দেশীয় মাছের প্রাকৃতিক প্রজননক্ষেত্র ধ্বংস, মা-বাবা মাছ মাত্রাতিরিক্ত নিধন, শিশু বা পোনা মাছ পরবর্তীতে মা/বাবা মাছে পরিনত হবার সুযোগ না পাওয়া ইত্যাদি নানাবিধ কারণে আজ হুমকির মুখে মাছে প্রাকৃতিক প্রজনন।
বন্য নিয়ন্ত্রণ ও রাস্তাঘাট উন্নয়নের নামে যত্রতত্র অপরিকল্পিতভাবে বাঁধ নির্মাণের ফলে দেশীয় মাছের প্রাকৃতিক প্রজননক্ষেত্র ধ্বংসের শেষ প্রান্তে এসে পৌঁছেছে। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হবার লক্ষে কেবলমাত্র চাষাবাদকে গুরুত্ব দেয়ায় চাষের জমি বাড়ানোর লক্ষ্যে উঁচু-নীচু সকল ধরণের জমিকে উচ্চফলনশীল ধান চাষের আওতায় নিয়ে আসতে যেয়ে নির্মাণ করা হচ্ছে অপরিকল্পিত বাঁধ যা না পারছে নিশ্চিতভাবে বন্যা মুক্ত করতে না পারছে প্রাকৃতিক পরিবেশকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচাতে।
অন্যদিকে প্রয়োজনীয় ব্রীজের ব্যবস্থা না রেখেই নির্মাণ করা হয়েছে এবং হচ্ছে রাস্তা যা এক নদী থেকে অন্য নদীতে বা মাছের আবাসস্থল থেকে প্রজননক্ষেত্রে যাতায়াতের মাঝে বড় ধরণের বাঁধার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। উন্নয়নের নামে এসব করা হয়েছে কিন্তু মৎস্য সম্পদের ভবিষ্যতের কথা বিবেচনা করা হয়নি। দেশে যে চারটি ফিশ ফ্রেন্ডলি স্ট্রাকচার তৈরি করা হয়েছে তা মৎস্য বৈচিত্র্য বৃদ্ধিতে কতটা ভূমিকা রাখছে সে পরিসংখ্যানও আমাদের হাতে নেই।
ধারণা করা হয় বন্যা নিয়ন্ত্রণের নামে অপরিকল্পিত বাঁধ নির্মাণের সাথে নদী মরে যাওয়ার একটি সম্পর্ক রয়েছে। উত্তরাঞ্চলসহ দেশের বেশিরভাগ নদীতে আজ পানির অভাব দেখতে পাওয়া যায় যার পেছনে রয়েছে এই সব বাঁধের প্রভাব। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ব-দ্বীপ এই বাংলাদেশের ভূ-গঠন প্রক্রিয়া এখন এ চলমান বলেই বিজ্ঞানীরা মত দেন। প্রতিবছর উজান থেকে বন্যার পানির সাথে বিপুল পরিমাণ পলি কণা এদেশে আসে যা বাঁধ নির্মাণের আগে নদীর দুকূল ছাপিয়ে প্লাবনভূমিতে গিয়ে জমা হতো। এতে জমির উর্বরতাশক্তি যেমন বাড়তো তেমনই বাড়ত জমির উচ্চতা। বাঁধ নির্মাণের ফলে এই প্রক্রিয়াটি বন্ধ হয়ে যায় ফলে সেই পলি জমা হতে থাকে নদীতে। জমা হতে হতে অধিকাংশ নদীর নাব্যতা আজ আর নেই বললেই চলে। ড্রেজিং করে এর স্থায়ী সমাধান হবে বলে মনে হয়নি যদিও ড্রেজিং এর সিদ্ধান্তই বাস্তবায়ন হতে যাচ্ছে।
এর সাথে রয়েছে মা-বাবা ও পোনা মাছের অবাধ নিধন। প্রজনন ঋতুতে মা মাছ এবং নয় ইঞ্চির ছোট আকারের মাছ ধরা নিষিদ্ধ থাকলেও তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হচ্ছে না। মাত্রারিক্ত মাছ নিধনের জন্য দায়ী জাল (যেমন ছোট ফাসের জাল যা কারেন্ট জাল নামে পরিচিত) ও পদ্ধতি (যেমন নদীতে আড়াআড়িভাবে বানা, পাটা বা বাঁধ নির্মাণ) নির্মূল করা সম্ভব না হওয়ায় একদিকে যেমন ধ্বংস হয়েছে মৎস্য জীববৈচিত্র্য অন্যদিকে কমেছে মাছের পরিমাণ।
গত ২০ মে ২০১০ তারিখের প্রথম আলোর বিশাল বাংলায় প্রকাশিত কল্যাণ প্রসূনের “হাকালুকি হাওরে মাছের প্রজনন হুমকিতে” শিরোনামের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়- অবাধে পোনা ও মা মাছ নিধনের কারণে মৌলভীবাজারে অবস্থিত দেশের বৃহত্তম হাওর হাকালুকিতে মাছের প্রজনন হুমকির মুখে পড়েছে। মৎস্য বিভাগ সূত্র জানায়, ফেব্রুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত মাছের প্রজনন মৌসুমে নয় ইঞ্চির (২৩ সেন্টিমিটার) কম আকারের মাছ ধরা নিষিদ্ধ। এ সময় বোয়াল, পাবদা, ঘাঘট, আইড়, শোল, গজার, পাবদা, মলাসহ বিভিন্ন জাতের মাছ হাওরের ভাসান পানিতে ডিম ছাড়ে। সূত্র জানায়, প্রতিবছর বর্ষার শুরুতে হাওরের ভাসান পানিতে পোনা ও মা মাছ নিধনের তৎপরতা বেড়ে যায়। গভীর রাত থেকে ভোর পর্যন্ত নিষিদ্ধ কারেন্ট, কাপড়ি ও বেড়জাল টেনে অবাধে এসব মাছ ধরা হয়। অবাধে মাছ নিধনের কারণে হাকালুকিতে মাছের প্রজনন হুমকিতে পড়েছে। হাওরের ৩৫-৩৭ জাতের মাছ ইতিমধ্যে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। তবে প্রায়ই অভিযান চালিয়ে নিষিদ্ধ জাল আটক করা হচ্ছে।’ পোনা ও মা মাছ নিধনের বিষয়টি উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে।
তথ্যসূত্রঃ
কল্যাণ প্রসূন, হাকালুকি হাওরে মাছের প্রজনন হুমকিতে, বিশাল বাংলা, প্রথম আলো, ২০ মে ২০১০।
Visited 368 times, 1 visits today | Have any fisheries relevant question?