দক্ষিণ আমেরিকার মাছ ডিসকাস (Discus, Symphysodon discus) এ্যাকুয়ারিয়ামের বাহারি মাছ হিসেবে থাইল্যান্ড ও সিঙ্গাপুর থেকে সর্বপ্রথম আমাদের দেশের নিয়ে আসা হয়। বর্তমানে ঢাকা ছাড়াও দেশের অন্যান্য বড় শহরের (যেমন চট্টগ্রাম, খুলনা, যশোর, রাজশাহী ইত্যাদি) বাহারি মাছের দোকানে এই মাছের দেখা মেলে। পৃথিবীতে প্রায় পঞ্চাশ ভ্যারাইটির (variety) ডিসকাস দেখতে পাওয়া যায়। এর মধ্য আমাদের দেশে সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায়- বাদামী ডিসকাস (Brown Discus), ভূত ডিসকাস (Ghost Discus), মার্বেল ডিসকাস (Marble Discus), সবুজ ডিসকাস (Green Discus) ও লাল-ফিরোজা ডিসকাস (Red Turquoise Discus)। বৈচিত্র্যময় বর্ণের কারণে আকর্ষণীয় বাহারি মাছ হিসেবে আমাদের দেশের বাহারি মাছ লালন-পালনকারীদের কাছে ডিসকাস সবসময়ই কাঙ্ক্ষিত।
শ্রেণীতাত্ত্বিক অবস্থান (Systematic position)
পর্ব: Chordata (chordates)
শ্রেণী: Actinopterygii (Ray-finned fishes)
বর্গ: Perciformes (perch-like fishes)
পরিবার: Cichlidae (cichlids)
গণ: Symphysodon
প্রজাতি: Symphysodon discus Heckel, 1840
শব্দতত্ত্ব (Etymology)
Symphysodon শব্দটি এসেছে দুটি গ্রিক শব্দ থেকে। যার একটি হচ্ছে symphysis অর্থাৎ একসাথে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত (grown together) এবং অন্যটি হচ্ছে odous অর্থাৎ দাঁত (teeth) (Fishbase, 2014)।
সমনাম (Synonyms)
Symphysodon discus willischwartzi Burgess, 1981.
সাধারণ নাম (Common name)
বাংলা: ডিসকাস, নীল ডিসকাস, লাল ডিসকাস, সবুজ ডিসকাস, বাদামী ডিসকাস, নীল হীরা ডিসকাস, মার্বেল ডিসকাস ইত্যাদি
English: Discus, Red discus, Pompadour fish, Heckel discus। এছাড়াও ভ্যারাইটি ও দেহের বর্ণের উপর নির্ভর করে এদের আরও অনেক নামেই ডাকা হয় যথা- Symphysodon, Cobalt blue discus, Red turquoise discus, Marlboro red discus, Pigeon blood discus, Green discus, Brown discus, Snake skin discus, Blue diamond discus, Ocean green discus ইত্যাদি।
বিস্তৃতি (Distribution)
প্রধানত দক্ষিণ আমেরিকার ব্রাজিলের আমাজন নদী ও পার্শ্ববর্তী প্লাবিত জলাশয়ে ডিসকাস দেখতে পাওয়া যায় (Thomas et al., 2003)। এছাড়াও কলম্বিয়া (Colombia) ও পেরুতেও (Peru) এদের দেখা মেলে (Fishsabby, 2014)।
সংরক্ষণ অবস্থা (Conservation status)
IUCN 2013 অনুসারে ডিসকাসের সংরক্ষণ অবস্থা এখনো মূল্যায়ন করা হয়নি (Not Evaluated)।
দৈহিক গঠন (Morphology)
প্রায় গোলাকার দেহ পার্শ্বীয়ভাবে বেশ চাপা। দেহের বর্ণ ভ্যারাইটি (variety) ভেদে আলাদা যেমন- নীল ডিসকাসের বর্ণ গাঢ় নীল, বাদামী ডিসকাসের বর্ণ বাদামী। সাধারণত ডিসকাসের দেহে আড়াআড়ি আবার কখনো অনিয়মিতভাবে বিভিন্ন বর্ণের পুরু রেখা দেখতে পাওয়া যায়। যেমন- রূপালী বর্ণের মাঝে লাল বর্ণের অনিয়মিত রেখা দেখা যায় লাল-ফিরোজা ডিসকাস (Red Turquoise Discus) এর দেহে।
Galib and Mohsin (2011) অনুসারে এদের আদর্শ দৈর্ঘ্য, দেহ উচ্চতা ও মাথার দৈর্ঘ্য মোট দৈর্ঘ্যের যথাক্রমে ৭৮-৮০, ৪৫-৫৭ ও ২৭-২৯ শতাংশ। অন্যদিকে চোখের ব্যস মাথার দৈর্ঘ্যের ৩০-৪০ শতাংশ।
পাখনা সূত্র (Fin Formula)
