুটি থেকে আয়ের পরিমাণ বহুলাংশে বাড়াতে পারেন। তবে এজন্য প্রয়োজন সমন্বিত উদ্যোগ ও প্রশিক্ষণ। প্রথমত ক্রেতার সম্মতি, দ্বিতীয়ত আঁইশ সংগ্রহ ও পিজি সংগ্রহ এবং বাজারজাতকরণের বিষয়ে সমন্বিত ব্যবস্থাপনা গ্রহণ করা সম্ভব হলে এ পেশা থেকে আয় বাড়ানো সম্ভব। যাই হোক তার আগে জেনে নেয়া যাক মাছের পিজি ও দেশীয় বাজারে এর চাহিদা সম্পর্কে।
মাছের পিজি পরিচিতি:
পিজির পূর্ণরূপ হচ্ছে পিটুইটারি গ্লান্ড (pituitary gland) যা মাথার খুলির মধ্যস্থ মস্তিষ্কের পেছনে অবস্থিত একটি কুঠরিতে থাকে। মেরুদণ্ডী সকল প্রাণীরই পিজি থাকে যা থেকে নির্দিষ্ট সময়ে নি:সৃত হরমোন তাকে প্রজনন কাজে প্রণোদিত করে। হ্যাচারিতে কৃত্রিম উপায়ে মাছকে প্রজননে প্রণোদিত করার জন্য হ্যাচারিতে এই পিজি হরমোন ব্যবহৃত হয়। তবে ইদানীং দামে সাশ্রয়ী সিনথেটিক হরমোন ব্যবহার করা হলেও এখনও প্রাকৃতিক পিজির বিশাল চাহিদা রয়েছে বিশেষত মৌসুমের শুরুর দিকে।
দেশীয় বাজারে পিজির চাহিদা:
বাংলাদেশে বর্তমানে ছোট-বড় মিলিয়ে সচল কার্প হ্যাচারির সংখ্যা প্রায় ৯৬৪টি। যেখানে মাছের প্রণোদিত প্রজননের পাশাপাশি কৃত্রিম প্রজনন ঘটানো হয়। কৃত্রিম উপায়ে মাছকে প্রজননে প্রণোদিত করার জন্য হ্যাচারিতে ইদানীং দামে সাশ্রয়ী সিনথেটিক হরমোনের ব্যবহার বাড়লেও মৌসুমের শুরুতে ব্যাপকভাবে পিজির ব্যবহার রয়েছে। পিজির চাহিদার প্রায় পুরোটাই আসে প্রতিবেশী দেশ ভারত থেকে। মৎস্য উদ্যোক্তা জনাব লিয়াকত এর মতে, প্রতি মৌসুমে গড়ে একটি হ্যাচারি যদি ৫০,০০০ পিজি ( প্রতির গড় ওজন ২ মিলিগ্রাম) ব্যবহার করে, তাহলে মোট চাহিদার পরিমাণ দাড়ায় ৪৮মিলিয়ন। গড়ে প্রতিটি পিজির মূল্য ০৭ টাকা হারে পিজির মোট মূল্য আসে ৩৩ কোটি টাকা, যার বেশিরভাগই প্রতিবেশী দেশ ভারত থেকে আমদানি করা হয়ে থাকে।
পিজি বাজারজাতকরণে দেশীয় উদ্যোগ: একটি কেস স্টাডি
দেশের একমাত্র উদ্যোক্তা যশোরের লিয়াকত আলীর (ইউনাইটেড এগ্রোফিশ) মতে, দেশের বাজারে গড়ে প্রতিদিন পঞ্চাশ লাখ (৫০,০০,০০০) রুইজাতীয় মাছসহ অন্যান্য প্রজাতির বড় আকারের মাছ বিক্রয় হয়, যা থেকে সমসংখ্যক পিজি সংগ্রহ সম্ভব। সে হিসাবকে বিবেচনায় রেখে তিনি এই পিজি স্থানীয়ভাবে সংগ্রহ ও বিক্রয়ের ব্যবসা শুরু করেছিলেন ১৯৮৩ সালে। ১৯৯০ সালে যশোরে একটি পিজি প্রদর্শনী কক্ষও চালু করে। অত:পর নানা ঘাত প্রতিঘাতের মধ্যদিয়ে ২০১২ সালে এসে ব্যবসা করার রেজিস্ট্রেশন পান। পিজি প্রক্রিয়াজাতকরণ গবেষণাগারটি প্রথমে বাড়িতে করা হলেও পরে যশোর শহরের মুক্তিযোদ্ধা মার্কেটে স্থানান্তর করা হয়। যশোর-খুলনা এলাকার বিভিন্ন বাজারে ওনার প্রশিক্ষিত লোকবল রয়েছেন যারা প্রতিদিন মাছ কাটাকুটির পেশায় নিয়োজিতদের কাছ থেকে পিজি সংগ্রহ করে তাকে পৌঁছে দেয়। পিজি প্রতি তিন টাকা পঁচাত্তর পয়সা (৩.৭৫) সংগ্রাহক রাখেন আর দুই টাকা পঁচাত্তর পয়সা (২.৭৫) মাছ কাটাকুটির পেশায় নিয়োজিতরা পেয়ে থাকেন। ২০১৬ সালে তিনি ৬.৫ কেজি পিজি (সংখ্যায় প্রায় ৩২ লাখ) দেশের অভ্যন্তরে বিক্রয়ের পাশাপাশি ৭৫০ গ্রাম বিদেশেও রপ্তানি করা হয়েছে। পৃথিবীর প্রায় ২২টি দেশে পরীক্ষামূলক ভাবে তিনি পিজি রপ্তানি করেছেন। ২০১৭ সালে এ পর্যন্ত তিনি প্রায় ৩.