বায়োফ্লক ট্যাঙ্ক
বায়োফ্লক ট্যাঙ্ক

পৃথিবীর জনসংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই বাড়তি জনসংখ্যার খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য খাদ্য উৎপাদনকারী খাতে (যেমন- মৎস্যচাষ) সম্প্রসারণ প্রয়োজন। উৎপাদনশীলতা, সঠিক গুণাগুণ, লাগসই প্রযুক্তির ব্যবহার, বায়োসিকিউরিটি নিশ্চিতকরণ এবং বাজারের চাহিদা মত মাছ সরবরাহ সহ সকল ক্ষেত্রে দক্ষতার সাথে প্রযুক্তির ব্যবহার সুনিশ্চিত করণের প্রয়োজনে মাছ চাষ প্রতিনিয়ত প্রতিযোগিতার সম্মুখ হচ্ছে। তাছাড়া, পরিবেশ এবং প্রাকৃতিক সম্পদের সংরক্ষণ নিশ্চিত করণের জন্য এই সেক্টরের সম্প্রসারণ টেকসই হতে হবে। টেকসই একোয়াকালচারের প্রাথমিক লক্ষ্য হোল প্রাকৃতিক সম্পদ যেমন পানি ও মাটি উল্লেখযোগ্য ভাবে কম ব্যবহারের মাধ্যমে অধিক পরিমাণে মাছ উৎপাদন, একোয়াকালচার পদ্ধতির উন্নতি সাধন, পরিবেশের উপর বিরূপ প্রভাব দূরীকরণ, মাছ চাষের খরচ হ্রাস এবং লাভের অনুপাত বৃদ্ধিকরণ। টেকসই একোয়াকালচারের লক্ষ্য সমূহ পূরণ করার বিভিন্ন পদ্ধতির মধ্যে বায়োফ্লক টেকনোলজি অন্যতম। বায়োফ্লক টেকনোলজি ব্যবহার করে অল্প জমিতে অধিক পরিমাণ মাছ উৎপাদন সম্ভব। যা বাংলাদেশ সরকারের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষ বলতে কি বুঝায়?
বায়োফ্লক প্রযুক্তি মাছ চাষের একটি টেকসই এবং পরিবেশগত ভাবে বন্ধুত্বপূর্ণ মাছ চাষ পদ্ধতি। বায়োফ্লক হল প্রোটিন সমৃদ্ধ জৈব পদার্থ এবং অণুজীব, যেমন- ডায়াটম, ব্যাকটেরিয়া, প্রোটোজোয়া, অ্যালজি, ফেকাল পিলেট, জীবদেহের ধ্বংসাবশেষ এবং অন্যান্য অমেরুদণ্ডী প্রাণী ইত্যাদির ম্যাক্রো-এগ্রিগেট। এটি এমন একটি একোয়াকালচার সিস্টেম যা কার্যকর ভাবে পুষ্টি উপাদানের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করে খুব কম পানি পরিবর্তন বা একবারও পানি পরিবর্তন না করে। এই প্রযুক্তি পানিতে বিদ্যমান কার্বন ও নাইট্রোজেন এর সাম্যাবস্থা নিশ্চিত করে পানির গুণাগুণ বৃদ্ধি ও ক্ষতিকর রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণু নিয়ন্ত্রণ করে। বায়োফ্লক প্রযুক্তির মূলনীতি হল ইহা হেটারোট্রপিক
ব্যাকটেরিয়ার বংশবৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করে, পানিতে উচ্চ কার্বন-নাইট্রোজেন অনুপাত নিশ্চিত করার মাধ্যমে যা ক্ষতিকর অ্যামোনিয়াকে অণুজীব আমিষে রূপান্তর করে। এটি একটি পরিবেশ বান্ধব বিকল্প প্রযুক্তি যা ক্রমাগতভাবে পানিতে বিদ্যমান পুষ্টি উপাদানগুলোকে পুন: আবর্তন এর মাধ্যমে পুনঃ ব্যবহার নিশ্চিত করে। ট্যাংকের পানি খুব কম পরিবর্তন উক্ত ট্যাংকে বিদ্যমান অণুজীবের বৃদ্ধির সহায়ক হয় বলে এটি একটি টেকসই প্রযুক্তিতে রূপান্তরিত হয়েছে।

