চলন বিল বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বিল যা দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে রাজশাহী বিভাগে অবস্থিত। জলায়শটি ২৪.৩৫০ হতে ২৪.৭০০ উত্তর এবং ৮৯.১০০ হতে ৮৯.৩৫০ পূর্ব অক্ষাংশে অবস্থিত যা নওগাঁ জেলার আত্রাই উপজেলা; নাটোর জেলার সিংড়া, গুরুদাসপুর ও বড়াইগ্রাম উপজেলা, পাবনার ভাঙ্গুরা ও চাটমোহর উপজেলা এবং সিরাজগঞ্জ জেলার তারাস, উল্লাপাড়া ও রায়গঞ্জ উপজেলা জুড়ে অবস্থিত (Galib and Samad, 2009)। চলন বিলের আকার বর্ষাকালে ৩৫০ বর্গ কিলোমিটারের অধিক এবং শুকনো মৌসুমে প্রায় ৯০ কিলোমিটার এবং এই জলাশয়টি দেশের জনগণের কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও মৎস্য উৎপাদনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে (Galib and Samad, 2009)। ১৯০৯ সালে এই বিলের আয়তন ছিল ১০,৯,০০০ হেক্টর যা বর্তমানে কমে দাড়িয়েছে ৮,৫০০০ মাত্র হেক্টর (Rahman, 2005)। চলন বিলের মধ্য দিয়ে বেশ কয়েকটি নদী প্রবাহিত হয়েছে। তাদের মধ্যে আত্রাই, গুড়, করোতোয়া, বড়াল, মরা বড়াল, তুলসী, ভাদাই, চিকনাই, বরোনজা, তেলকুপি ইত্যাদি।
চলন বিলের মাছ: বেশ কয়েকটি গবেষণার মাধ্যমে দেখা গেছে যে বিগত কয়েক দশকে চলন বিলের মাছের উৎপাদন যেমন কমেছে তেমনি কমেছে মাছের প্রজাতি। অনেক মাছ স্থানীয় ভাবে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। ২০০৬-২০০৭ সালে পরিচালিত এক গবেষণার মাধ্যমে Galib et al. (2009a) চলন বিলে ৮১ প্রজাতির মাছ রেকর্ড করে যার মধ্যে ৭২টি প্রজাতি দেশীয় এবং ৯টি প্রজাতি বিদেশী মাছ অন্তর্ভুক্ত। Karim (2003) ১৯৮২ সালে চলন বিলে প্রায় ৭৫ প্রজাতির মাছ রেকর্ড করেন।
চলনবিলের যে অংশে সারাবছর পানি থাকে সে অংশের উৎপাদন ৬০০০ মেট্রিক টন এবং মৌসুমী অংশের (৪-৬ মাস পানি থাকে) উৎপাদন ৫০০০ মেট্রিক টন (Karim, 2003)।
মাছ ধরার গিয়ার: চলন বিলে মাছ ধরার জন্য বিভিন্ন ধরনের বৈচিত্রময় যন্ত্রপাতি (গিয়ার) ব্যবহৃত হয়। এর মধ্যে বিভিন্ন ধরনের জাল, বরশি, ফাঁদ, আঘাতকারী গিয়ার ইত্যাদি প্রধান। Galib et al. (2009b) চলন বিলে ২৭ ধরনের মাছ ধরার গিয়ার এবং ২টি বিশেষ ধরনের মাছ সংগ্রহের পদ্ধতি রেকর্ড করেন।
চলন বিলের মাছ বিক্রির আড়ত ও বাজারসমূহ: প্রতি বছরই চলন বিল হতে প্রচুর পরিমান মাছ ধরা হয় এবং তা দেশের প্রায় সর্বত্রই ছড়িয়ে যায় বিভিন্ন ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর মাধ্যমে। চলন বিলের সংলগ্ন বেশ কয়েকটি বড় মাছের আড়ত রয়েছে যেগুলোতে প্রচুর পরিমাণে বিলের মাছ পাওয়া যায়। এ আড়তগুলো হলো নাটোরের সিংড়া উপজেলার সিংড়া ও চৌগ্রাম মাছের আড়ত/বাজার; নওগাঁ জেলার আত্রাই উপজেলার আত্রাই মাছের আড়ত/বাজার; পাবনার চাটমোহর উপজেলার চাটমোহর মাছের বাজার/আড়ত, ভাঙ্গুড়া উপজেলার ভাঙ্গুড়া মাছের বাজার/আড়ত এবং সিরাজগঞ্জ জেলার তারাশ উপজেলার মহিষলুঠি মাছের বাজার/আড়ত। এছাড়াও বিলের আশেপাশে অনেক ছোট বড় মাছের বাজার রেয়েছে যেখানে চলন বিলের মাছ পাওয়া যায়। এর মধ্যে নাটোর জেলার নাটোর ও নলডাঙ্গা (সদর),কালিগঞ্জ (সিংড়া),বড়াইগ্রাম, জোনাইল ও রাজাপুর বাজার (বড়াইগ্রাম), গুরুদাসপুর ও কাছিকাটা গুরুদাসপুর); বগুড়ার রনবাঘা; সিরাজগঞ্জের তারাশের মান্নাননগর ও তারাশ মাছের বাজার।
