ইলিশ কেবলমাত্র আমাদের জাতীয় মাছই নয় জাতীয় সম্পদও বটে। বাংলাদেশে মোট উৎপাদিত মাছের প্রায় ১২ শতাংশ আসে শুধু ইলিশ থেকে এবং জিডিপিতে এর অবদান শতকরা ১ ভাগ। বর্তমানে ইলিশের উৎপাদন প্রায় ৩.০ লক্ষ মে.টন, যার বাজারমূল্য প্রায় ৭,৫০০ কোটি টাকা। উৎপাদিত ইলিশের সামান্যই বিদেশে রফতানি করে প্রায় ১৫০ কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হয়। প্রায় ৫.০ লক্ষ লোক ইলিশ আহরণে সরাসরি নিয়োজিত এবং ২০-২৫ লক্ষ লোক পরিবহন, বিক্রয়, জাল ও নৌকা তৈরি, বরফ উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ, রফতানি ইত্যাদি কাজে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত [১]। তাই আমাদের অর্থনৈতিক উন্নতির সাথে এ মাছ রক্ষার একটা বড় ভূমিকা রয়েছে। ইলিশ মাছের উৎপাদন কমে যাবার যতগুলো কারণ রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে নির্বিচারে জাটকা নিধন। সাধারণভাবে নয় ইঞ্চি (২৩ সে.মি.) বা এর চেয়ে ছোট আকারের অপরিণত ইলিশ জাটকা নামে পরিচিত।

প্রাপ্তবয়স্ক ইলিশ সমূদ্র ছেড়ে স্বাদুপানির নদীতে আসে প্রজননে অংশ নেয়ার জন্য। ইলিশ প্রাকৃতিক পরিবেশে এক বছরের মধ্যেই পরিপক্বতা লাভ করে এবং বয়স ও আকারভেদে একটি মা-ইলিশ এক প্রজনন ঋতুতে ৫-২০ লাখ সংখ্যক ডিম ছেড়ে থাকে [২]। এরা সেপ্টেম্বর-অক্টোবর এবং জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসের পূর্ণিমা ও এর পূর্বা পরের কয়েক রাত ধরে সবচেয়ে বেশি প্রজননে অংশ নেয়। ডিম থেকে বাচ্চা পরিস্ফুটিত হবার পর থেকে মোহনা ও উপকূলীয় অঞ্চলে এবং বয়োপ্রাপ্ত হলে বাংলাদেশের বিভিন্ন নদ-নদীতে পরিভ্রমণ করে থাকে। পরবর্তীতে ক্রমশ বড় হতে থাকে আর সমুদ্রের দিকে অগ্রসর হতে থাকে এবং পরিনত ইলিশ সমুদ্রে বসবাস করে।

বাংলাদেশের প্রায় সব বড় বড় নদী এবং এর মোহনা ও উপকূলীয় এলাকায় ইলিশ ডিম ছেড়ে থাকলেও মেঘনার ঢালারচর, মনপুরা দ্বীপ, মৌলভীর চর ও কালির চরের প্রায় ৫২০ বর্গ কিলোমিটার ইলিশের অন্যতম প্রজনন ক্ষেত্র। এর মধ্য উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- চট্টগ্রাম (উত্তর-পূর্ব সাহেরখালী হতে হাইত কান্দি পয়েন্ট), ভোলা (উত্তর-পশ্চিম তজুমদ্দিন/পশ্চিম আউলিয়া পয়েন্ট), ভোলা (দড়্গিণ-পূর্ব কুতুবদিয়া/গান্দামারা পয়েন্ট) এবং পটুয়াখালী (দড়্গিণ-পশ্চিম লতাচাপালী পয়েন্ট) [২]। ফলে নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত সময়কালে এ এলাকা ও এর নিকটবর্তী এলাকাই হচ্ছে যথাক্রমে জাটকার প্রধান বিচরণ কাল ও ক্ষেত্র। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে এলাকার জেলেরা ছোট ফাঁসের জাল (যা কারেন্ট জাল নামের সর্বাধিক পরিচিত) দিয়ে নির্বিচারে জাটকা ধরে চলেছে। ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র পর্যায়ে জাটকা নিধন নির্মূলে নানাবিধ কার্যক্রম গ্রহণ করার পরও জাটকা নিধনের তীব্রতা লক্ষ্যণীয় মাত্রায় কমানো সম্ভব হয়নি।

প্রথমে দেখে নেয়া যাক ইলিশ রক্ষা ও জাটকা নিধন নির্মূলে গৃহিত নানাবিধ উল্লেখযোগ্য কার্যক্রম সমূহ-