এই প্রযুক্তিতে অণুজীব দুইটি প্রধান ভূমিকা পালন করে-

ক) অণুজীব পানিতে বিদ্যমান নাইট্রোজেন সমৃদ্ধ যৌগ গুলোকে ব্যবহার করে অণুজীব প্রোটিনে রূপান্তর করার মাধ্যমে পানির গুণাগুণ সঠিক মাত্রায় বজায় রাখে।
খ) এই প্রযুক্তি খাদ্য রূপান্তর হার এবং মাছ চাষে খাদ্য ব্যয় কমিয়ে চাষের সম্ভাব্যতা বৃদ্ধি করে।

বায়োফ্লক প্রযুক্তি ব্যবহার করে যে সকল প্রজাতির মাছ চাষ সম্ভব:
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ চাষ করা হয়। কিন্তু আমাদের দেশে এ প্রযুক্তির মাধ্যমে মাছ চাষ এখনও ব্যাপকভাবে শুরু হয়নি। তাই আমাদের দেশে সচরাচর চাষকৃত মাছ যেমন- তেলাপিয়া, রুই, শিং, মাগুর, পাবদা, গুলশা ও চিংড়ীসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ চাষ করা যেতে পারে। তবে, যারা নতুন করে এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে মাছ চাষ শুরু করতে চান তারা অবশ্যই প্রথমে তেলাপিয়া, শিং ও মাগুর মাছ দিয়ে চাষ শুরু সমীচীন হবে।

বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষের সুবিধা:

