জলাশয়ে বিষ প্রয়োগে মাছ শিকারের ঘটনা দিন দিন বেড়েই চলেছে। এর ফলে মাছের সাথে সাথে অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ জলজ প্রাণী মারা যেয়ে একদিকে যেমন পরিবেশের উপর পড়ছে বিরূপ প্রভাব অন্যদিকে বিষ প্রয়োগে শিকার করা মাছ খেয়ে মানুষসহ অন্যান্য প্রাণী স্বাস্থ্যগতভাবে মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়ছে। পত্রপত্রিকায় প্রতিনিয়ত এজাতীয় খবর প্রকাশিত হলেও তা অবস্থার কোন উন্নতি হচ্ছে বলে মনে হয় না। গত কয়েক মাসে প্রকাশিত দেশের দৈনিক পত্রিকা পর্যবেক্ষণ করলেই এর সত্যতা বেড়িয়ে আসে। আর আমরা জানি বাস্তবে যা ঘটে তার খুব কম অংশই পত্রিকায় আসে। তারপরও এই ভয়াবহ চিত্র আপনাদের সামনে উপস্থাপনের জন্য সেইসব প্রকাশিত খবরের উল্লেখযোগ্য অংশ নিচে দেয়া হল-
১৫ আগষ্ট ২০১০ তারিখের প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত “সুন্দরবনের খাল-নদীতে কীটনাশক প্রয়োগে মাছ শিকার” শিরোনামের প্রতিবেদনে বলা হয়- সুন্দরবনের বিভিন্ন খাল ও নদ-নদীতে বিষ প্রয়োগ করে অবাধে মাছ শিকার করা হচ্ছে। এতে পরিবেশ ও মৎস্য সম্পদ বিপন্ন হয়ে পড়েছে। কম পরিশ্রমে অধিক মুনাফা লাভের আশায় তাঁরা বিভিন্ন কীটনাশক সঙ্গে নিয়ে যান। জোয়ার আসার কিছু আগে ওই কীটনাশক চিঁড়া, ভাত বা অন্য কিছুর সঙ্গে মিশিয়ে নদ-নদী ও খালের পানিতে ছিটিয়ে দেয়। এতে একপর্যায়ে ওই এলাকায় থাকা বিভিন্ন প্রজাতির মাছ মরে ভেসে ওঠে। পরে ওই মাছ বিভিন্ন বাজারে সরবরাহ করা হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও ওয়াইল্ড লাইফ ট্রাস্ট বাংলাদেশের প্রধান নির্বাহী আনোয়ার-উল ইসলাম প্রথম আলোকে জানান, কীটনাশক প্রয়োগের ফলে পানির মধ্যে থাকা বিভিন্ন প্রজাতির মাছ, পোনা ও অন্যান্য জলজ প্রাণী নির্বিচারে মারা পড়ছে। এতে মাছের প্রজনন-প্রক্রিয়া ব্যাহত হচ্ছে। এ ছাড়া বিষ মেশানো পানি পান করে সুন্দরবনের বাঘ, হরিণসহ বিভিন্ন প্রাণী বিভিন্ন জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। সাম্প্রতিককালে বাঘের লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা এর অন্যতম প্রমাণ। তিনি আরও জানান, অধিক মুনাফার আশায় জেলে নামধারী একটি চক্র দিনের পর দিন এই অমার্জনীয় অপরাধ করে যাচ্ছে। বন্য প্রাণী ও পরিবেশের জন্য এটা চরম হুমকি। বন বিভাগের উচিত আইনের সঠিক প্রয়োগ, সার্বক্ষণিক মনিটরিং এবং জনসচেতনতা সৃষ্টি করে এ ধরনের অপতৎপরতা রোধ করা।
বিষ প্রয়োগে মাছ ধরার ঘটনায় চলতি বছরে এ পর্যন্ত ১০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এর মধ্যে চারজন ধরা পড়ে ৫ আগস্ট। এসব ঘটনায় চারটি মামলা করা হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, বন বিভাগের একশ্রেণীর কর্মকর্তা উৎকোচ নিয়ে মৎস্যদস্যুদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছেন না।
