আমি যেখানে বসে এই লেখাটি লিখছি সেখানে গত বছরের মত এবছরও কম বৃষ্টিপাত হয়েছে। গত বছর তার পূর্বের বছরের চেয়ে কম বৃষ্টি হলেও বাসা থেকে আমার কর্মস্থলে যাবার পথের উভয়পাশের জলাশয়গুলোতে বর্ষার শেষে কিছু পানি জমেছিল। মৎস্যচাষিরা দেরিতে হলেও জলাশয়ের সেই অল্প পানিতেই মাছ ছেড়েছিল এবং সামান্য হলেও মাছ উৎপাদন করতে পেরেছিল। স্থানীয় চাষিরা মোটা অংকের টাকা দিয়ে এই সব জলাশয় বছরভিত্তিক লীজ নিয়ে দীর্ঘ্যদিন থেকে মাছের চাষ করে আসছে। কিন্তু অনাবৃষ্টির কারণে এবছর জলাশয়গুলোতে পানি জমার কোন সুযোগই পায়নি, মাছচাষ তো অনেক দূরের কথা। এই জলাশয় গুলোতে বছরের ৯-১০ মাসই পানি থাকতো কিন্তু এবছর পানিই জমা হল না। আর যেসব জলাশয়ে আগে সারা বছরই পানি থাকতো সেখানেও পানির গভীরতা অন্যান্য বছরের চেয়ে কম। ফলে মাছচাষীরা মাছের উৎপাদন কমে যাবে এমনটিই আশংকা করছেন।
গত ২-৩ মাসে স্থানীয় ও জাতীয় পত্রিকাগুলোতেও দেশের বিভিন্ন স্থানে অনাবৃষ্ট, খরা আর তাপমাত্রাবৃদ্ধি বিষয়ক বেশকিছু প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। সেসব তথ্যানুসারে প্রায় সারা দেশেই এবার অনাবৃষ্টি, খরা এবং স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি গরম অনুভূত হয়েছে যা মাছ চাষের উপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে বাধ্য। যেমন-
২ অক্টোবর ২০১০ তারিখে রাশেদ রিপনের দৈনিক সোনালী সংবাদে প্রকাশিত “দুই বছরের গড় বৃষ্টিপাতের চেয়ে এবার কম বৃষ্টি” শিরোনামের প্রতিবেদনে দেখা যায়- এই অঞ্চলে বছরে গড়ে ১৫০০ মিলিলিটার বৃষ্টিপাত হয়। এ বছর গত মাস পর্যন্ত বৃষ্টিপাত প্রায় ১১০০ মি: লি:। গত বছর বৃষ্টিপাত হয়েছে মাত্র ৯৭০ মি:লি:। বরেন্দ্র এলাকার কৃষি যেহেতু ভূগর্ভস্থ পানির উপর নির্ভরশীল সে কারণে ভূগর্ভে পানি রিচার্জ না হলে কৃষির জন্য তা বড় বিপর্যয় বয়ে আনবে। এ এলাকায় গতমাসে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ছিল ২২.৭৫ মিটার নিচে। অথচ ১৯৯৫ সালেই পানির স্তর ছিল ১১.৯৫ মিটার নিচে।
৫ সেপ্টেম্বর ২০১০ তারিখে দৈনিক সোরালী সংবাদে কাজী নাজমুল ইসলামের প্রকাশিত “রাজশাহীতে অপর্যাপ্ত বৃষ্টি: পানিশূন্য জলাশয় মাছ উৎপাদনে ঘাটতির আশংকা/পুকুরগুলো সেচ সুবিধার আওতায় আনার দাবি?” শিরোনামের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়- রাজশাহীর প্রায় ৪৪ হাজার হেক্টর জলাশয়ের অর্ধেকই রয়েছে পানিশূন্য। ফলে অন্যান্য বছর চাহিদার চেয়ে বেশি মাছ উৎপাদন হলেও এবার এখানে ঘাটতি দেখা দেবে। এবার প্রয়োজনীয় বৃষ্টি না হবার