চলন বিলের মাছের শুটকী: চলন বিলের আশেপাশে বিভিন্ন স্থানে বিল হতে ধৃত মাছের শুটকী করা হয়ে থাকে। এর মধ্যে আত্রাই, সিংড়া, তারাশ ও ভাঙ্গুড়া উপজেলা প্রধান। Samad et al. (2009) মোট ২৬ প্রজাতির মাছ শুটকী তৈরীতে ব্যবহৃত হয় বলে উল্লেখ করেন যার মধ্যে ৫টি প্রজাতির মাছ (পুটি, চান্দা, কাকিলা, টাকি ও বোয়াল) ব্যাপক পরিমানে ব্যবহৃত হয়; এসকল শুটকীর প্রায় সবটুকুই নীলফামারী জেলার সৈয়দপুর শুটকী আড়তে চলে যায় এবং সেখান থেকে অন্যান্য স্থানে চলে যায় বিক্রির উদ্দেশ্যে।
সমস্যাসমূহ: চলন বিলে অবৈধ মাছ ধরার যন্ত্রপাতির ব্যবহার (যেমন কারেন্ট জাল) এবং নির্বিচারে ছোট-বড় মাছ ধরা খুবই সাধারণ একটি ব্যাপার (Galib et al. 2009a)।ফলে কমে আসছে মাছের প্রাচুর্যতা ও বৈচিত্রতা।
বর্তমানে প্রতি বছরই চলন বিলের জমি ভরাট করে গড়ে উঠছে নতুন নতুন বসতবাড়ি। শুষ্ক মৌসুমে বিলের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত নদী ও খালের গভীর অংশ ব্যাতীত অগভীর অংশ শুকিয়ে যায় এবং সেখানে বোরো ও অন্যান্য উচ্চফলনশীল ধানের পাশাপাশি পেয়াজ, রসুন ইত্যাদিরও চাষ হয়।
_________________________________________________________
তথ্যসূত্র:
Galib SM and Samad MA. 2009. Harvesting, traditional preservation and marketing of fishes of Chalan Beel, Bangladesh, Aquaculture Asia XIV(1): 12-15.
Galib SM, Samad MA, Kamal MM, Haque MA and Hasan MM. 2009b. A Study on Fishing Gears and Methods in the Chalan Beel of North-West Bangladesh, Journal of Environmental Science & Natural Resources 2(2): 213-218.
Galib SM, Samad MA, Mohsin ABM, Flowra FA and Alam MT. 2009a. Present Status of Fishes in the Chalan Beel- the Largest Beel (Wetland) of Bangladesh, International Journal of Animal and Fisheries Science 2(3): 214-218.
Karim MS. 2003. Discussion on the causes of reduction of fisheries resources in Chalan beel (in Bengali), Matsha Pakkha 2003, pp. 95-96.
Rahman AKA. 2005. Freshwater Fishes of Bangladesh, 2nd edition, Zoological Society of Bangladesh, Department of Zoology, University of Dhaka, Dhaka-1000, pp. 23-33.
Samad MA, Galib SM, Flowra FA. 2009. Fish Drying in Chalan Beel Areas, Bangladesh Journal of Scientific and Industrial Research 44(4): 461-466.
Visited 2,273 times, 1 visits today | Have any fisheries relevant question?