প্রথম আলো ঐ দিনের “বিষ ঢেলে মাছ শিকার জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি” শিরোনামের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়-লক্ষ্মীপুরের রায়পুরের অনেক স্থানে জেলেরা এখন পুকুর ও জলাশয়ে বিষ ঢেলে মাছ ধরছে। উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা মো. মফিজুল আলম জানান, বিষ দিয়ে শিকার করা মাছ মানব স্বাস্থ্যের জন্য হুমকিস্বরূপ। বিষক্রিয়ার ফলে মানবদেহ নানা ধরনের জটিল রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। উপজেলা মত্স্য কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) বেলায়েত হোসেন জানান, বিষ দিয়ে মাছ শিকার করলে মাছসহ অন্যান্য জলজ প্রাণী ধ্বংস হওয়ার পাশাপাশি পরিবেশ দূষণের ঘটনা ঘটে।
পরের দিনের প্রথম আলোর “আত্মবিনাশী এই অপকর্ম এখনই বন্ধ করুনঃ মাছ শিকারে কীটনাশক” শিরোনামের সম্পাদকীয়তে বলা হয়- বিষ প্রয়োগের ফলে শুধু মাছই মরে না, নির্বিচারে মারা পড়ে সব জলজ জীব। সেখানকার প্রাকৃতিক পরিবেশে মারাত্মক দূষণ ঘটে। ফলে শুধু জলজ জীব ও অণুজীবগুলো নয়, ডাঙার প্রাণী তথা সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্যও মারাত্মক হুমকির মুখে পড়ে। আর বিষ প্রয়োগের ফলে মরা মাছ মানবস্বাস্থ্যের জন্য কতটা ক্ষতিকর হতে পারে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। মানুষ এতটা আত্মঘাতী হতে পারে কী করে, তা ভেবে বিস্মিত হতে হয়।
২৩ আগষ্ট ২০১০ তারিখের দৈনিক আজাদী পত্রিকার “শঙ্খ নদীতে বিষ ঢেলে মাছ শিকার ।। মরা মাছ ধরতে শত শত মানুষের ভিড় দুষ্কৃতকারীদের তান্ডবে বিলুপ্ত হচ্ছে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ ” শিরোনামের সচিত্র প্রতিবেদন থেকে জানা যায়- সাতকানিয়া উপজেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত শঙ্খ নদীতে বিষ দিয়ে মাছ শিকার করেছে দুষ্কৃতকারীরা। গত ১০ ডিসেম্বর রাতে এই বিষ প্রয়োগের ঘটন ঘটে। সরেজমিন দেখা গেছে, পার্বত্য জেলা বান্দরবান থেকে শুরু হয়ে সাতকানিয়া, চন্দনাইশ, বাঁশখালী ও আনোয়ারা উপজেলার উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া শঙ্খ নদীর পানিতে বিষ ঢেলে দেওয়া হয়। এসময় দেখা যায় ছোট-বড় অসংখ্য চিংড়ি সহ বিভিন্ন প্রজাতির অনেক মৃত মাছ ভেসে যাচ্ছে পানিতে। শত শত মানুষ হাত জাল, ঠেলা জাল, চালুনি, মশারীসহ মাছ ধরার বিভিন্ন উপকরণ নিয়ে মাছ ধরছে। প্রতিবছর শীত মৌসুমে নদীর পানি কমে গেলে এক শ্রেণীর লোক নদীতে বিষ প্রয়োগ করে মাছ শিকার করে। তারা জানান, বিষ প্রয়োগের ফলে নদীতে ছোট ছোট খাবার অনুপযোগী অনেক মাছ মারা যায়। এছাড়াও বিষ প্রয়োগ করে মাছ শিকারের ফলে শঙ্খ নদীর মাছ দিন দিন কমে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে অনেক প্রজাতির মাছ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এক শ্রেণীর জেলে এক সাথে অধিক মাছের লোভে নদীতে বিষ প্রয়োগ করে মাছ শিকার করে।