কারণে পুকুর গুলো শুকিয়ে গেছে। পানির লেয়ার নীচে নেমে যাওয়ায় সেচ দিয়েও পুকুরে পানি রাখা যাচ্ছেনা। মৌগাছি এলাকায় হ্যাচারি থেকে রেণুপোনা তৈরি করলেও পুকুরে পানি না থাকায় তা বিক্রি হয়নি। মৎস্যচাষীদের ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে সরকারি উদ্যোগে জরুরি ভিত্তিতে পুকুরগুলোকে সেচের আওতায় আনার দাবিও উঠেছে। ২০০৯ সালের জুন, জুলাই ও আগস্ট এই ৩ মাসে রাজশাহীতে বৃষ্টি হয়েছিল ৫৫৪ দশমিক ৪ মিলিমিটার। এর মধ্যে জুন মাসে ১২৭.৬ মিলিমিটার, জুলাই মাসে ১৮৬.৭ মিলিমটার এবং আগস্ট মাসে ২৪০.১ মিলিমিটার। ২০১০ সালের জুন, জুলাই ও আগস্ট ৩ মাসে রাজশাহীতে বৃষ্টি হয়েছে ৪১৮ দশমিক ৯ মিলিমিটার। এর মধ্যে জুন মাসে ২২১ মিলিমিটার, জুলাই মাসে ৯৪.৫ মিলিমিটার এবং আগস্ট মাসে ১০৩.৪ মিলিমিটার। ২০০৯ সালে রাজশাহীতে মাছ উৎপাদনের লক্ষ মাত্রা ধরা হয়েছিল ৪৯,৯৩৭.৯৬ মেট্রিকটন। ওই বছর লক্ষমাত্রার চেয়ে আড়াই পারসেন্ট কম উৎপাদন হয়েছে। কিন্তু চাহিদার চেয়ে তা সাড়ে ৮ হাজার মেট্রিক টন বেশী। ২০১০ সালে এসে জলাশয় গুলোতে পানি না থাকায় মাছের উৎপাদনে বিপর্যয় নেমে এসেছে। এবার এখানে মাছের চাহিদা পূরণ না হয়ে বিপুল পরিমাণে ঘাটতি থেকে যাবে। এ পরিস্থিতিতে জলাশয় গুলোকে মাছচাষের আওতায় নিতে হলে জরুরি ভাবে সেচের ব্যবস্থা করতে হব। তা না হলে মাছের উৎপাদন মারাত্মক ভাবে ব্যাহত হবে।
৮ অক্টোবর ২০১০ তারিখের আমারদেশ অনলাইন সংস্করণে “অনাবৃষ্টির কারণে ভরা মৌসুমেও মাছ চাষ করতে পারছে না নড়াইলের চাষীরা” শিরোনামের প্রতিবেদন থেকে জানা যায় অনাবৃষ্টি ও কীটনাশকের ব্যবহারের কারণে মাছের উত্পাদন নিয়ে শঙ্কিত দেশের অন্যতম চিংড়ি ও মিঠাপানির মাছ উত্পাদনের এলাকা নড়াইলের চাষীরা। বৈশাখ থেকে আশ্বিন মৌসুমে বৃষ্টি না হওয়ায় মত্স্য চাষীদের ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। নড়াইল জেলায় ২০০৮-এ চিংড়ির উৎদন হয়েছিল ৯৫১ মেট্রিক টন, যা ২০০৯-এ এসে দাঁড়িয়েছে ৮৮০ মেট্রিক টন। অন্যদিকে রুই জাতীয় মাছের উৎদন ২০০৮-এ ছিল ৩,১৮৩ মেট্রিক টন, যা ২০০৯-এ এসে দাঁড়িয়েছে ২,৭০৮ মেট্রিক টনে। মাছের মোট উত্পাদনের হার এবার আরও কমে যাবে। অনাবৃষ্টির কারণে ৮০ ভাগ চাষীই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
