ফিশারীজ কোন মৌলিক বিজ্ঞান নয় বরং এটি জীববিজ্ঞান, রসায়ন, গণিত ও পদার্থবিজ্ঞানের একটি সমন্বিত বিজ্ঞান যা মাছ ও অন্যান্য অর্থনৈতিক গুরুত্ব বিশিষ্ট জলজ প্রাণীদের জীবতত্ত্ব, চাষ, আবাসস্থল ব্যবস্থাপনা, আহরণ, প্রক্রিয়াজনকরণ ইত্যাদি বিষয়ে বিজ্ঞানভিত্তিক আলোচনা করে। তাই ফিশারীজকে বুঝতে হলে অবশ্যই জীববিজ্ঞান, রসায়ন, গণিত ও পদার্থবিজ্ঞানের মৌলিক বিষয়াদি সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা থাকা প্রয়োজন। সে উদ্দেশ্য পূরণকল্পে শুরু হল বিডিফিশ বাংলার পূর্বপাঠ অধ্যায়। এলেখার বিষয় প্রাণীর পরিস্ফুটন। সাথে রইল কুইজে অংশ নেয়ার সুযোগ

 

পরিস্ফুটন (Development):
পরিস্ফুটন (Development) প্রাণীর জীবনব্যাপী চলমান একটি প্রক্রিয়া যা কতগুলো ধারাবাহিক পর্যায়ের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়ে থাকে। পর্যায়গুলো নিচে আলোচিত হল।

জননকোষ সৃষ্টি (Gametogenesis):
মুখ্য জার্মিনাল কোষ বা প্রিমোর্ডিয়াল জনন কোষ বা জনন মাতৃকোষ থেকে শুক্রাণু বা ডিম্বাণু সৃষ্টির প্রক্রিয়াই হচ্ছে জননকোষ সৃষ্টি বা Gametogenesis। জনন মাতৃকোষ ডিপ্লয়েড সংখ্যক (2n) ক্রোমোজোমবিশিষ্ট হলেও শুক্রাণু ও ডিম্বাণু হ্যাপ্লয়েড সংখ্যক (n) ক্রোমোজোমবিশিষ্ট জননকোষ। শুক্রাণু ও ডিম্বাণু যথাক্রমে পুরুষের শুক্রাশয়ে এবং স্ত্রীপ্রাণীর ডিম্বাশয়ে জনন মাতৃকোষ থেকে উৎপন্ন হয়ে থাকে।

গ্যামেটোজেনেসিসের প্রথম দশা তথা সংখ্যাবৃদ্ধি দশায় মাইটোসিস প্রক্রিয়ায় শুক্রাশয় ও ডিম্বাশয়ে যথাক্রমে স্পার্মাটোগোনিয়া ও উওগোনিয়া উৎপন্ন হয়। সংখ্যাবৃদ্ধি শেষে প্রতিটি স্পার্মাটোগোনিয়া ও উওগোনিয়া যথাক্রমে প্রাথমিক বা গৌণ স্পার্মাটোসাইট ও উওসাইটে পরিণত হয়। সবশেষে পূর্ণতা পর্যায়ে মিয়োসিস কোষ বিভাজনের মাধ্যমে একটি প্রাথমিক বা গৌণ স্পার্মাটোসাইট ও উওসাইট থেকে যথাক্রমে ৪টি স্পার্মাটিড ও ১টি ডিম্বাণু উৎপন্ন হয়। স্পার্মাটিড স্পার্মিওজেনেসিস প্রক্রিয়ায় শুক্রাণুতে পরিণত হয়। (আরও বিস্তারিত এখানে)

নিষেক (Fertilization):
যে প্রক্রিয়ায় হ্যাপ্লয়েড সংখ্যক (n) ক্রোমোজোমবিশিষ্ট ডিম্বাণু ও শুক্রাণু একীভূত হয়ে ডিপ্লয়েড সংখ্যক (2n) ক্রোমোজোমবিশিষ্ট একক কোষ জাইগোট (Zygote) সৃষ্টি হয় তাকে নিষেক বলে। এর ফলে উৎপন্ন জাইগোটে ডিপ্লয়েড সংখ্যক তথা দুই সেট ক্রোমোজোম থাকে যার এক সেট আসে শুক্রাণু থেকে অন্য সেট আসে ডিম্বাণু থেকে।

