প্রাকৃতিকভাবে উৎপাদিত মৎস্য সম্পদ বিভিন্ন পদ্ধতি এবং নীতিমালা অনুসারে আহরণ করা হয়, যাতে করে বছরের পর বছর জলাশয়গুলো হতে সর্বোচ্চ টেকসই উৎপাদন (Maximum Sustainable Yield) পাওয়া সম্ভব হয়। কিন্তু বর্তমানে বিভিন্ন প্রাকৃতিক এবং মানব সৃষ্ট কারণে এদেশের জলাশয় গুলো হারাচ্ছে তার স্বরূপ, উৎপাদন কমছে, ধ্বংস হচ্ছে জীববৈচিত্র্য আর বিনষ্ট হচ্ছে প্রাকৃতিক ভারসাম্য। উপরন্ত রয়েছে বিভিন্ন অবৈধ পদ্ধতি এবং উপকরণের মাধ্যমে নির্বিচারে মাছ শিকার। তেমনি এক পদ্ধতি হলো কাঠা দিয়ে মাছ শিকার। এটি কাটা বা ঝোপ দিয়ে মাছ শিকার নামেরও পরিচিত। জলাশয়ের একটি নির্দিষ্ট স্থানকে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য মাছ বসবাসের বিশেষ উপযোগী করে গড়ে তোলা হয় (অনেক সময় খাবারও সরবরাহ করা হয়) যার গঠন কাঠামো অনেকটা মৎস্য অভয়াশ্রমের সাথে তুলনীয়। প্রতিকুল সময়ে মাছ আবাসের জন্য বিশেষভাবে তৈরী এ স্থানগুলোকে বেছে নেয়। ফলে এ স্থানে মাছের ঘনত্ব বেড়ে যায়। অতঃপর নিদিষ্ট সময় পরপর বিভিন্ন পদ্ধতি ব্যবহার করে এই মাছ সম্পূর্ণ আহরণ করা হয়। সম্প্রতিক কালে উত্তরাঞ্চলের অন্যতম জেলা শহর নওগাঁর প্রাণকেন্দ্র দিয়ে বয়ে যাওয়া যমুনার শাখা নদীতে (স্থানীয়ভাবে যা ‘ছোট যমুনানদী’ নামে পরিচিত)অসংখ্য ছোট বড় কাঠা তৈরী করা হয়েছে। আপাত দৃষ্টিতে এগুলো ‘মৎস্য অভয়াশ্রম মনে হলেও এগুলো মৎস্য আহরণের ক্ষতিকর এক পদ্ধতি।
শীতের শুরুতে যখন নদীর পানি ধীরে ধীরে কমতে থাকে তখন নদীর গভীরতম অংশে গড়ে তোলা হয় এই কাঠা। বিভিন্ন সহজলভ্য উপকরণ যেমনঃ বাঁশ, দড়ি, বানা, কচুরীপানা প্রভৃতি ব্যবহার করে নদীর নির্ধারিত জায়গায় তৈরী করা হয় কাঠার ক্ষেত্র। এর ব্যাপ্তিকাল চার থেকে পাঁচ মাস। শীত মৌসুমে নদীর পানি কমতে থাকার কারণে মাছের আবাসস্থল ক্রমেই সংকুচিত হয়ে আসে। এই প্রতিকূল পরিস্থিতিতে মাছ আবাসের জন্য কাঠার ক্ষেত্রগুলোকে বেছে নেয়। তাছাড়া কৃত্রিমভাবে তৈরী কাঠা গুলো মাছ বসবাসের জন্য বিশেষ ভাবে উপযোগী করে গড়ে তোলা হয়। ফলে কাঠা গুলোতে বিভিন্ন প্রজাতির ও আকারের মাছের সমাগম বৃদ্ধি পায়। প্রকৃতিতে সাধারণত এক বছরের মাছ পরের বছর বড় আকারের প্রজননক্ষম মা-বাবা মাছে পরিনত হয় এবং প্রজননে অংশ নেয়। কিন্তু এই পদ্ধতিতে মাছ শিকারের ফলে এই মাছগুলো প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে প্রজননে অংশ নেয়ার পূর্বেই শিকারে পরিনত হয়। সাধারণত ফাল্গুন বা চৈত্র মাসের শেষের দিকে যখন পানি আরও কমে যায়, তখন কাঠা মালিক বিভিন্ন প্রকার মৎস্য উপকরণ (বেড় বা কারেন্ট জাল) দ্বারা মাছ ধরে। কোন কোন ক্ষেত্রে কাঠা সম্পূর্ণ শুকিয়ে ছোট-বড় সকল মাছ সমূলে আরহণ করা হয়। ফলে ভবিষ্যতে নদীর মাৎস্য উৎপাদনশীলতা বজায় রাখার জন্য কোন প্রজননক্ষম মা-বাবা মাছ আর অবশিষ্ট থাকে না। ফলে মাছের উৎপাদন হ্রাস পাওয়ার সাথে সাথে মৎস্য প্রজাতি বৈচিত্র্য ব্যাপক ভাবে হ্রাস পাচ্ছে।
