জাদুঘর ও মৎস্য জাদুঘরঃ
ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য অতীত ঐতিহ্য সংরক্ষন করে রাখার উদ্দেশ্যে বিশ্বের বড় বড় শহরে প্রথম জাদুঘর প্রতিষ্ঠিত হয়ে থাকলেও শেষ পর্যন্ত তা আর শুধু সংরক্ষণের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে প্রদর্শন, শিক্ষা, গবেষণা এমন কি বিনোদনের একটি স্থানে পরিনত হয়েছে। বলা হয়ে থাকে জাদুঘর হল একটি ভবন বা প্রতিষ্ঠান যা সংগৃহীত কৃত্রিমভাবে সৃষ্ট বস্তুর একটি সংগ্রহশালা (wikipedia, 2010). আবার জাদুঘর হচ্ছে সমাজ এবং এর উন্নয়নের জন্য সেবাদানকারী একটি প্রতিষ্ঠান (ICOM, 2010). আই. ও. সি. এম. (১৯৭৪) এর দশম সাধারন সভায় গৃহীত সংজ্ঞা অনুযায়ী, মিউজিয়াম বা জাদুঘর হল সমাজের সেবা ও উন্নয়নের জন্য অলাভজনক একটি স্থায়ী প্রতিষ্ঠান যা জনগনের জন্য উন্মুক্ত এবং এখানে জনগনের শিক্ষা-দীক্ষা ও বিনোদনের উদ্দেশ্যে মানুষ ও তাঁর পারিপার্শ্বিক বস্তুগত নিদর্শনাবলি সংগ্রহ, সংরক্ষন, গবেষনা, প্রকাশনা ও প্রদর্শন করা হয়ে থাকে (বাংলাপিডিয়া, ২০০৩)। তাই বলা হয়ে থাকে জাদুঘর জনসাধারণনের জ্ঞান অর্জনের পথ উন্মুক্ত করে দেয়।
অন্যদিকে মৎস্য জাদুঘর বলতে এমন একটি স্থানকে বুঝায় যেখানে মাছ জীবন্ত অথবা মৃত (ফরমালিন বা অ্যালকোহলে সংরক্ষিত, ষ্টাফকৃত) অবস্থায় সংরক্ষণ করার পাশাপাশি প্রদর্শন, জ্ঞানার্জন আর গবেষণার চাহিদা পূরণ করে থাকে। এমনকি তা বিশেষত জীবন্ত মৎস্য জাদুঘর এসবের পাশাপাশি বিনোদনের চাহিদাও পূরণ করে অসংখ্য পর্যটক আকৃষ্ট করতে সক্ষম।
জাদুঘরের প্রকারভেদঃ
পৃথিবীতে বিভিন্ন ধরনের আর বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কিত জাদুঘর রয়েছে। যেমন-চারুকলা, ফলিত কলা, শিল্প, প্রত্নবিদ্যা, নৃতত্ত্ব, ইতিহাস, সংস্কৃতি বিষয়ক ইতিহাস, মিলিটারী ইতিহাস, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, শিশুদের জাদুঘর, প্রকৃতির ইতিহাস, মুদ্রা ও পদক সংক্রান্ত, উদ্ভিদ ও প্রাণী উদ্যান এবং ডাকটিকিট সংগ্রহ ইত্যাদি। এ জাদুঘরগুলোর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হল আধুনিক কলা, স্থানীয় ইতিহাস এবং কৃষি বা ভূ-তত্ত্ব বিষয়ক জাদুঘর ইত্যাদি। এই জাদুঘরগুলো ছাড়াও উন্নত বিশ্বে প্রাণী ও উদ্ভিদ উদ্যানকেও জীবন্ত জাদুঘর হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। যেমন: বার্লিন প্রাণী উদ্যান, লন্ডন চিড়িয়াখানা, ফিলাডেলফিয়া চিড়িয়াখানা, ব্রুকলিন উদ্ভিদ উদ্যান ইত্যাদি।
বাংলাদেশের যত জাদুঘরঃ
পৃথিবীর অন্যান্য দেশ ও শহরের মত বাংলাদেশের বিভিন্ন শহর বা স্থানে বিভিন্ন ধরনের জাদুঘর রয়েছে যার মধ্যে ঢাকাতেই রয়েছে সবচেয়ে বেশী। যথাঃ
- বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর
- লোক ঐতিহ্য জাদুঘর
- বাংলা একাডেমী জাদুঘর
- লালবাগ ফোর্ট জাদুঘর
- বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জাদুঘর
- পোষ্টাল জাদুঘর
- জয়নুল আবেদীন শিশু চিত্রশালা জাদুঘর
- বাংলাদেশ ভূ-তত্ত্ব জরিপ জাদুঘর
- সিরামিক এন্ড হ্যান্ডিক্রাফট জাদুঘর
- শিশু জাদুঘর
- ঢাকা নগর জাদুঘর
- মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর
- বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান জাদুঘর
- পুলিশ বিজ্ঞান জাদুঘর ইত্যাদি
এছাড়াও সারা দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে আরও কিছু জাদুঘর যেমন-
- চলনবিল জাদুঘর (গুরুদাসপুর, নাটোর)
- বরেন্দ্র জাদুঘর (রাজশাহী)
- বরেন্দ্র একাডেমী কালেক্টরস (রাজশাহী)
- শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালা (রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়)
- জেলা পরিষদ জাদুঘর (বগুড়া)
- প্রত্নতাত্ত্বিক জাদুঘর (মহাস্থানগড়, বগুড়া)
- জাতিতাত্ত্বিক জাদুঘর (চট্টগ্রাম)
- বন গবেষনা ইন্সটিটিউট জাদুঘর (চট্টগ্রাম)
- চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় জাদুঘর (চট্টগ্রাম)
- জিয়া স্মৃতি জাদুঘর জাদুঘর (চট্টগ্রাম)
- রামমালা জাদুঘর (কুমিল্লা)
- উপজাতীয় সাংস্কৃতিক ইন্সটিটিউট জাদুঘর (রাঙামাটি)
- হাছন রাজা জাদুঘর (সুনামগঞ্জ)
- বাংলাদেশ লোকশিল্প জাদুঘর (সোনারগাঁ)
- উপজাতীয় সাংস্কৃতিক একাডেমী (বিরিছিরি, ময়মনসিংহ)
- লালন জাদুঘর (সেউরিয়া, কুষ্টিয়া)
- রবীন্দ্র কুঠিবাড়ি স্মৃতি জাদুঘর (শিলাইদহ, কুষ্টিয়া)
- রবীন্দ্র কাচারিবাড়ি জাদুঘর (শাহজাদপুর, পাবনা)
- রবীন্দ্র কাচারিবাড়ি জাদুঘর (পতিসর, নঁওগা)
- কুষ্টিয়া জাদুঘর (কুষ্টিয়া)
- প্রত্নতাত্ত্বিক জাদুঘর (পাহাড়পুর)
- প্রত্নতাত্ত্বিক জাদুঘর (ময়নামতি)
- দিনাজপুর জাদুঘর (দিনাজপুর)
- ফরিদপুর জাদুঘর (ফরিদপুর)
- রংপুর জাদুঘর (রংপুর)
- কিশোরগঞ্জ জাদুঘর (কিশোরগঞ্জ)
- ময়মনসিংহ জাদুঘর (ময়মনসিংহ)
- জয়নুল আবেদীন সংগ্রহশালা জাদুঘর (ময়মনসিংহ)
(তথ্যসূত্র: বাংলাপিডিয়া, ২০০৩)
বাংলাদেশের যত মৎস্য জাদুঘরঃ
বাংলাদেশে বেশ কিছু মৎস্য জাদুঘর রয়েছে। যেমন
- ফিশ মিউজিয়াম এন্ড বায়োডাইভার্সিটি সেন্টার (এফএমবিসি)
- বাংলাদেশের চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও চাঁদপুরে রয়েছে মৎস্য প্রক্রিয়াজাতকরণ জাদুঘর
