প্রাকৃতিক জলাশয় থেকে বিভিন্ন ধরণের দেশীয় মাছ ক্রমশঃ কমে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে জীববৈচিত্র্য রক্ষার জন্য মৎস্য বিশেষজ্ঞগণ নানাবিধ উদ্যোগ গ্রহণের পরামর্শ দিয়েছেন। এ পরামর্শগুলির মধ্যে অন্যতম হচ্ছে-
- মৎস্য অভয়াশ্রম স্থাপন
- মুক্ত জলাশয়ে মাছের পোনা অবমুক্ত করা
- প্রজনন মৌসুমে মাছ ধরার নিষিদ্ধ মৌসুম বাস্তবায়ন করা
- ক্ষতিকর জাল ও জালের ফাঁসের আকার নিয়ন্ত্রণ করা
- বিপদাপন্ন প্রজাতির পোনা অবমুক্ত করা
- নদী ও খালের সাথে বিল সমূহের সংযোগ পুনরুদ্ধার করা
- বিল-জলাশয় খনন ও মাছের আবাসস্থল পুনরুদ্ধার
ক্রমসংকোচনশীল বিল-জলাশয় খনন ও মাছের আবাসস্থল পুনরুদ্ধার করার কাজগুলি যেমন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যবহ ঠিক তেমনি বিল নার্সারি স্থাপন মৎস্য জীববৈচিত্র্য রক্ষার জন্য একটি চমৎকার, কার্যকরী ও টেকসই উদ্যোগ। বিল নার্সারির সুবিধাদি হচ্ছে-
- সাধারণত বিলের মত জলাশয়ে মৎস্য অধিদপ্তরের পোনা অবমুক্তি কার্যক্রমের আওতায় পোনা ছাড়া হয়, যা কোটেশন বা ওপেন টেন্ডার প্রক্রিয়ায় করার ফলে কোন কোন সময় কমিটি উচ্চমূল্যে কম পোনা ক্রয় করতে বাধ্য হয় এবং বিল তথা জলাশয়ে পরিমাণ মত পোনা সরবরাহেও নানাবিধ সমস্যা হয়। বিল নার্সারি স্থাপনের মাধ্যমে এ ধরণের অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি যেমন এড়ানো যায় ঠিক তেমনি অধিক পোনা তথা মৎস্য উৎপাদন করা সম্ভব হয়।
- বিল নার্সারি কার্যক্রমে রেণু হতে পোনা প্রতিপালনে মৎস্যজীবীদের দক্ষতা বৃদ্ধি করে, লালিত পোনা মৎস্যজীবীদের নিজেদের বিলে ছাড়া হয় বলে তা রক্ষায় ঐকমত্য সৃষ্টি হয়। ফলে সমাজ ভিত্তিক মৎস্য ব্যবস্থাপনার পথে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবক হিসেবে কাজ করে।
স্থান নির্বাচন ও বিল নার্সারির জন্য পুকুর প্রস্তুতকরণ:
বিলের যে কোন সুবিধাজনক ছায়ামুক্ত ও নিরাপদ স্থানে প্রয়োজনীয় সংস্কার ও মেরামতের মাধ্যমে নার্সারি পুকুর তৈরি করা যায়। বিলে পুকুরের জন্য স্থান নির্বাচনে নিম্ন লিখিত বিষয়াবলী বিবেচনায় আনা প্রয়োজন-
- বিলের যে স্থানে পাড় নির্মাণে তুলনামূলকভাবে কম ব্যয় হবে
- যে স্থান মৎস্যজীবীদের পর্যবেক্ষণে রাখা সহজ হবে
- যেটি বিলের অভয়াশ্রমের নিকটবর্তী হবে
- যেখানে পানির গুণাগুণ ও তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রয়োজন হলে পানি ঢুকানো বা বের করা যাবে
- যে স্থানের তলদেশের কাঁদা-মাটি দিয়ে পাড় বাঁধার পর টেকসই হবে অর্থাৎ সহজে ভেঙ্গে পড়বে না
উল্লেখিত বিবেচনা আলোকে বলা যায় যে ক্ষেত্রে ৩/৪ পাশের পরিবর্তে ২ পাশে পাড় নির্মাণ করলেই চলে এমন উপযুক্ত স্থান বেছে নেয়া অধিক যুক্তিসঙ্গত। নার্সারি পুকুরের পাড় খুব বেশি উঁচু করার প্রয়োজন নেই। বিলে বর্ষার সময় পানি এলে যাতে নার্সারি পুকুরের পাড় প্লাবিত হয়ে লালিত পোনা বের হয়ে যেতে পারে সেদিকে লক্ষ রেখে অথবা স্থানীয় মৎস্যজীবীদের কাছ থেকে তাদের অভিজ্ঞতার আলোকে পাড়ের উচ্চতা নির্ধারণ করতে হবে। আমাদের দেশে হঠাৎ অতিবর্ষণজনিত কারণে বিলে পানি জমা হয়ে নার্সারি পুকুরকে ডুবিয়ে দিতে পারে; নার্সারি পুকুর যাতে ডুবে পোনা আগেই বের হয়ে না যায় সেজন্য আগেই প্রয়োজনীয় জাল/বানা সংগ্রহ করে রাখা এবং আবহাওয়ার গতিবিধি অনুযায়ী তা নার্সারি পুকুরের পাড় বরাবর ভালভাবে স্থাপন করে নিতে হবে। বিল নার্সারি পুকুরে এ ধরনের জালের/বানার ঘেরা কাঁকড়া, সাপের ইত্যাদি ক্ষতিকর (মাছের জন্য) প্রাণী থেকেও রেণু পোনাকে রক্ষা করবে।
চুন ও সার প্রয়োগ:
নার্সারি পুকুরের মাটির পিএইচ, আয়তন ও বাজারে প্রাপ্য চুনের ধরণ অনুসারে নিম্ন বর্ণিত ছক অনুসারে প্রয়োজনীয় পরিমাণে চুন এবং সার (জৈব ও অজৈব) প্রয়োগ করতে হবে।
বিল নার্সারি পুকুর প্রস্তুতের সময় শতাংশ প্রতি প্রয়োগযোগ্য চুনের ধরণ ও মাত্রা (কেজি/শতক)-
পিএইচ | মাটি | পোড়া চুন | কলি চুন | পাথুরে চুন | ডলোমাইট |
৩-৫ | – | ৬ | ৯ | ১২ | ৯-১০ |
৫-৬ | এটেল | ৪ | ৬ | ৮ | ৮-৯ |
৬-৭ | দোআঁশ | ১-২ | ৩ | ৪ | ৩-৪ |
বিল নার্সারি পুকুর প্রস্তুতের সময় শতাংশ প্রতি প্রয়োগকৃত সার ও এর মাত্রা-
জৈব সার | পরিমাণ (কেজি/শতাংশ) | অজৈব সার | পরিমাণ (গ্রাম/শতাংশ) |
গোবর | ৫-৭ | ইউরিয়া | ১০০-১৫০ |
কম্পোস্ট | ৮-১০ | টিএসপি | ৫০-৭৫ |
হাঁস মুরগীর বিষ্ঠা | ৩-৫ | ডিএপি | ৫০-৭৫ |
* জৈব সার যে কোন একটি প্রয়োগ করতে হবে।
* অজৈব সারের মধ্যে ইউরিয়া ও টিএসপি প্রয়োগ করতে হবে। তবে টিএসপির পরিবর্তে যদি ডিএপি ব্যবহার করা যায়, সেক্ষেত্রে ইউরিয়া অর্ধেক হারে প্রয়োগ করতে হবে।
ক্ষতিকর কীট-পতঙ্গ দমন:
সার প্রয়োগ করলে মাছের রেণু পোনার জন্য উপকারী প্রাকৃতিক খাবারের পাশাপাশি ক্ষতিকর কীট-পতঙ্গ জন্ম নিতে পারে। সাধারণত হাঁস পোকা, ড্রাগন ফ্লাই, আংগুলির মত কাটার পিলার ইত্যাদি রেণুর পেট কেটে মেরে ফেলে এবং রেণুর প্রাকৃতিক খাদ্যও খেয়ে ফেলে বলে রেণু পোনা মজুদের অব্যবহিত ২৪ ঘণ্টা পূর্বে অনুমোদিত মাত্রায় কীটনাশক ব্যবহার করতে হবে।
বিল নার্সারি পুকুর প্রস্তুতকালে প্রয়োগযোগ্য কীটনাশক-
কীটনাশক | প্রয়োগ মাত্রা |
ডিপট্যারেক্স | ৬-১২ গ্রাম/শতাংশ/ফুট গভীর পানি |
সুমিথিয়ন | ২-৩ মিলি/শতাংশ/ফুট গভীর পানি |
* প্রয়োজনীয় কীটনাশক ১০ লিটার পানির সাথে ভালভাবে গুলিয়ে নিয়ে সমস্ত পুকুরে সমভাবে ছিটিয়ে বা স্প্রে করে দিতে হবে
* প্রথমে ডিপট্যারেক্স প্রয়োগ করতে হবে। এর ১২ ঘণ্টা পর সুমিথিয়ন প্রয়োগ করতে হবে। এর ২৪ ঘণ্টা পর পোনা ছাড়া যায়।
রেণু মজুদ:
চাষ মৌসুমের প্রাক্কালেই হ্যাচারি হতে ভাল মাণের রেণু এনে মজুদ করতে হবে। হ্যাচারিতে কার্পের রেণু মার্চ-এপ্রিলেই পাওয়া যায়। মজুদকালে রেণুর বয়স ৩-৪ দিন হলে ভাল হয়, এ সময় রেণুর খাদ্য থলি শেষ হয়ে যায় ও প্রয়োগকৃত খাবার খাওয়ানো যায়। রেণুর মজুদ ঘনত্ব মৎস্যচাষি বা মৎস্যজীবীদের দক্ষতা, অভিজ্ঞতা, আর্থিক সামর্থ্য, বিলের উৎপাদনশীলতার প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন রকম হতে পারে। সাধারণত শতাংশ প্রতি তা ৩০-৫০ গ্রামের মধ্যে রাখাই উত্তম। যদিও অনেকেই তার চেয়ে অনেক বেশী মজুদ করতে আগ্রহী। বেশি রেণু মজুদ করলে খাদ্যের প্রতিযোগিতায় সকল পোনা সমভাবে টিকতে না পারায় পোনার আকারে তারতম্য পরিলক্ষিত হয়।