D. 33; P1. 12; P2. 7; A. 36; C. 16 (Galib and Mohsin, 2011)। অর্থাৎ এদের পৃষ্ঠ পাখনায় তেত্রিশটি, বক্ষ পাখনায় ১২টি, শ্রোণী পাখনায় ৭টি, পায়ু পাখনায় ৩৬টি ও পুচ্ছ পাখনায় ১৬টি পাখনা রশ্মি দেখতে পাওয়া যায়।
সর্বোচ্চ দৈর্ঘ্য (Maximum length)
Thomas et al., 2003 অনুসারে এই মাছের সর্বোচ্চ দৈর্ঘ্য ৯ ইঞ্চি বা ২৩ সেমি। বাংলাদেশে এই মাছের রেকর্ডকৃত সর্বোচ্চ দৈর্ঘ্য ১৫ সেমি (Galib and Mohsin, 2011)। Mills and Vevers (1989) অনুসারে এই মাছের সর্বোচ্চ দৈর্ঘ্য ২০ সেমি।
আবাসস্থল (Habitat)
উষ্ণ জলের স্বাদুপানির মাছ। আমাজন নদী ও নদী সংলগ্ন জলাভূমি এদের প্রধান আবাসস্থল।
এরা এ্যাকুয়ারিয়ামের তলদেশ থেকে মধ্য স্তরে থাকতে পছন্দ করে।
এরা অনেকটাই শান্ত প্রকৃতির মাছ। তবে প্রজননের উদ্দেশ্যে যখন যুগলবন্দী হয় তখন এরা এদের নিজস্ব এলাকা (territory) নির্বাচন করে এবং সেখানে অন্য কোন মাছকে প্রবেশ করতে দেয়না।
খাদ্য এবং খাদ্যাভ্যাস (Food and feeding habit)
প্রকৃতিতে এরা শিকারই মাছ। তবে প্রধানত জলজ পতঙ্গ (aquatic insects), টিউবিফেক্স (Tubifex) ইত্যাদি খেয়ে থাকে। এছাড়াও এরা জলজ উদ্ভিদের ক্ষুদ্রাকার পাতাও খেয়ে থাকে (Akhter, 1995)। Mills and Vevers (1989) অনুসারে এরা কীট (worms), ক্রাসটেশিয়ান্স (crustaceans) ও উদ্ভিদের বিভিন্ন অংশ (plant matter) খেয়ে থাকে।
Fishsabby (2014) অনুসারে এ্যাকুয়ারিয়ামে এরা হিমায়িত খাদ্য যথা- রক্তকীট (Bloodworms), ব্রাইন শ্রিম্প (brines shrimp), মাইসিস শ্রিম্প (Mysis shrimp) ইত্যাদি; শুকনো ও ফ্রিজ সংরক্ষিত খাবার; জীবন্ত খাবার যেমন-কেঁচো (Earthworms), লাল কীট (red worms), মশার শূককীট (mosquito larvae), ব্রাইন শ্রিম্প (brine shrimp) ইত্যাদি খেয়ে থাকে। এছাড়াও গরু, ছাগল, মুরগি ইত্যাদির হৃদপিণ্ড এদের খাবার হিসেবে সরবরাহ করা যায়।
জীবনকাল ও প্রজনন (Lifecycle and Breeding)
এ্যাকুয়ারিয়ামে ভালভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা সম্ভব হলে এরা পাঁচ বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকে (Fishsabby, 2014) তবে প্রকৃতিতে এরা আরও বেশি দিন বাঁচে বলে ধারণা করা হয়।
এদের স্ত্রী ও পুরুষ মাছ আলাদা। এরা ডিম পাড়া মাছ এবং এদের নিষেক ঘটে দেহের বাহিরে। এরা এক সাথে কয়েকশত ডিম পাড়ে এবং ডিমগুলো পাথর বা জলজ উদ্ভিদের সাথে আটকে থাকে। বাবা-মা উভয়েই ডিম ও সদ্যজাত বাচ্চার দেখাশোনা করে যতদিন না স্বনির্ভর হয়। জন্মের পর বেশ কিছু দিন বাচ্চারা বাবা-মায়ের ত্বক উদ্ভূত মিউকাস (skin mucus) খেয়ে থাকে (Balon, 1990)।
এ্যাকুয়ারিয়ামে এদের প্রজনন করানো কঠিন হলেও অসম্ভব নয়। কাঙ্ক্ষিত পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারলে এদের প্রজনন করানো যায়। এদের জন্য বড় আকারের এ্যাকুয়ারিয়াম (কম পক্ষে ৩৬x১৮x১৮ ইঞ্চি আকারের) প্রয়োজন হয়। এসময় পর্যাপ্ত পরিমাণে জীবন্ত খাবার সরবরাহ করা আবশ্যক। প্রজননের জন্য অনুকূল তাপমাত্রা ৮২° ফা. বা ২৮° সে. এবং পিএইচ ৬.