- বাংলাদেশের যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিশারীজে উচ্চ শিক্ষার সুযোগ রয়েছে (যেমনঃ ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ মেরিন ফিশারীজ একাডেমী ইত্যাদি) সেসবের ফিশারীজ বিষয়ক বিভাগে ছোট বা বড় পরিসরের মৎস্য জাদুঘর রয়েছে।
- ঢাকায় অবস্থিত মিরপুর চিড়িয়াখানায় একটি মৎস্য জাদুঘর আছে যেখানে অ্যাকুয়ারিয়ামে দেশি বিদেশী বাহারী মাছের পাশাপাশি ফরমালিনে সংরক্ষণ করে রাখা মাছও দেখতে পাওয়া যায়।
- বাংলাদেশের যেসব বিশ্ববিদ্যালয় আর বড় বড় কলেজ সমূহে প্রাণিবিদ্যা বিভাগ আছে (যেমন- বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, জাহাঙ্গীরনগর ইত্যাদি আর কলেজ সমূহের মধ্যে রাজশাহী, দিনাজপুর ইত্যাদি) সেখানেও ছোট বড় পরিসরে রয়েছে প্রাণী জাদুঘর রয়েছে আর এইসব জাদুঘরে প্রাণী হিসেবে মাছ একটা বড় স্থান পূরণ করে থাকে।
মৎস্য জাদুঘরের গুরুত্বঃ
- মৎস্য জাদুঘর থেকে শিক্ষার্থী, গবেষকসহ সকল দর্শনার্থীরা সহজেই একটি স্থান খেকেই বিভিন্ন দেশ ও অঞ্চলের মৎস্য প্রজাতি সম্পর্কে জানতে পারে।
- বিলুপ্ত প্রায় ও সংকটাপন্ন মৎস্য প্রজাতি সম্পর্কে জনগণকে জানানোয় পাশাপাশি এগুলো সংরক্ষণের জন্য সচেতনতা বাড়ানো সম্ভব।
- বিলুপ্ত, বিলুপ্ত প্রায় ও সংকটাপন্ন মৎস্য প্রজাতির নমুনা পরবর্তীতে গবেষণার জন্য সংরক্ষন করে রাখা সম্ভব হয়।
- ফরমালিন ও অ্যালকোহল দিয়ে বা ষ্ট্যাফ তৈরির মাধ্যমে মৃত মাছ সংরক্ষন করে প্রদর্শনের ব্যবস্থা করা ছাড়াও বড় বড় অ্যাকুরিয়ামে জীবিত মাছ সংরক্ষন ও প্রদর্শন করার মাধ্যমে জ্ঞানার্জনের পাশাপাশি বিনোদনের ব্যবস্থা করে মাছ সম্পর্কে বাস্তব জ্ঞানার্জন করা সম্ভব।
- পৃথিবীর অনেক দেশে (যেমন- সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড ইত্যাদি) জীবন্ত জাদুঘর হিসেবে অ্যাকুরিয়ামকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে যা তাদের পর্যটন খাতকে সমৃদ্ধ করেছে ।
বিশ্ব জাদুঘর দিবসঃ
১৯৭৭ সাল থেকে সারা বিশ্বে জাদুঘর দিবস পালন করা হয়ে থাকে। ১৯৭৭ সালের ১৭ই মে আন্তর্জাতিক মিউজিয়াম কমিটির ১২তম সম্মেলনের ঘোষনাপত্র অনুযায়ী ১৮ই মে বিশ্ব মিউজিয়াম দিবস হিসেবে পালন করা হয় (ICOM,2010)।
তথ্যসুত্রঃ
- বাংলাপিডিয়া, ২০০৩। বাংলাদেশ জাতীয় জ্ঞান কোষ, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি, ৫ ওল্ড সেক্রেটারিয়েট রোড, নিমতলী, ঢাকা-১০০০, খন্ড ৪, পৃষ্ঠা ১৪-১৭।
- Wikipedia, 2010. Webpage: http://en.wikipedia.org/wiki/Museum.
- ICOM (International Council of Museums), 2010. Webpage: http://icom.museum/imd.html.
Visited 977 times, 1 visits today | Have any fisheries relevant question?