নিষেক প্রক্রিয়া যখন প্রাণীদেহের বাইরে ঘটে তখন তাকে বহিঃনিষেক (External Fertilization) আর যখন প্রাণীদেহের অভ্যন্তরে ঘটে তখন তাকে অন্তঃনিষেক বলে (Internal Fertilization)। কেবলমাত্র জলজ প্রাণী এবং জলজ পরিবেশে প্রজননকারীদের মধ্যেই বহিঃনিষেক দেখা যায় যেমন- মাছ। অন্যদিকে স্থলে বসবাস বা প্রজননকারী প্রাণীদের মধ্য অন্তঃনিষেক পরিলক্ষিত হয়। ডিম্বাণু একবার নিষিক্ত হলে তাকে পুনরায় নিষিক্ত করা যায় না।

সম্ভেদ (Cleavage):
এককোষী জাইগোট থেকে মাইটোসিস কোষ বিভাজন প্রক্রিয়ায় বহুকোষী ব্লাস্টুলা (Blastula) তৈরির প্রক্রিয়াই হচ্ছে সম্ভেদ (Cleavage)। ব্লাসটুলার কোষকে ব্লাস্টোমেয়ার (Blastomere) বলে। ব্লাস্টুলার কোষগুলো (ব্লাস্টোমেয়ার) এর পরিধির দিকে একটি স্তরে সজ্জিত থাকে যাকে ব্লাসটোডার্ম (Blastoderm) বলে। ব্লাস্টুলার কেন্দ্রে কোষহীন তরলপূর্ণ গহ্বরকে ব্লাসটোসিল (Blastocoel) বলে। ব্লাসটোডার্ম (Blastoderm)

এককোষী জাইগোট থেকে বহুকোষী ব্লাস্টুলা উৎপন্ন হলেও উভয়ের আকার একই থাকে। অর্থাৎ জাইগোট থেকে মাইটোসিস কোষ বিভাজনের মাধ্যমে ব্লাসটোমেয়ার উৎপন্ন হবার সময় প্রতি বিভাজনে এর আকার ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর হতে থাকে যার ফলে এ পর্যায়ে ভ্রূণে কোষে সংখ্যা বাড়লেও আকারের কোন পরিবর্তন হয় না।

গ্যাস্ট্রুলেশন (Gastrulation):
এই প্রক্রিয়ায় ব্লাস্টুলার পরিধির একটি অঞ্চল ক্রমান্বয়ে ব্লাসটোসিলের ভেতরে প্রবেশের ফলে প্রথমে দুই স্তর এবং পরবর্তীতে তিন স্তর বিশিষ্ট গ্যাস্ট্রুলা (Gastrula) উৎপন্ন হয়। ফলে ব্লাসটোসিলের অবলুপ্তি ঘটে এবং গ্যাস্ট্রুলার মাঝে আর্কেন্টেরন (Archenteron) নামক একটি গহ্বরের আবির্ভাব হয় যা ব্লাস্টোপোর (Blastopore) নামক ছিদ্রের মাধ্যমে বাইরে উন্মুক্ত হয়।

গ্যাস্ট্রুলার কোষীয় স্তরগুলি জার্মিনাল বা ভ্রূণীয় স্তর (Germinal layers) নামে পরিচিত। বাহিরের স্তরকে এক্টোডার্ম (Ectoderm), ভেতরের স্তরকে এন্ডোডার্ম (Endoderm) এবং মাঝের স্তরকে মেসোডার্ম (Mesoderm) বলে। আর্কেন্টেরন বা এর অংশবিশেষ পরবর্তীতে পৌস্টিকনালীর গহ্বর তৈরি করে। অন্যদিকে ব্লাস্টোপোর সিলেন্টেরাটায় (Coelenterata) মুখছিদ্রে, প্রোটোস্টোমিয়াতে (Protostomia) দ্বিধা বিভক্ত হয়ে একাংশ মুখছিদ্র ও অন্যান্য অংশ পায়ুছিদ্রে এবং ডিওটেরস্টোমিয়াতে (Deuterostomia) পায়ুছিদ্রে পরিণত হয়।