গত ২২ এপ্রিল ২০১০ তারিখের “সাপ্তাহিক ২০০০” পত্রিকায় মামুন রহমান এর “অনাবৃষ্টি ও খরায় মাছ চাষে বিপর্যয়” শিরোনামের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে অনাবৃষ্টি ও খরার কারণে যশোর অঞ্চলে মাছ চাষে বিপর্যয় নেমে এসেছে। পানির অভাবে এখন তাদের প্রতিদিন অন্তত ৬০ লাখ টাকার ক্ষতি হচ্ছে। দ্রুত যদি বৃষ্টি না হয় তাহলে মাছের রেণু পোনা উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাবে। সারাদেশে মাছের যে পরিমাণ রেণু পোনা উৎপাদন হয়, তার অন্তত ৭০ ভাগ হয় যশোরে। অনাবৃষ্টি আর খরার কারণে ইতিমধ্যে যশোরের ৭৮টির মধ্যে ৩৬টিই বন্ধ হয়ে গেছে। গত পাঁচ মাস ধরে বৃষ্টি না হওয়ায় এ অঞ্চলের পুকুরগুলো শুকিয়ে গেছে। ফলে যেসব হ্যাচারিতে এখনও রেণু উৎপাদন হচ্ছে তা তারা বিক্রি করতে পারছেন না। রেণু বিক্রির পরিমাণ অন্তত ৮০ ভাগ কমে গেছে। গত পাঁচ মাসে যশোরে বৃষ্টি হয়েছে ১১ মিলিমিটার। যশোর অঞ্চলে পানির স্তর থাকে ৮ থেকে ১৫ ফুটের মধ্যে। কিন্তু অনাবৃষ্টির কারণে যশোরে পানির স্তর নেমে গেছে ৩৫ ফুট নিচে। পানির স্তর ২৬ ফুটে নামলেই টিউবওয়েলে পানি ওঠা বন্ধ হয়ে যায়। এজন্য যশোরের ৮০ ভাগ টিউবওয়েলে পানি ওঠা বন্ধ হয়ে গেছে। আবার গরমের কারণে মাছ ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছে।
গত ১০ অক্টোবর ২০১০ তারিখের প্রথম আলো তে প্রকাশিত “মনিরামপুরে মৎস্য চাষ ব্যাহত” শিরোনামের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়- যশোরের মনিরামপুরে অনাবৃষ্টির কারণে জলাশয়ে পর্যাপ্ত পানি না থাকায় এবার মৎস্য চাষ ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। মনিরামপুরে মাছের চাষযোগ্য জলাশয়ের মধ্যে পুকুরের সংখ্যা ১০,৬৪৩টি, ঘের ৪,৬৪২টি, ধানখেত ৯০০টি, বাওড় পাঁচটি, নদী তিনটি ও বিল ১৩টি। এসব জলাশয়ে মাছের বার্ষিক গড় উৎপাদন প্রায় ১২ হাজার মেট্রিক টন। অনাবৃষ্টির কারণে পর্যাপ্ত পানি না থাকায় এবার অধিকাংশ জলাশয়ে মাছ চাষ করা সম্ভব হয়নি। গত পাঁচ বছরে চাষযোগ্য মৎস্য খামারগুলোয় পানির গড় গভীরতা ছিল পাঁচ থেকে ছয় ফুট। অথচ বর্ষা মৌসুম শেষ হলেও এবার জলাশয়গুলোয় এক থেকে দুই ফুটের বেশি পানি না থাকায় অধিকাংশ জলাশয়ে মাছ চাষ করা সম্ভব হয়নি। আবার অব্যাহত লোডশেডিংয়ের কারণে বিদ্যুৎচালিত সেচপাম্প বন্ধ থাকায় সময়মতো জলাশয়ে পানি সেচ দেওয়াও সম্ভব হয়নি। ভবদহ অঞ্চলের পাঁচটি বিলে পানি না থাকায় এবার দেশি প্রজাতির মাছের উৎপাদন নেই বললেই চলে। পানির অভাবে এবার ঘের-বেড়িতে উল্লেখযোগ্য কোনো মাছ চাষ করতে পারেননি। অনাবৃষ্টির কারণে এবার মাছের বার্ষিক গড় উৎপাদন অর্ধেকেরও নিচে নেমে যাবে। জলাশয়গুলো চাষযোগ্য এবং উৎপাদন বাড়াতে হলে সংশ্লিষ্ট সবাইকে নতুন করে ভাবতে হবে। অন্যথায় জাতীয় পুষ্টির চাহিদা ও খাদ্যনিরাপত্তা হুমকির সম্মুখীন হবে।
