দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মাছ কিসিং গোউরামি (Kissing Gourami, Helostoma temminkii) ভারত ও থাইল্যান্ড থেকে সর্বপ্রথম আমাদের দেশের নিয়ে আসে এ্যাকুয়ারিয়ামের বাহারি মাছের ব্যবসায়ীরা। বর্তমানে ঢাকা ছাড়াও চট্টগ্রাম, খুলনা, যশোর, রাজশাহীসহ বড় বড় শহরের বাহারি মাছের দোকানে এই মাছ বিক্রি হতে দেখা যায়। এরা সারাক্ষণই মাংসল ঠোট দিয়ে অন্য গোউরামির ঠোট বা অন্য প্রজাতির মাছের দেহের উপরিভাগ চুষে থাকে যা দেখতে অনেকটা চুম্বন সদৃশ বিধায় এর নাম হয়েছে কিসিং গোউরামি (Fishlore, 2014)। তবে প্রকৃত পক্ষে কিসিং গোউরামির এই চোষক আচরণটি চুম্বন নয় বরং এটি এদের আক্রমণাত্মক আচরণের বহিঃপ্রকাশ মাত্র। এর মাধ্যমে এরা অন্যের উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করে ও বজায় রাখে। এরা অন্য প্রজাতির মাছের দেহের উপরিভাগের মিউকাস খেয়ে ফেলে ফলে আক্রান্ত মাছ ক্ষতিকর অণুজীব দ্বারা সহজেই সংক্রামিত হয়ে মারা যেতে পারে।
শ্রেণীতাত্ত্বিক অবস্থান (Systematic position)
পর্ব: Chordata (chordates)
শ্রেণী: Actinopterygii (Ray-finned fishes)
বর্গ: Perciformes (perch-like fishes)
পরিবার: Helostomidae (Kissing gourami)
গণ: Helostoma
প্রজাতি: Helostoma temminkii (Cuvier, 1829)
সমনাম (Synonyms)
Helostoma striolatum Kuhl & van Hasselt in Bleeker, 1879
Helostoma temmincki Cuvier, 1829
Helostoma temminckii Cuvier, 1829
Helostomi temmincki Cuvier, 1829
সাধারণ নাম (Common name)
বাংলা: কিসিং গোউরামি, চুম্বন গোউরামি
English: Kissing Gourami, Pink kisser, Green kisser, Marbled Kissing Fish, Kisser
বিস্তৃতি (Distribution)
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া যথা মধ্য থাইল্যান্ড থেকে ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত (কম্বোডিয়া ও মালয়েশিয়াসহ) এদের বিস্তৃতি পরিলক্ষিত হয় (Coughlin, 2014)। বাহারি মাছ হিসেবে এই মাছ পৃথিবীর দেশে দেশে বিস্তার লাভ করেছে যেমনটা করেছে বাংলাদেশ।
Fishbase (2014) অনুসারে প্রকৃতিতে এদের বিস্তৃতি 16°N – 6°S ।
সংরক্ষণ অবস্থা (Conservation status)
IUCN RedList, 2014 অনুসারে এরা Least Concern (LC)
দৈহিক গঠন (Morphology)
লম্বা দেহ পার্শ্বীয়ভাবে বেশ চাপা। উজ্জ্বল রূপালী বর্ণের আঁইশ উপস্থিত। প্রকৃতিতে এদের দেহের বর্ণ বাদামী-সবুজ হয়ে থাকে। তবে এ্যাকুয়ারিয়ামে এদের দেহের বর্ণ প্রধানত গোলাপি। এছাড়াও এদের দেহের পৃষ্ঠভাগ হালকা জলপাই সবুজ এবং আঙ্কীয়ভাগ হলকা সোনালী বর্ণেরও হয়ে থাকে। পার্শ্বরেখা বিচ্ছিন্নভাবে উপস্থিত।
এদের চোয়ালে দাঁত নেই। মাংসল পুরু ঠোট বর্তমান। এরা এদের মাংসল ঠোটের সাহায্যে যখন কোন কিছু যেমন মাছ, খাদ্য, জলজ উদ্ভিদ এমনকি পাথর ইত্যাদিকে চোষে তখন তা চুম্বনের মতই দেখায়।