০০ কেজি (সংখ্যায় প্রায় ১৫ লাখ) বিক্রয় করেছেন। মৎস্য খাতে বহুমুখী অবদানের জন্য তিনি চলতি বছরে (২০১৭) জাতীয় পর্যায়ে রৌপ্য পদক জিতেছেন। বরিশাল-খুলনা-ফরিদপুরের মৎস্য ড্রেসারদের (মাছ কাটাকুটি পেশায় নিয়োজিত) জন্য ওয়ার্ল্ডফিশের ইউএসএআইডি-এআইএন প্রকল্পের উদ্যোগে চলতি আগস্ট মাসের শেষ সপ্তাতে যশোরে পিজি সংগ্রহের একটি প্রশিক্ষণ তিনি করাবেন। উল্লেখ্য যে, নব্বইয়ের দশকে ডানিডা ও ব্র্যাকের আমন্ত্রণে তিনি কুমিল্লাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে গিয়ে এধরনের প্রশিক্ষণ করিয়েছেন।
মাছ কাটাকুটি পেশার উন্নয়নে সমস্যাসমূহ:
- অপরিচ্ছন্ন স্থানে বসে মাছ কাটাকুটি করা
- ময়লা পানি, বালতি, মুগুর ইত্যাদি ব্যবহার
- কাটার উপকরণ ব্যবহারে অসতর্কতা
- হ্যান্ড গ্ল্যাবস ব্যবহার না করা
- উচ্ছিষ্ট অংশ উন্মুক্ত ডাস্টবিন বা পাশের খালে বা ড্রেনে ফেলে দেয়া
- অধিকাংশ ক্ষেত্রে বাজারে তাদের কাজের স্থানটি বাজার কর্তৃপক্ষ দ্বারা অনুমোদিত নয় বিধায় প্রায়শই উচ্ছেদ হওয়ার আশংকা থাকে। এছাড়া বিনে পয়সায় যেহেতু তাদের কাজের স্থানের সুযোগটি তারা নিচ্ছেন তাই তাদেরকে বাড়তি কোন সুযোগ-সুবিধা (পানি সরবরাহ, আলো সুবিধা, ছাউনি ইত্যাদি) দেয়া হয় না।
- তাদের কাজের অনুমোদিত (যথাযথ কর্তৃপক্ষ কর্তৃক) কোন মূল্য তালিকা নেই। তাই সব সময় আলোচনা সাপেক্ষেই ক্রেতার সাথে সেবা-মূল্য নির্ধারিত হয়।। ফলে অনেক সময় কম মূল্যে তাদের কাজ করতে হয়।
এই পেশার আধুনিকায়নে যা করা প্রয়োজন:
- বিষয়টি যেহেতু নাগরিক সেবার অংশ তাই তাদেরকে বৈধ কাঠামোর মধ্যে নিয়ে আসা প্রয়োজন। মৎস্য অধিদপ্তরের মাধ্যমে নগর-কর্তৃপক্ষের সাথে আলোচনার মাধ্যমে তাদের জন্য বাজারে একটি পরিচ্ছন্ন বসার স্থানের ব্যবস্থা করা সাথে পরিস্কার পানি সরবরাহের ব্যবস্থা করা জরুরী।
- মাছ কাটার সময়, কিভাবে মাথার খুলির ভেতর থেকে পিটুইটারি গ্লান্ড বা পিজি সংগ্রহ করা যায় এবং ছোট একটি বোতলে সংরক্ষণ করা যায় তার ব্যাপারে প্রশিক্ষণ দেয়া। অত:পর স্থানীয় হ্যাচারিদের সংগঠন বা কোন একজন ব্যবসায়ীর সাথে তাদেরকে সংযোগ করে দেয়া যেতে পারে পিজিগুলো সাপ্তাহিক ভাবে বিপণনের জন্য।
- পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা রক্ষায় তাদের সচেতনতা বৃদ্ধি করা জরুরী। এব্যাপারে নগর-কর্তৃপক্ষ ও মৎস্য অধিদপ্তরের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ দান (স্বল্পমেয়াদী) কর্মসূচি হাতে নেয়া যেতে পারে।
- পিজি ছাড়াও মাছ কাটার পর প্রাপ্ত আঁইশ সংগ্রহ ও বিক্রয়ের প্রাতিষ্ঠানিক চ্যানেল তৈরি করা যেতে পারে।
জনসাধারণের স্বাস্থ্যের কথা বিবেচনা করেই বাজারে মাছ কাটাকুটি করা লোকজনের কর্মকাণ্ডকে স্বাস্থ্যকর ও পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতার আওতায় আনা প্রয়োজন। স্বাস্থ্যকর পরিবেশ নিশ্চিত করা হলে আপামর জনগণ এর সুফল পাবে। পাশাপাশি তাদেরকে পিজি ব্যবসার আওতায় অন্তর্ভুক্ত করা গেলে এ খাতের সাথে সংশ্লিষ্ট সবাই উপকৃত হবে। এই উদ্যোগটির আশু বাস্তবায়নে মৎস্য অধিদপ্তর, নগর কর্তৃপক্ষ, মৎস্য হ্যাচারি সংগঠন, মৎস্য বিষয়ক দেশী-বিদেশী প্রতিষ্ঠানকে (যেমন- ওয়ার্ল্ডফিশ)একটি কার্যকর সমঝোতায় পৌঁছানো জরুরী।
Visited 2,723 times, 1 visits today | Have any fisheries relevant question?