৬ আগষ্টে ২০১০ তারিখের সোনারদেশ ডট কমে প্রকাশিত “খরায় পুড়ছে দেশ” শিরোনামের প্রতিবেদর থেকে জানা যায় মাছের বাজারেও আগুন লেগেছে বৃষ্টিহীনতায়। হুমকির মুখে পড়েছে সাদা সোনা হিসেবে খ্যাত চিংড়ি চাষও। খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, গোপালগঞ্জ, যশোর ও নড়াইলে গলদা চিংড়ি এবং সাদা মাছ চাষের জন্য পানির তীব্র সঙ্কট দেখা দিয়েছে। এসব জেলায় ৮৫০ কোটি চিংড়ির পোনা ঘেরে অবমুক্ত করা হলেও পর্যাপ্ত পানি না পাওয়ায় চিংড়িচাষীরা হতাশ। সাদা মাছেরও কোটি কোটি পোনা ছাড়া হলেও অবস্থা একই। গত দুই মাসে রংপুর অঞ্চলে প্রায় সাড়ে ৩০০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে, যা প্রয়োজনের তুলনায় এক-চতুর্থাংশ।
১৩ ডিসেম্বর ২০০৯ তারিখের প্রথম আলোতে প্রকাশিত আনোয়ারা বেগম এর “ঝুঁকিতে মৎস্যসম্পদ” শিরোনামের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়- জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বৃষ্টিপাতের চিরাচরিত ধারায় ব্যাপক পরিবর্তন দিন দিন সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে, যা মাছ চাষ, মাছের প্রজনন ও বিচরণকে প্রভাবিত করে। এ ছাড়া তাপমাত্রা বৃদ্ধি, অনাবৃষ্টি, অপর্যাপ্ত বৃষ্টির ফলে দেশের বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে খরা দেখা দেয়, যা মাছের জন্য প্রতিকূলতা সৃষ্টি করে। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের লবণাক্ততা বৃদ্ধি, সমুদ্রপৃষ্ঠের আয়তন বেড়ে যাওয়া মাছের জন্য অনেক প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। কয়েক বছর ধরে বৃষ্টিপাতের ক্ষেত্রে যে অনিয়মগুলো দেখা যাচ্ছে, মাছের কাঙ্ক্ষিত উৎদন পাওয়ার ক্ষেত্রে সেগুলো মোটেও ইতিবাচক নয়। যেমন, যে সময় বৃষ্টি হওয়ার কথা, তখন হচ্ছে না; যে সময় যে পরিমাণ হওয়ার কথা, সে সময় ওই পরিমাণ হচ্ছে না; যে সময় যে এলাকায় যে পরিমাণ হওয়ার কথা, সে অনুযায়ী হচ্ছে না। এ বছর মে-জুন মাসেও বৃষ্টি না হওয়ার ফলে মাছের প্রজনন ব্যাহত হয়েছে, পোনার কাঙ্ক্ষিত উত্পাদন সম্ভব হয়নি। প্রজননের অনুকূল পরিবেশ না পাওয়া এবং তাপমাত্রা বেশি থাকার কারণে কৃত্রিম প্রজননে মাছ সাড়া দিচ্ছে না, ডিম শরীরে মিশে যাচ্ছে। তাপমাত্রা ২৯-৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত গেলে প্রজননক্ষম মাছ অল্পতেই ক্লান্ত হয়ে পড়ে। কারণ, তাপমাত্রা বেশি হলে পানিতে অক্সিজেন কম থাকে। এ পরিস্থিতিতে ডিমের খোসা পাতলা হয়ে যায়, যার প্রভাব পড়ছে সমগ্র পোনা উৎপাদনে। চলতি বছরে