৫ এর কাছাকাছি। মায়েরা ডিম পাড়ার পর বাবারা ডিম নিষিক্ত করে। ডিমগুলো কোন পাথর বা জলজ উদ্ভিদের গায়ে লেগে থাকে। তাই প্রজনন এ্যাকুয়ারিয়ামে আগে থেকেই কিছু জলজ উদ্ভিদ ও পাথর স্থাপন করা আবশ্যক। আটচল্লিশ ঘণ্টার মধ্যেই ডিম ফুটে বাচ্চা বের হয়। বাব-মায়েরা সম্মিলিতভাবে নিষিক্ত ডিম ও সদ্যজাত বাচ্চার দেখাশোনা করে। জন্মের পর বেশ কিছু দিন বাচ্চারা বাবা-মায়ের ত্বক উদ্ভূত মিউকাস (skin mucus) খেয়ে থাকে বিধায় এসময় তাদের জন্য খাবার সরবরাহ করার প্রয়োজন হয়না তবে ২-৩ সপ্তাহের মধ্যেই এদের খাবারের জন্য সদ্যজাত ব্রাইন শ্রিম্পের (brine shrimp) সরবরাহ করা প্রয়োজন।
উপযোগী পরিবেশ (Suitable Environment)
স্বাদুপানির এই মাছের অনুকূল পরিবেশ হচ্ছে- পিএইচ (pH): ৪.২-৬.২ এবং তাপমাত্রা ২৬-৩০ ডিগ্রী সে (Fishbase, 2014)।
Fishsabby (2014) অনুসারে এ্যাকুয়ারিয়ামে এদের অনুকূল তাপমাত্রা ৮২-৮৮° ফা. বা ২৮-৩১° সে., কার্বনেট হার্ডনেস (carbonate hardness or carbonate alkalinity) ৮-১৫ ° Dkh এবং পিএইচ ৫.৫-৮।
রোগ (Diseases)
Bailey and Stanford, 1999 অনুসারে এদের হেক্সামিশয়েসেস (Hexamitiasis, hole-in-head-disease) নামক রোগ হয়ে থাকে। তবে বাংলাদেশে এই মাছ এর রোগ বিষয়ে কোন তথ্য পাওয়া যায় না।
অর্থনৈতিক গুরুত্ব (Economic importance)
এ্যাকুয়ারিয়ামের বাহারি মাছ হিসেবে পৃথিবীব্যাপী এর চাহিদা রয়েছে। শক্ত প্রকৃতির এই মাছের ব্যবস্থাপনা সহজ হওয়ায় যারা এ্যাকুয়ারিয়ামে বাহারি মাছ পালন শুরু করতে আগ্রহী তারা এই মাছ নির্বাচন করতে পারেন নিশ্চিতভাবেই। প্রজননের মাধ্যমে এই মাছের উৎপাদন বাড়ানোর মাধ্যমে দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রপ্তানি করা সম্ভব।
বাজার মূল্য:
বাংলাদেশে প্রতি জোড়া ডিসকাস ভ্যারাইটি অনুসারে ৫০০-১০০০ টাকার মধ্যে পাওয়া যায় (Galib and Mohsin, 2011)।
তথ্য সূত্র (References)
- Akhter MS 1995. Aquarium Guide (in Bengali), published by Echo Aqua Fisheries Project, 1/6 Pallabi, Mirpur, Dhaka, Bangladesh, pp. 51-71.
- Bailey, M. and Stanford, G. 1999. Practical Fishkeeping, published by Sebastian Kelly, 2 Rectory Road, Oxford OX4 IBW, 128 p.
- Balon, E.K., 1990. Epigenesis of an epigeneticist: the development of some alternative concepts on the early ontogeny and evolution of fishes. Guelph Ichthyol. Rev. 1:1-48.
- Fishbase 2014. Symphysodon discus Heckel, 1840 Red discus, Retrieved on April 8, 2014.
- Fishsabby 2014. Discus fish Symphysodon. Retrieved on April 8, 2014.
- Galib SM and Mohsin ABM 2011. Cultured and Ornamental Exotic Fishes of Bangladesh: Past and Present. LAP LAMBERT Academic Publishing. 176pp.
- IUCN 2013. IUCN Red List of Threatened Species. Version 2013.2. Downloaded on 08 April 2014.
- Mills, D. and Vevers, G. 1989. The Tetra encyclopedia of freshwater tropical aquarium fishes. Tetra Press, New Jersey, 208 p.
- Thomas PC, Rath SC and Mohapatra KD 2003. Breeding and Seed Production of Fin Fish & Shell Fish (Foreword by Dr. T.V.R. Pillay), Daya Publishing House, Delhi 110035, India, 377 p.
Visited 2,575 times, 1 visits today | Have any fisheries relevant question?