  • উচ্চ বায়োসিকিউরিটি: এই প্রযুক্তিতে যেহেতু উপকারী ব্যাকটেরিয়া (প্রোবায়োটিক ব্যাকটেরিয়া) ব্যবহার করা হয় যা পানির গুণাগুণ বৃদ্ধি ও রোগ সৃষ্টিকারী ক্ষতিকর জীবাণু নিয়ন্ত্রণ করার মাধ্যমে পুরো সিস্টেমকে উচ্চ বায়োসিকিউরিটি প্রদান করে।
  • অ্যামোনিয়া দূরীকরণ: সিস্টেমে বিদ্যমান উপকারী ব্যাকটেরিয়া মাছ চাষের প্রধান নিয়ামক অ্যামোনিয়াকে মাছের দৈহিক বৃদ্ধির জন্য অত্যাবশ্যকীয় উপাদান প্রোটিনে রূপান্তর করার মাধ্যমে সিস্টেমে ক্ষতিকর অ্যামোনিয়ার পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করে।
  • মাছের বৃদ্ধি নিশ্চিতকরণ: ট্যাংকের পানির গুণাগুণ নিয়ন্ত্রণ, ক্ষতিকর রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণু নিয়ন্ত্রণ, মাছের মলও উচ্ছিষ্ট খাদ্যকে মাছের জন্য প্রয়োজনীয় প্রোটিনে রূপান্তরের মাধ্যমে মাছের বৃদ্ধি সুনিশ্চিত করে।
  • উত্তম প্রোটিনের উৎস: উপকারী ব্যাকটেরিয়া (প্রোবায়োটিক ব্যাকটেরিয়া) এই সিস্টেমে বিদ্যমান ক্ষতিকর অ্যামোনিয়া ও বাইরে থেকে সরবরাহকৃত কার্বনকে ব্যবহার করে অণুজীব আমিষ তৈরি করে। তাছাড়া ডায়াটম, প্রোটোজোয়া, অ্যালজি, ফেকাল পিলেট, জীবদেহের ধ্বংসাবশেষ ইত্যাদির ব্যাকটেরিয়া ম্যাক্রো-এগ্রিগেট তৈরি করে যা মাছের উত্তম প্রোটিনের উৎস হিসেবে কাজ করে।
  • খাদ্য রূপান্তর হার (এফসিআর) হ্রাস করণ: মাছ চাষের ক্ষেত্রে খাদ্য রূপান্তরের হারের মান যত কম হবে মাছ চাষে মুনাফা তত বেশি হবে। এক্ষেত্রে বায়োফ্লক প্রযুক্তির সিস্টেমের উপকারী ব্যাকটেরিয়া মাছের অব্যবহৃত খাদ্য,মল-মূত্র থেকে নিঃসৃত অ্যামোনিয়াকে ব্যবহার করে অণুজীব প্রোটিন তৈরি করার ফলে বাহির থেকে প্রোটিন সমৃদ্ধ মাছের খাদ্য কম সরবরাহ করলেও হয়, তাই এ সিস্টেমের খাদ্য রূপান্তর হার (এফসিআর) অন্যান্য সিস্টেম থেকে কম হয়।
  • স্বল্প খরচ ও অধিক লাভ: আমরা জানি মাছ চাষের শতকরা ৬০ ভাগ খরচই খাবারের জন্য ব্যয় হয়। এই পদ্ধতিতে সিস্টেমের উপকারী ব্যাকটেরিয়া ট্যাংকেই অণুজীব প্রোটিন তৈরি করে তাই অন্যান্য সিস্টেমের চেয়েও খাদ্য কম লাগে ফলে চাষের খরচ কমে যায় এবং অধিক মুনাফা অর্জন সম্ভব হয়।
  • সহজ চাষ পদ্ধতি: এটি একটি সহজ চাষ পদ্ধতি। বাড়িতে যে কোন চাষি সঠিক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কারিগরি দক্ষতা অর্জন পূর্বক ৩০-৪০ টি ট্যাংকে সহজেই মাছ চাষ করতে পারবে।
  • খুব কম পানি পরিবর্তন: মাছ চাষের অন্যতম নিয়ামক অ্যামোনিয়া নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে উপকারী ব্যাকটেরিয়া পানির গুণাগুণ রক্ষা করে ফলে ট্যাংকের পানি খুব কম পরিবর্তন করলেই চলে।
  • জমি এবং পানির সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিতকরণ: এই সিস্টেমে ছোট ছোট ট্যাংকে অনেক মাছ উৎপাদন হয় এবং ট্যাংকের পানি ও খুব কম পরিবর্তন করতে হয় তাই অল্প জমি ও অল্প পানি ব্যবহার করে অধিক মাছ উৎপাদন সম্ভব হয়। যা জমি ও পানির সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করে।
  • পরিবেশবান্ধব একোয়াকালচার সিস্টেম: প্রকৃতিতে বিদ্যমান উপকারী ব্যাকটেরিয়া ব্যবহারের মাধ্যমে মাছ চাষ করা হচ্ছে। ফলে এই পদ্ধতিতে মাছ চাষে ব্যবহৃত বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থ ও অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োজন নেই বললেই চলে। তাই এটি একটি পরিবেশবান্ধব মাছ চাষ পদ্ধতি।
  • রোগের প্রাদুর্ভাব দূরীকরণ: বায়োফ্লক সিস্টেমের উপকারী ব্যাকটেরিয়া মাছের জন্য ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া সমূহের বৃদ্ধিকে বাধা প্রদান করে ফলে ঐসব ব্যাকটেরিয়া জনিত রোগ থেকে মাছ রক্ষা পাবে। যার ফলে মাছ চাষের সময় খামারকে রোগের প্রাদুর্ভাব থেকে রক্ষা করা সম্ভবপর হয়।
Imhoff cone is used to measure biofloc
Imhoff cone is used to measure biofloc

.