খাল-বিল-প্লাবনভূমিতেও জুলাই মাস পর্যন্ত পানি না হওয়ার কারণে দেশীয় মাছের প্রজনন চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এপ্রিল-মে মাস দেশীয় জাতের ছোট মাছের প্রজননকাল। যদিও এসব মাছ কয়েকবার ডিম ছাড়ে কিন্তু এরই মধ্যে এদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ প্রজনন-সময়টা পার হয়ে গেল, যার প্রভাব পড়বে সামগ্রিক উৎদনের ক্ষেত্রে। অন্যদিকে উত্তরাঞ্চলে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে, খরার সময় দীর্ঘতর হচ্ছে, পুকুর-ডোবা দ্রুত শুকিয়ে যাচ্ছে। যে পরিমাণ বৃষ্টিপাত হচ্ছে, তাতে মাছ চাষের প্রয়োজন অনুযায়ী জলাশয়ে পর্যাপ্ত পানি থাকছে না, পোনা মজুদের দুই-তিন মাস পর মাছ বাজারে তোলার উপযুক্ত হওয়ার আগেই পানি শুকিয়ে যাচ্ছে। ছোট মাছ আহরণ করে চাষিকে গুনতে হচ্ছে ক্ষতির পরিমাণ। গত বছর দেশের গড় বৃষ্টিপাত ছিল ২৩০০ মিলিমিটার আর বরেন্দ্র এলাকার গড় ছিল ১১৫০ মিলিমিটার, যা মাছ চাষ, কৃষিসহ জীবন ও জীবিকার বিভিন্ন উৎদনমুখী সম্ভাবনাকে ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
প্রথম আলোর ব্লগার মোজাম্মেল কবিরের ২৩ অক্টোবর ২০১০ তারিখে “পরিবর্তিত জলবায়ুর সাথে লড়তে হবে নিজেদেরকেই (পর্ব-২)” শিরোনামের পোষ্টে মৎস্য খাতে প্রভাব হিবেবে উল্লেখ করেছেন-
প্রাকৃতিক জলাশয়ে প্রতিক্রিয়া: এক সময় দেশের হাওর বিল, নদী নালায় প্রচুর দেশী প্রজাতির মাছ পাওয়া যেতো যেমন কাজলি, ভেদা, খলিশা, পাবদা, গুলশা, মলা, ঢেলা ইত্যাদি, যা আজ প্রায় বিলুপ্তির পথে। এর বেশ কটি কারণের মধ্যে প্রধান যে কারণ তা হলো প্রাকৃতিক ভাবে ঠিক যখন এসব মাছ প্রজননের জন্য তৈরী হয় ঠিক তখন বৃষ্টি হওয়া প্রয়োজন, কিন্তু বেশ কয়েক বছর ধরে বর্ষা কালের শুরুর দিকে বৃষ্টি হয়না। ফলে এসব মাছ প্রজননের উপযুক্ত পরিবেশ পায়না মাছের বংশবৃদ্ধিও ঘটেনা। যা বৈরী জলবায়ুর প্রভাব।
চাষের খামারে প্রতিক্রিয়া: বিগত কয়েক বছর দেশে মাছ চাষ যথেষ্ট সমৃদ্ধি লাভ করেছে তথাপিও দেশে বার্ষিক প্রায় ৮ ল মে: টন মাছের ঘাটতি রয়ে গেছে। এমন অবস্থায় কৃষির এই উপখাতটি বৈরী জলবায়ু জনিত একটি ধকলের মধ্যে পরেছে। ২০০৯ সালে অধিক তাপমাত্রা মনে করিয়ে দেয় আসন্ন বিপর্যয়কে। আমাদের দেশে প্রতিবছর মাছের উৎপাদন মৌসুমে গড় তাপমাত্রা ৩২- ৩৩ ডি: সে: এর মধ্যে ছিলো। কিন্তু ২০০৯ সালে এই তাপমাত্রা ৪০-৪২ ডি: সে: অতিক্রম করেছে। এর ফলে মাছের খাদ্য গ্রহন প্রবনতা কমে যায়। খাদ্য গ্রহন করলেও হজম প্রক্রিয়া ব্যাহত হয় FCR (Food Conversion Rate) খাদ্য রুপান্তর