পৃষ্ঠ ও পায়ু পাখনা অনেক লম্বা তবে তা পুচ্ছ পাখনার সাথে একীভূত নয়। পৃষ্ঠ পাখনার ভিতের (base) দৈর্ঘ্য পায়ু পাখনার ভিতের দৈর্ঘ্যের চেয়ে সামান্য বেশি। পৃষ্ঠ পাখনায় ১৮টি কণ্টকিত ও ১১-১২টি নরম শাখান্বিত পাখনা রশ্মি বর্তমান। অন্যদিকে পায়ু পাখনায় ১৬টি কণ্টকিত ও ১২টি নরম শাখান্বিত পাখনা রশ্মি বর্তমান (FAO, 2014)। পৃষ্ঠ পাখনা বক্ষ পাখনার বিপরীত পাশে বরাবর বা সামান্য অগ্রভাগে শুরু হয়ে থাকে। পুচ্ছ পাখনার প্রান্তভাগ গোলাকার।
এদের বাতাস থেকে অক্সিজেন গ্রহণের উপযোগী অঙ্গ উপস্থিত যা ল্যাবিরিন্থ এপারেটাস (labyrinth apparatus) নামে পরিচিত। ফলে এরা কম অক্সিজেন সমৃদ্ধ জলাশয়েও দিব্যি বেঁচে থাকতে পারে।
Galib and Mohsin (2011) অনুসারে এদের আদর্শ দৈর্ঘ্য, দেহ উচ্চতা ও মাথার দৈর্ঘ্য মোট দৈর্ঘ্যের যথাক্রমে ৮০.৫৬, ৩২.৬৪ ও ৩১.৯৪ শতাংশ। অন্যদিকে চোখের ব্যস মাথার দৈর্ঘ্যের ৩০.৪৩ শতাংশ।
পাখনা সূত্র (Fin Formula):
D. 30; P1. 12; P2. 7; A. 28; C. 12 (Galib and Mohsin, 2011)। অর্থাৎ এদের পৃষ্ঠ পাখনায় ত্রিশটি, বক্ষ পাখনায় ১২টি, শ্রোণী পাখনায় ৭টি, পায়ু পাখনায় ২৮টি ও পুচ্ছ পাখনায় ১২টি পাখনা রশ্মি দেখতে পাওয়া যায়।
সর্বোচ্চ দৈর্ঘ্য (Maximum length)
Saxena (2003) অনুসারে এই মাছের সর্বোচ্চ দৈর্ঘ্য ১২ ইঞ্চি বা ৩০ সেমি। কিন্তু বাংলাদেশে এই মাছের রেকর্ডকৃত সর্বোচ্চ দৈর্ঘ্য দশ সেমি (Galib and Mohsin, 2011)। Coughlin (2014) অনুসারে এই মাছের গড় দৈর্ঘ্য ২০ সেমি তবে এরা ১৭ থেকে ৩০ সেমি পর্যন্ত হতে পারে।
আবাস্থল (Habitat)
উষ্ণ জলের স্বাদুপানির মাছ। হ্রদ, পুকুর, নদী, নালা, ঝর্ণাধারা (streams), সোয়াম্প (swamps), ইত্যাদিতে পাওয়া যায়। গড় গভীরতা ২ মিটার বা ৬.৫৬ ফুট। যেখানে সামান্য অম্লীয় পানির উপস্থিতি রয়েছে এমন জলাশয়ে এরা বাস করে। জলাশয়ের মধ্যতল থেকে উপরিতলের মধ্যে এদের বিচরণ সবচেয়ে বেশি পরিলক্ষিত হয়। জলজ উদ্ভিদের উপস্থিতি এরা পছন্দ করে (Fishbase, 2014)।
ল্যাবিরিন্থ (labyrinth) নামক অতিরিক্ত শ্বাস অঙ্গ থাকায় এরা উষ্ণ জলের কম অক্সিজেন রয়েছে এমন পরিবেশেও দিব্যি বেঁচে থাকতে পারে
খাদ্য এবং খাদ্যাভ্যাস (Food and feeding habit)
প্রকৃতিতে এরা মূলত সর্বভুক প্রাণী। এরা উদ্ভিদকণা (phytoplankton), প্রাণিকণা (zooplankton), জলজ পতঙ্গ (aquatic insects), জলজ উদ্ভিদাংশ (plant material) ইত্যাদি খেয়ে থাকে। এ্যাকুয়ারিয়ামে এরা বিভিন্ন ধরনের প্যাকটজাত খাবার যেমন ফ্লেক্স (flakes), পিলেট (pellets) ইত্যাদি, ফ্রিজ সংরক্ষিত খাবার এবং জীবন্ত খাবার যেমন টিউবিফেক্স (Tubifex), ব্রাইন শ্রিম্প (brine shrimp) ইত্যাদি খেয়ে থাকে।
জীবনকাল ও প্রজনন (Lifecycle and Breeding)