০৬ আগষ্ট ২০১০ তারিখের আমার দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত “সুন্দরবনের নদী ও খালে বিষপ্রয়োগে মাছ শিকার : পরিবেশ ও জনজীবন হুমকির মুখে” শিরোনামের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়- সুন্দরবনের অভ্যন্তরে নদী ও খালে কীটনাশক (বিষ) প্রয়োগে মাছ শিকারের মহোত্সব চলছে। মাছ শিকারের এ তত্পরতা অব্যাহত থাকায় সুন্দরবনের মত্স্য সম্পদ মারাত্মক হুমকির মুখে পড়েছে। মাছের উত্পাদন ও প্রজননের চলতি ভরা মৌসুমকে ঘিরে সংঘবদ্ধ বিষ প্রয়োগকারী দুর্বৃত্ত চক্রের ব্যাপক তত্পরতা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে। বন বিভাগের সূত্রমতে, ২১০ প্রজাতির সাদা মাছ, ২৬ প্রজাতির চিংড়ি, ১৩ প্রজাতির কাকড়া, ১ প্রজাতির লবস্টার এবং ৪২ প্রজাতির মালাস্কা রয়েছে। সুন্দরবনের এ মত্স্য সম্পদের ওপর নির্ভরশীল বন সংলগ্ন এলাকার প্রায় ৫০ হাজার জেলে পরিবার। হাজারও জেলে পরিবারের জীবন-জীবিকার অবলম্বন সুন্দরবনের মত্স্য সম্পদ এখন সংঘবদ্ধ চক্রের করাল গ্রাসে ধ্বংস হচ্ছে। জেলে নামের সংঘবদ্ধ দুর্বৃত্তচক্র দীর্ঘদিন ধরে অভয়ারণ্যের বিভিন্ন নদী ও খালে কীটনাশক (বিষ) প্রয়োগ করে পরিবেশ-বিধ্বংসী তত্পরতা চালিয়ে যাচ্ছে।
১২ মার্চ ২০১০ তারিখের বিডিনিউজ২৪ ডট কমের “বিষ দিয়ে মাছ ধরার সময় আটক ৩” শিরোনামের প্রতিবেদন থেকে জানা যায় সুন্দরবনের খালে বিষ দিয়ে মাছ শিকারের সময় বনকর্মীরা তিন ব্যক্তিকে আটক করেছে। তাদের বিরুদ্ধে বন আইনের ২৬ (১) ধারায় মামলা হয়েছে বলে জানিয়েছেন বন কর্মকর্তা মিহির কুমার দো। আটককৃতরা বন বিভাগের পাশ ছাড়াই বনে প্রবেশ করে কীটনাশক প্রয়োগ করে জোংড়া খাল থেকে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ শিকার করছিল। জোংড়া ক্যাম্পের বনকর্মীরা সেখানে উপস্থিত হয়ে চার পাঁচ কেজি শিকার করা মাছসহ তাদের আটক করে। আটককৃতদের শনিবার আদালতে পাঠানো হবে বলে বন কর্মকর্তা জানান।
২১ নভেম্বর ২০০৯ তারিখের জনকন্ঠে “ভয়ঙ্কর কয়েকটি চক্র জল-জঙ্গলে দাবড়িয়ে বেড়াচ্ছে” শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়- সুন্দরবনের বিভিন্ন খাল ও নদ-নদীতে বিষ প্রয়োগ করে একশ্রেণীর মৎস্য দস্যু অবাধে নানা প্রজাতির মাছ শিকার করছে। বিষ এতটাই বিষাক্ত যে নদী-খালের যে কোন অংশে ঢেলে দিলে ১০ মিনিটের মধ্যে মাছ মরে ভেসে ওঠে। এসব জেলে কম পরিশ্রমে অতি মুনাফার আশায় বনে প্রবেশের সময় তাদের নৌকায় লুকিয়ে ডায়াজিনন, রিপকর্ড, ফাইটার, মার্শাল, ওস্তাদ ও ক্যারাটজাতীয় কীটনাশক নিয়ে যায়। পরে জোয়ার হওয়ার কিছু আগে ওই কীটনাশক চিড়া, ভাত বা অন্য কিছুর সঙ্গে নদী ও খালের পানি ছিটিয়ে দেয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই ওই এলাকায় থাকা বিভিন্ন প্রজাতির মাছ বিষের তীব্রতায় নিস্তেজ হয়ে পানিতে ভেসে ওঠে। পরে বিষ প্রয়োগকৃত এসব মাছ লোকালয় বা বিভিন্ন বাজারে বিক্রির জন্য সরবরাহ করা হয়ে থাকে। পূর্ব সুন্দরবনের চাঁদপাই