এমনিভাবে কাঠা দিয়ে মাছ শিকার করার কারণে সম্প্রতিক কালে নদীতে মাছের উৎপাদন উল্লেখযোগ্য হারে কমে গিয়েছে। নদীতে এখন মাছ নেই বললেই চলে। যা আছে তার বড় অংশ হচ্ছে বর্ষা মৌসুমে প্লাবনের পানিতে অভ্যন্তরীন জলাশয় হতে ভেসে আসা মাছ। নদীর এই মৎস্য সঙ্কটের কারণে স্থানীয় জনসাধারন যেমন তদের প্রোটিনের চাহিদা পূরণের জন্য মাছ গ্রহন করতে পারছে না তেমনি করে বহু জেলে হারিয়েছে তাদের জীবিকা। নদী তীরবর্তী মানুষের সাথে কথা বলে জানা যায়, এই ছোট যমুনা নদীতে কাঠা দিয়ে মাছ শিকার এখন রীতি হয়ে দাড়িয়েছে। স্থানীয় প্রভাবশালী মহল যার যে জায়গাটা সুবিধাজনক মনে হয়, সে সেই জায়গাটি শীতের শুরুতে ঘিরে ফেলে কাঠা তৈরীর জন্য। ধারাবাহিকভাবে এই প্রক্রিয়া বছরের পর বছর চলে আসছে। যদিও সরকারীভাবে মুক্ত জলাশয়ে একটি নিদিষ্ট মাত্রায় মাছ শিকার অনুমোদিত তথাপি অনেক প্রভাবশালী স্বার্থান্বেষী মহলের মাত্রাতিরিক্ত মাছ শিকারের ফলে ছোট যমুনার মত দেশের বিভিন্ন মুক্ত জলাশয়ের মৎস্য সম্পদ ও মাছের বৈচিত্র্য হুমকীর মুখে।
তাই কাঠা দিয়ে মাছ শিকার বন্ধে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের এখনই পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। নিম্নে কিছু সুপারিশ তুলে ধরা হলো-
- মৎস্য অধিদপ্তরের কর্তৃক জরিপের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করা- কোথায়, কোন কোন জলাশয়ে কাঠা দিয়ে মাছ শিকার হচ্ছে এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহন করা।
- মৎস্য আইনের আধুনিকায়ন এবং যথাযথ প্রয়োগ সুনিশ্চিতকরণ।
- অধিকতর সম্প্রসারণ কর্মসূচীর মাধ্যমে কাঠা দিয়ে মাছ শিকার এর ক্ষতির মাত্রা জনসাধারণকে অবহিত করা এবং সচেতনতা সৃষ্টি করা।
- মুক্ত জলাশয়ে কাঠা দিয়ে মাছ শিকার সম্পূর্ণরুপে বন্ধ করার ব্যবস্থা নেয়া।
উপরোক্ত আলোচনা থেকে বলা যায় যে দ্রুত উপরে বর্ণিত পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে মুক্ত জলাশয়গুলোতে জীব তথা মৎস্য বৈচিত্র্য ও মাছের উৎপাদন হ্রাস পাওয়ার হাত থেকে রক্ষা করা সম্ভব, নতুবা এর ক্ষতিকর প্রভাব আমাদেরকে অদূর ভবিষ্যতে ভোগ করতে হবে।
Visited 753 times, 1 visits today | Have any fisheries relevant question?