এ্যাকুয়ারিয়ামে এদের জীবনকাল পাঁচ থেকে সাত বছর (Fishlore, 2014) তবে প্রকৃতিতে এরা আরও বেশি দিন বাঁচে বলে ধারণা করা হয়।
এদের স্ত্রী ও পুরুষ মাছ আলাদা করা বেশ কঠিন কারণ এদের স্ত্রী ও পুরুষ প্রায় একই রকম গঠনের হয়ে থাকে। তবে প্রজনন ঋতুতে পুরুষেরা তুলনামূলক উজ্জ্বল হয়ে থাকে। প্রজনন ঋতুতে ডিম ধারণের জন্য স্ত্রীদের উদর স্ফীত হয়ে থাকে ফলে এসময় এদেরকে পুরুষদের তুলনায় অনেক বেশি মোটা দেখায়।
এরা তিন থেকে চার বছরের (ছয় থেকে বার ইঞ্চি) মধ্যেই প্রজননের উপযোগী হয়ে যায়। স্ত্রীরা এক প্রজনন ঋতুতে একটি মাত্র পুরুষের সাথেই জুটি বাধে। এরা ডিম পাড়া মাছ। এরা বছরে একবার প্রজনন করে থাকে এবং এক প্রজনন ঋতুতে এরা সাধারণত এক হাজার ডিম পেড়ে থাকে (Akhter, 1995)। এরা রাত্রিতে ডিম পাড়ে। প্রকৃতিতে বর্ষাকালে এরা প্রজননের জন্য নদী থেকে প্লাবিত বনভূমিতে অভিপ্রয়াণ করে। এসময় বনভূমির মৃত ও শুকনো স্থলজ ঘাসজাতীয় উদ্ভিদের মূল বিচ্ছিন্ন হয়ে পানির উপরিভাগে ভাসতে থাকে। এমন ভাসমান শুকনো উদ্ভিদের মাঝে এদের পুরুষেরা বুদবুদের বাসা তৈরি করে থাকে (Thomas et al., 2003)। এই বুদবুদের বাসা ও শুকনো উদ্ভিদ এদের ডিম ও সদ্যজাত বাচ্চার আশ্রয়স্থল হিসেবে কাজ করে।
এ্যাকুয়ারিয়ামে এদের প্রজনন করানো বেশ কঠিন কারণ এরা বেশ আক্রমণাত্মক এবং এদের জন্য বড় আকারের এ্যাকুয়ারিয়াম প্রয়োজন হয়। তবে এ্যাকুয়ারিয়ামে এই মাছের প্রজননের উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করতে পারলে প্রজনন করানো অসম্ভব নয়। একটি বড় আকারের (দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও পানির উচ্চতা যথাক্রমে (কমপক্ষে) ১০০, ৬০ ও ৬০ সেমি) এ্যাকুয়ারিয়ামের হালকা অম্লীয় জলে জলজ ভাসমান উদ্ভিদ ও সামান্য শুকনো স্থলজ ঘাস যোগ করা প্রয়োজন ডিম ও সদ্য ফোটা বাচ্চার আশ্রয়স্থল হিসেবে। প্রজননের পূর্বে পর্যাপ্ত খাবার সরবরাহ করা আবশ্যক (তবে পুরুষেরা বাসা তৈরি শুরু করলে খাবার সরবরাহ কমিয়ে দিতে হয় কারণ সেসময় এরা খাবার গ্রহণ করেনা বললেই চলে)। স্ত্রীদের উদর যখন ডিম ধারণের কারণে স্ফীত হয়ে যায় তখন পুরুষেরা জলজ ভাসমান উদ্ভিদ ও শুকনো ঘাসের মাঝে বাতাস ও মিউকাস ব্যবহার করে বুদবুদের বাসা (bubble nest) তৈরি করে। বুদবুদের বাসার নীচেই এরা প্রজননে অংশ নেয়। পুরুষেরা পায়ু পাখনা স্পর্শ করে স্ত্রীদের ডিম পাড়তে উদ্বুদ্ধ করে। স্ত্রীরা ডিম পাড়ার পর পুরুষেরা সেই ডিম প্রথমে নিষিক্ত করে এবং পরবর্তীতে বুদবুদের বাসায় নিষিক্ত ডিমগুলো সংরক্ষিত হয়।
এ্যাকুয়ারিয়ামে একবার জুটি বাঁধার পর স্ত্রীরা কয়েক দফায় ডিম দেয় যা স্ত্রী মাছের আকার ও বয়সের উপর নির্ভর করে। ডিম দেয়া ও নিষেক প্রক্রিয়া শেষ হলে মা ও বাবা মাছকে আলাদা এ্যাকুয়ারিয়ামে সরিয়ে নিতে হয় কারণ এসময় মা-বাবা মাছের মধ্যে ডিম ও পোনা খেয়ে ফেলার প্রবণতা দেখতে পাওয়া যায়।