ও শরণখোলা রেঞ্জেই দিনের পর দিন এভাবে মাছ শিকার চলছে। তবে চাঁদপাই রেঞ্জে মৎস্য দস্যুদের অপতৎপরতা তুলনামূলক বেশি। এ রেঞ্জের জোংড়া, ঢাংমারী, বৌদ্ধমারী, জয়মনী, কাটাখালী, জিউধরা, নন্দবালা, ঘাগরামারী, হারবাড়িয়া, শুয়ারমারা, হরিণটানা, নন্দবালা, আন্ধার মানিক, মরা পশুর, ঝাঁপসি, লাউডোব ও সংলগ্ন নলিয়ান রেঞ্জের কালাবগী, ঝনঝনিয়া, হলদিখালী, টেংরামারী, ভদ্রা, কোরামারীসহ বনের আশপাশ এলাকার বিভিন্ন খাল ও নদী এলাকায় এখন অবাধে বিষ প্রয়োগে মাছ নিধন করা হচ্ছে। এতে করে একদিকে যেমন বনের গহীনে থাকা বিভিন্ন প্রজাতির মাছ ও মাছের পোনা ধ্বংস হচ্ছে অন্যদিকে বিষ প্রয়োগে শিকার করা মাছ খেয়ে মানুষ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। এ ছাড়া বিষ প্রয়োগকৃত পানি পান করে বাঘ, হরিণসহ বনের প্রাণীকুল দিন দিন কমতে শুরু করেছে। বন বিভাগ মাঝে মধ্যে অভিযান চালিয়ে বিষ প্রয়োগকারী জেলেদের আটক করলেও পরে টাকার বিনিময়ে তাদের ছেড়ে দিচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
সংবাদের ২৯ অক্টোবর ২০০৯ তারিখের পত্রিকায় প্রকাশিত “সুন্দরবনের নদী-খালে বিষটোপে চিংড়ি শিকারঃ ধ্বংস হচ্ছে রেণু পোনা” শিরোনামের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়- বনের অভ্যন্তরের বিভিন্ন বিষাক্ত ওষুধ ভাতের সঙ্গে মিশিয়ে তা ছিটিয়ে দেয়া হয় খালে। বিষক্রিয়ায় টিকতে না পেরে মাছগুলো এসময় খালের তীরে লাফিয়ে ওঠে। ধ্বংস হয়ে যায় রেণু পোনাগুলো। এভাবেই ধ্বংস হচ্ছে মৎস্য ভাণ্ডার খ্যাত সুন্দরবনের মৎস্য সম্পদ। এছাড়াও জেলেরা ছোট ছোট খালের মুখে জোয়ারের সময় ছোট ফাঁসের জাল পেতে রাখে। ভাটির সময় পানি নেমে গেলে মাছগুলো ওই জালে আটকা পড়ে যায়। বনের বিভিন্ন চরে চরগড়া জাল পেতে রাখে ভরা জোয়ারের সময়। ভাটির সময় একইভাবে মাছ আটকে যায়। এতে ছোট ছোট রেণু পোনাগুলো ধ্বংস হয়ে যায়।
প্রকাশিত খবর থেকে যে চিত্র পাওয়া যায় তা ভয়ঙ্কর এবং আমরা মনে করি দিনে পর দিন এভাবে চলতে দেয়া যায় না। এই মারাত্মক ক্ষতিকর প্রক্রিয়ায় মাছ ধরার ফলে একদিকে যেমন সুন্দরবনের মতো গুরুত্বপূর্ণ মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্রের ক্ষতি হচ্ছে অন্যদিকে রেহাই পাচ্ছে না নদী আর খাল মতো জলাশয় সমূহ। আবার সেই বিষ ক্রিয়ায় আক্রান্ত মাছ খেয়ে মানুষের স্বাস্থ্যগত সমস্যা দেখা দেবার পাশাপাশি বিষাক্ত জলাশয়ের পানি পান করে জীবন হারাচ্ছে জলজ ও স্থলজ বন্যপ্রাণী। তাই এখনই এবিষয়ে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন। শুধু আইন প্রয়োগ করে এর সমাধান যেমন করা সম্ভব নয় তেমন কেবলমাত্র সচেতনতা বাড়িও এর প্রতিকার পাওয়া অসম্ভব। তাই প্রয়োজন আইন প্রয়োগের পাশাপাশি সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে কার্যকর ও টেকসই কৌশল অবলম্বনের।
Visited 1,111 times, 1 visits today | Have any fisheries relevant question?