  • বছরের একটি সুনির্দিষ্ট সময়ে (সাধারণত ১ নভেম্বর থেকে ৩১ মে পর্যন্ত) জাটকা ধরা নিষিদ্ধ ঘোষনা।
  • জাটকা নিধনের প্রধান উপকরণ- কারেন্ট জাল তৈরি, আমদানি, বিক্রি, সংরক্ষণ, পরিবহন ও ব্যবহার অবৈধ (মৎস্য রক্ষা ও সংরক্ষণ আইন: ২০০২) করে আইন প্রনয়ন।
  • প্রতি বছর জাটকা সংরক্ষণ সপ্তাহ পালন (জাটকা নিধন বন্ধের আহ্বান, জাটকা সংরক্ষণের গুরুত্ব প্রচার ও জাটকা নিধন বন্ধে জেলেদের সচেতনতা বাড়ানো)।
  • জাটকা শিকারী জেলেদের বিকল্প কর্মসংস্থান সৃষ্টি, ক্ষতিগ্রস্থ জেলেদের মাঝে চাল বিতরন।
  • ইলিশের জন্য সুনির্দিষ্ট অভয়াশ্রম স্থাপন।
  • দেশের প্রধান ৪টি ইলিশ প্রজনন ক্ষেত্রে ১৫ অক্টোবর থেকে ২৪ অক্টোবর পর্যন্ত বড় পূর্ণিমার ১০ দিন মা-বাবা ইলিশ ধরা নিষিদ্ধ করে সরকারি আদেশ জারি। ইত্যাদি।

কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে এসব এলাকায় জাটকা (এমনকি মা-ইলিশ) নিধন বন্ধ করা সম্ভব হয়নি। কারণ হিসেবে বলা যায়-

  • বছরের একটি নির্দিষ্ট সময়ে আইন করে জাটকা ও মা ইলিশ ধরা নিষিদ্ধ করা হলেও দক্ষ ও পর্যাপ্ত জনবলের অভাবে তা সিংহভাগ ক্ষেত্রে বাস্তবায়ন সম্ভব হচ্ছে না। ।
  • জাটকা নিধনের প্রধান উপকরণ- কারেন্ট জাল তৈরি, আমদানি, বিক্রি, সংরক্ষণ, পরিবহন ও ব্যবহার অবৈধ হলেও এ জাল তৈরি, বিক্রি, সংরক্ষণ, পরিবহণ আর ব্যবহার হচ্ছে প্রকাশ্যেই। মৎস্য রক্ষা ও সংরক্ষণ আইনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট আবেদন করে কৌশলে মাসের পর মাস স্থগিতাদেশ নিয়ে এর উৎপাদন ও বিক্রি অব্যহত রাখার মতো ঘটনাও ঘটেছে। শুধু মুন্সিগঞ্জের মুক্তারপুরেই কারেন্ট জাল তৈরির প্রায় ৬০টি কারখানা আছে [৩]। চাঁদপুরসহ সারা দেশে প্রকাশ্যে কারেন্ট জাল বিক্রি অব্যাহত রয়েছে। অথচ শুধু ইলিশই নয় বাংলাদেশের মৎস্যসম্পদ ধ্বংসের জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ি হচ্ছে এই কারেন্ট জাল।
  • জাটকা সংরক্ষণ সপ্তাহ পালন উপলক্ষ্যে নৌ-শোভাযাত্রার পাশেই কারেন্ট জাল ব্যবহার করে জাটকা নিধনের ঘটনা প্রতি বছরই কমবেশি দেখা যায় [৪] যা এজাতীয় সচেতনতামূলক কার্যক্রমকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলে
  • জাটকা শিকারী জেলেদের মাঝে চাল বিতরন করা হলেও একদিকে যেমন নানা অব্যবস্থাপনার খবর পত্রিকায় এসেছে অন্যদিকে শুধু চাল (ভাত) খাবার হিসেবে যথেষ্ট নয় নিদেনপক্ষে ডাল, লবন ও তেল আবশ্যকীয় উপাদান। এছাড়াও বিকল্প কর্মসংস্থানের বিষয়টি অঙ্কুরেই রয়ে গেছে
  • ইলিশের জন্য সুনির্দিষ্ট অভয়াশ্রম স্থাপন করা হলেও তার দেখভাল করার জন্য দক্ষ ও পর্যাপ্ত জনবল নেই। একই বিষয় দেশের প্রধান ৪টি ইলিশ প্রজনন ক্ষেত্রে ১৫ অক্টোবর থেকে ২৪ অক্টোবর পর্যন্ত বড় পূর্ণিমার ১০ দিন মা-বাবা ইলিশ ধরা নিষিদ্ধ করে সরকারি আদেশ জারি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।

অথচ দেশে যে পরিমাণ জাটকা উৎপাদিত হয় তার ১০% বড় হওয়ার সুযোগ পেলে ইলিশের উৎপাদন দ্বিগুণ হবে [১]। শুধু চাঁদপুরেই মেঘনা নদী থেকে জেলেরা প্রতিবছর ১৫ থেকে ২০ হাজার টন জাটকা শিকার করেন। এই জাটকাগুলো বড় ইলিশে পরিণত হলে এর পরিমাণ দাঁড়াত দেড় লাখ টনের মতো। জাটকা শিকারের কারণে বছরে প্রায় শত কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে [৩]। তাই ইলিশ রক্ষায় মা-ইলিশ ও জাটকা সংরক্ষণে কার্যকর কৌশল গ্রহণ করা একান্ত প্রয়োজনীয় এবং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

তথ্যসূত্রঃ


Visited 3,538 times, 1 visits today | Have any fisheries relevant question?
ইলিশ রক্ষায় জাটকা সংরক্ষণ: বর্তমান ও ভবিষ্যত

Visitors' Opinion

এ বি এম মহসিন

প্রফেসর, ফিশারীজ বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী-৬২০৫, বাংলাদেশ। বিস্তারিত ...

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.