বায়োফ্লক প্রযুক্তি ব্যবহার করে মাছ চাষের ক্ষেত্রে যে সকল বিষয় লক্ষ্য রাখতে হবে:

  • উপকারী ব্যাকটেরিয়ার উৎস: বায়োফ্লকপদ্ধতির গুরুত্বপূর্ণ উপাদান উপকারী ব্যাকটেরিয়া যা মাছচাষের ফলে উৎপাদিত বর্জ্য কে প্রোটিন সমৃদ্ধ জৈব খাবারে তৈরি করে। তাই সঠিক উৎস হতে প্রোবায়োটিক ব্যাকটেরিয়া সংগ্রহ করতে হবে।
  • নিয়মিত পানির গুণাগুণ পরীক্ষা: নিয়মিত ট্যাংকে সরবরাহকৃত পানির গুণাগুণ যেমন- অ্যামোনিয়া, নাইট্রেট, নাইট্রাইট, ফ্লকের ঘনত্ব ইত্যাদি পরিমাপ করতে হবে এবং এগুলো যদি সঠিক মাত্রায় না থাকে তাহলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
  • তাপমাত্রার হ্রাস বৃদ্ধি: আমাদের দেশে দিনের বেলার তাপমাত্রা ও রাত্রের তাপমাত্রা সব সময় উঠানামা করে, যা ফ্লকের বৃদ্ধির জন্য উপযোগী নয়। তাই পর্যাপ্ত ফ্লকের বৃদ্ধির জন্য তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
  • কারিগরি জ্ঞান সমৃদ্ধ জনবল: বয়োফ্লকের মাধ্যমে মাছ চাষের ক্ষেত্রে অবশ্যই প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত দক্ষ জনবলের প্রয়োজন। কারণ এই প্রযুক্তিতে যদি পানির গুণাগুণ পরীক্ষা, সঠিক মাত্রায় খাদ্য প্রয়োগ, ফ্লকের ঘনত্ব পরিমাপ ইত্যাদি বিষয়ে কারিগরি জ্ঞান না থাকে তাহলে চাষি যে কোন সময় ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
  • সার্বক্ষণিক বিদ্যুৎ সরবরাহ: বায়োফ্লক পদ্ধতিতে ট্যাংকে অধিক পরিমাণে মাছ রাখা হয়। তাই ট্যাংকে অক্সিজেন সরবরাহ করতে হয়। আর ট্যাংকে সব সময় অক্সিজেন সরবরাহ করার জন্য সার্বক্ষণিক বিদ্যুৎ লাগবে। তা না হলে ট্যাংকের অক্সিজেন সরবরাহ বন্ধ হয়ে সব মাছ এক সাথে মারা যেতে পারে। সর্বোচ্চ এক ঘণ্টা ট্যাংকে অক্সিজেন সরবরাহ না করা হলে সব মাছ মারা যেতে পারে।

সবশেষে, পরিবেশবান্ধব ও টেকসই এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে অল্প জায়গায় অধিক পরিমাণে মাছ উৎপাদন সম্ভব। এই প্রযুক্তি যদি মাঠ পর্যায়ে সম্প্রসারণের মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া যায় তাহলে আমাদের দেশের মাছের উৎপাদন অধিক পরিমাণে বৃদ্ধি করা সম্ভব। যা সরকারের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনে সচেষ্ট ভূমিকা পালন করবে। এ পদ্ধতিতে মাছ চাষের যে কোন পরামর্শের জন্য শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের একোয়াকালচার বিভাগে যোগাযোগ করা যেতে পারে।

Biofloc lab at SAU, Dhaka
Biofloc lab at SAU, Dhaka

.

তথ্যসূত্র:

  • Avnimetech Y (2014) Biofloc Technology- A Practical Guide Book, World Aquaculture Society.
  • Maurício Gustavo Coelho Emerenciano, Luis Rafael Martínez- Córdova, Marcel Martínez-Porchas and Anselmo Miranda-Baeza (2017) Biofloc Technology (BFT): A Tool for Water Quality Management in Aquaculture, Water Quality, Hlanganani Tutu.
  • Roselien Crab, Tom Defoirdt, Peter Bossier, Wily Verstraete (2012) Biofloc technology in aquaculture: Beneficial effects and future challenges. Aquaculture, 357-357:351-357.

Visited 29,241 times, 2 visits today | Have any fisheries relevant question?
বায়োফ্লক পদ্ধতি মাছ চাষের নতুন দিগন্ত

Visitors' Opinion

ড. এ. এম. সাহাবউদ্দিন এবং শাহরিয়ার হিমেল

একোয়াকালচার বিভাগ, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা-১২০৭

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.