খাদ্য সরবরাহ:
নার্সারি পুকুর খুব বড় হলে রেণু খুব সহজে প্রয়োগকৃত খাবার হাতের মুঠোয় নাও পেতে পারে, সেজন্য আলাদা হাঁপায় রেণু প্রথম ১০-১২ দিন লালন করা যায়। এতে খাবারের অপচয় কম হয় এবং রেণুর বাঁচার হার, দৈহিক বৃদ্ধি, তাপমাত্রা, অক্সিজেন সরবরাহ নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখা সম্ভব হয়। এমনকি পানির গুণাগুণও ভাল রাখা যায়। রেণুকে প্রথম ১০-১২ দিন যে কোন ভাল ব্রান্ডের প্যাকেটজাত প্রি-নার্সারি ফিড মোট মজুদের ৩-৪ গুন হারে ও পরবর্তীতে নার্সারি ফিড ৮-১০% হারে কিম্বা প্যাকেট বা বস্তায় নির্দেশিত পরিমাণে খাওয়ালে হলে ভাল ফল পাওয়া যায়। তবে নিচের টেবিলে বর্ণিত পরিমাণে স্থানীয়ভাবে প্রাপ্য মাছের খাবারের উপাদানের মিশ্রণে খাদ্য তৈরি ও প্রয়োগ করা যেতে পারে।
বিল নার্সারির জন্য প্রয়োগযোগ্য খাদ্য উপাদান –
নমুনা-১ | নমুনা-২ | নমুনা-৩ | ||||
উপাদান | মিশ্রণের হার | গ্রাম/কেজি | মিশ্রণের হার | গ্রাম/কেজি | মিশ্রণের হার | গ্রাম/কেজি |
গমের ভুষি | – | – | – | – | ২০ | ২০০ |
চালের কুড়া | ৫০ | ৫০০ | ৪০ | ৪০০ | ২৫ | ২৫০ |
সরিষার খৈল | ৫০ | ৫০০ | ৩০ | ৩০০ | ২৫ | ২৫০ |
ফিসমিল | – | – | ২০ | ২০০ | ২০ | ২০০ |
আটা | – | – | ১০ | ১০০ | ১০ | ১০০ |
মোট | ১০০ % | ১০০০ গ্রাম | ১০০ % | ১০০০ গ্রাম | ১০০ % | ১০০০ গ্রাম |
নমুনায়ন:
প্রতি মাসে নমুনায়ন করে পোনার সার্বিক অবস্থা সম্বন্ধে ধারণা পাওয়া যায়। নমুনায়নের মাধ্যমে রেণুর বৃদ্ধি পর্যবেক্ষণ, সরবরাহকৃত খাদ্যের পরিমাণ নির্ধারণ, তলার গ্যাস দূরীভূতকরণ ও পানির অক্সিজেন বৃদ্ধি করা যায়। এজন্য ঘন ফাঁসের চটজাল টেনে নমুনায়ন করা ভাল। এতে করে পোনার আঘাতজনিত মৃত্যুঝুঁকি কমে যায়। পোনার প্রজাতি ভিত্তিক প্রতি ১০০ গ্রাম পোনা মেপে ও গণনা করে মোট পোনার সম্বন্ধে সঠিক ধারণা পাওয়া যায়। কমপক্ষে ১০% পোনা নমুনায়নের আওতায় থাকা প্রয়োজন।
পোনা অবমুক্তকরন:
পোনার আকার গড়ে ৮-১০ সেমি হলে তা বিলে মজুদ করা যায়। এ সময়ের মধ্যে বর্ষাকাল চলে আসলে নার্সারি পুকুরের পাড়ে ঘেরা দেয়া জাল উঠিয়ে দিয়ে সহজেই পোনা অবমুক্ত করা যায়। তবে মোট পোনা আহরণ করে, মেপে সামাজিক আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে অবমুক্ত করলে মোট মজুদের পরিমাণ সম্বন্ধে যেমন ধারণা পাওয়া যায় তেমনি এটি সামাজিক বন্ধনকে দৃঢ়তর করে। ফলে পরবর্তী সমাজ ভিত্তিক ব্যবস্থাপনা বেগবান হয়।
এ লেখায় বিল নার্সারি স্থাপনের প্রায়োগিক ও কারিগরি বিষয়াদি নিয়ে আলোচনা করা হল। পরের পর্বে বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলার বিল নার্সারি কার্যক্রমের উপর একটি সচিত্র কেস স্টাডি উপস্থাপন করার ইচ্ছে রইল।
Visited 2,438 times, 1 visits today | Have any fisheries relevant question?