উপযোগী পরিবেশ (Suitable Environment)
এরা ধীর সাঁতারু। ঘন জলজ উদ্ভিদ পরিবেষ্টিত এলাকা বসবাসের জন্য এদের প্রথম পছন্দ। প্রকৃতিতে এই মাছের অনুকূল পরিবেশ হচ্ছে- পিএইচ (pH): ৬-৮, হার্ডনেস (Hardness): ৫-১৯ dH এবং তাপমাত্রা ২২-২৮ ডিগ্রী সে (Fishbase, 2014)।
Fishlore (2014) অনুসারে এ্যাকুয়ারিয়ামে এদের অনুকূল তাপমাত্রা ৭২-৮২° ফা. বা ২২-২৮° সে., হার্ডনেস ৫-২০ ° dH এবং পিএইচ ৫-৭।
রোগ (Diseases)
বাংলাদেশে এই মাছের রোগের উপস্থিতি বিষয়ক কোন তথ্য জানা যায় না।
অর্থনৈতিক গুরুত্ব (Economic importance)
এ্যাকুয়ারিয়ামের বাহারি মাছ হিসেবে পৃথিবীব্যাপী এর চাহিদা রয়েছে। শক্ত প্রকৃতির এই মাছের ব্যবস্থাপনা সহজ হওয়ায় যারা এ্যাকুয়ারিয়ামে বাহারি মাছ পালন শুরু করতে আগ্রহী তারা এই মাছ নির্বাচন করতে পারেন নিশ্চিতভাবেই।
শেওলা নিয়ন্ত্রণে এই মাছ ব্যবহারের সম্ভাব্যতা রয়েছে।
কোন কোন দেশে যেমন থাইল্যান্ডে কিসিং গোউরামি খাবারের মাছ হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। বিভিন্ন ধরণের জাল ব্যবহার করে প্রাকৃতিক জলাশয় ও চাষের জলাশয় থেকে এদের ধরা হয়।
বাজার মূল্য:
বাংলাদেশে প্রতি জোড়া কিসিং গোউরামি পাওয়া যায় ৭০-১১০ টাকার মধ্যে (Galib and Mohsin, 2011)।
তথ্য সূত্র (References)
- Akhter MS 1995. Aquarium Guide (in Bengali), published by Echo Aqua Fisheries Project, 1/6 Pallabi, Mirpur, Dhaka, Bangladesh, pp. 51-71.
- Coughlin M 2014. Helostoma temminkii Green kisser (Also: Pink kisser), Animal Diversity Web, Museum of Zoology, University of Michigan. Retrieved on March 21, 2014.
- FAO 2014. Species Fact Sheets: Helostoma temminckii (Cuvier, 1829). Retrieved on March 22, 2014.
- Fishbase 2014. Helostoma temminkii Cuvier, 1829 Kissing gourami. Retrieved on March 21, 2014.
- Fishlore 2014. Kissing Gourami – Helostoma temmincki. Retrieved on March 21, 2014.
- Galib SM and Mohsin ABM 2011. Cultured and Ornamental Exotic Fishes of Bangladesh: Past and Present. LAP LAMBERT Academic Publishing. 176pp.
- IUCN RedList 2014. Helostoma temminkii. Retrieved on March 21, 2014.
- Saxena A 2003. Aquarium Management. Daya Publishing House, Delhi 110035, India, 230 p.
- Thomas PC, Rath SC and Mohapatra KD 2003. Breeding and Seed Production of Fin Fish & Shell Fish (Foreword by Dr. T.V.R. Pillay), Daya Publishing House, Delhi 110035, India, 377 p.
Visited 1,110 times, 1 visits today | Have any fisheries relevant question?