অঙ্গসৃষ্টি (Organogenesis):
ভ্রূণীয় স্তরের কোষগুলি পর্যায়ক্রমে একাধিক কোষগুচ্ছে পরিণত হয় যাকে অঙ্গের অঙ্কুর বা অঙ্গকুঁড়ি (Rudiment) বলে। একেকটি কোষগুচ্ছ বা অঙ্গকুঁড়ি সুনির্দিষ্ট অঙ্গ বা অঙ্গাংশ তৈরি করে। অঙ্গসৃষ্টি পর্যায় শেষে ভ্রূণটি পূর্ণাঙ্গ প্রাণীর বা শুকের (যদি শুক বা লার্ভা দশা উপস্থিত থাকে) সাথে প্রায় সাদৃশ্যপূর্ণ হয়ে ওঠে।

ভ্রূণীয় স্তর থেকে উদ্ভূত অঙ্গ ও অঙ্গাংশ নিম্নরূপ-

  • এক্টোডার্ম (Ectoderm):
    • বহিঃত্বক উদ্ভূত অঙ্গ যেমন- বিভিন্ন এপিডার্মাল গ্রন্থি, চুল, পালক, নথ, নখর, ক্ষুর, চঞ্চু, এপিডার্মাল আঁইশ ও স্কিউট, এন্টলার্স (Antlers) নামক শিং ইত্যাদি
    • চোখ ও অন্তঃকর্ণ
    • পায়ুর আবরণী
    • দাঁতের এনামেল ও মুখগহ্বর
    • স্নায়ুতন্ত্র
    • কিছু পেশী
  • মেসোডার্ম (Mesoderm):
    • বেশীরভাগ পেশী
    • যোজক কলা
    • ডার্মাল আঁইশ ও স্কিউট (যেমন- মাছের আঁইশ ও স্কিউট), শিং (এন্টলার্স শিং ব্যতীত) ও দাঁতের ডেন্টিন
    • কঙ্কালতন্ত্র
    • রক্তসংবহনতন্ত্র
    • রেচন ও জননতন্ত্রে অধিকাংশ
    • সিলোমিক এপিথেলিয়াম
    • পৌষ্টিকনালির বহিঃস্তর
  • এন্ডোডার্ম (Endoderm):
    • পৌষ্টিকনালির আবরণী
    • বিভিন্ন অঙ্গের এপিথেলীয় অংশ যথা- শ্বসনতন্ত্র, থাইরয়েড ও থাইমাস গ্রন্থি, যকৃত ও অগ্নাশয়
    • কখনো কখনো মধ্যকর্ণের আবরণ ও রেচন-প্রজননতন্ত্রে কিছু অংশ

বৃদ্ধি ও বিভেদন (Growth and Differentiation):
ভ্রূণ বৃদ্ধিলাভ করে পূর্ণাঙ্গ প্রাণীর অনুরূপ আকৃতি ধারণ করে এবং বেশীরভাগ অঙ্গের শারীরবৃত্তীয় কাজ সম্পন্ন করতে সক্ষম হয়।

মরফোজেনেটিক প্রক্রিয়া (Morphogenetic processes):
লার্ভাদশা পরবর্তী এমনকি পূর্ণাঙ্গদশায় অনেক প্রাণীতে বেশকিছু মরফোজেনেটিক প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয় যা পরিস্ফুটনের সর্বশেষ পর্যায় হিসেবে বিবেচিত হয়। যেমন- রূপান্তর, পুনরুৎপত্তি, অযৌন জনন ইত্যাদি।

 

তথ্যসূত্র:

 

কুইজে অংশ নিতে লিঙ্কটি অনুসরণ করুন


Visited 5,602 times, 1 visits today | Have any fisheries relevant question?
প্রাণীর পরিস্ফুটন

Visitors' Opinion

রাহাত পারভীন রীপা

প্রাণিবিদ্যায় স্নাতক ও স্নাতকোত্তর। বিস্তারিত

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.