হার বেড়ে যায় DGR (Daily Growth Rate) দৈনিক বৃদ্ধি হার কমে যায় । চাষের সময় হয় দীর্ঘায়িত এতে যে সব মাছ বছরে ২ টি চাষ করা সম্ভব হতো সেখানে একটি চাষ করে বাকী সময় মাছ চাষীদের তেমন কাজে লাগেনি। উৎপাদন কমে যাওয়ার কারণে উৎপাদন খরচ বেড়ে যায়। ভূগর্ভস্ত পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় শুকনো মৌসুমে চাষের পুকুরে সেচ দিতে বিদ্যুৎ ও জ্বালানী খরচ অনেক বেশী হয়। বৈরী জলবায়ুর প্রভাবে আগামী দিনগুলো মাছচাষে সুখকর হবেনা বলে ইঙ্গিত দিচ্ছে।
মৎস্য হ্যচারী ও নার্সারীতে প্রতিক্রিয়া: হ্যাচারী থেকে রেণু পোনা নিয়ে মে-জুলাই মাসে যারা পুকুরে নার্সিং করেছেন তাদের অনেকেরই অধিক তাপমাত্রা জনিত কারণে নার্সারী পুকুরে পোনার মৃত্যুহার তুলনামূলক ভাবে বেশী ছিলো। মনোসেক্স তেলাপিয়া হ্যাচারীগুলোতে উপযুক্ত তাপমাত্রার অভাবে মাছের ডিমের সংকটে ভুগেছে । তেলাপিয়া হ্যাচারীতে পানির একটি নির্দিষ্ট তাপমাত্রা (২৮ ডি. সে. এর সামান্য কাছাকাছি থাকলে উৎপাদন ভালো হয় কিন্তু চলতি বছর হ্যাচারীতে পানির তাপমাত্রা কিছুতেই ৩৫-৩৬ ডি: সে: এর নিচে রাখা সম্ভব হয়নি যা পোনা উৎপাদনের অনুকুলে নয়। ফলে সারা দেশে ২০০৯ সালে পূর্বের বছরের তুলনায় পোনার উৎপাদন অর্ধেকেরও কম হয়।
উপরোক্ত তথ্য থেকে প্রতিয়মান হয় যে অনাবৃষ্টি, খরা এবং তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে মাছ চাষ ও এর সাথে সংশ্লিষ্ট সকল খাতই বর্তমানে ক্ষতির মুখে। কৃত্রিমভাবে সেচ দিয়ে বিপুল পরিমাণ জলাশয়কে চাষের আওতায় আনা অত্যন্ত ব্যয় বহুল একটি পদ্ধতি যা সাময়িকভাবে সমস্যার সমাধান করলেও সেটি কোন দীর্ঘ্যমেয়াদী সমাধান নয় তা নিশ্চিত করেই বলা যায়। অন্যদিকে বিদ্যুতের নিশ্চয়তা না থাকায় তা বাস্তবায়ন করাও একটি অনিশ্চিত বিষয়। এমত অবস্থায় স্বল্প মেয়াদী মাছচাষ প্রযুক্তির উদ্ভাবন ও উন্নয়ন করা একান্ত প্রয়োজন। প্রয়োজন স্বল্প পানিতে এবং বেশী তাপমাত্রায় টিকে থাকতে সক্ষম এমন প্রজাতিকে চাষেও আওতায় নিয়ে আসা। চাষকৃত প্রজাতির নতুন নতুন ভ্যারাইটি উদ্ভাবন যেগুলো অল্প গভীরতায় ও অধিক তাপমাত্রায় টিকে থাকতে সক্ষম। খুঁজে বের করা প্রয়োজন অনাবৃষ্টি, খরা ও তাপমাত্রা বৃদ্ধির মতো প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের প্রকৃত কারণ এবং সেমত ব্যবস্থা গ্রহণ। নইলে চাষকৃত মাছকে টিকিয়ে রাখা সম্ভব হলেও দেশীয় প্রজাতির বিপুল পরিমাণ মাছ চিরদিনের জন্য হারাতে হবে আমাদের।
Visited 1,071 times, 1 visits today | Have any fisheries relevant question?