বাঙালী মানেই খাদ্য রসিক। বাঙ্গালী মানেই ভ্রমণ পিয়াসু। বাঙালি বছরে যখনই ছুটির ফাঁদে পা গলিয়ে ফেলে মন তার উড়ু উড়ু করে ওঠে। ব্যাগপত্র গুটিয়ে গুটি গুটি পায়ে বেড়িয়ে পড়ে। কাছে পিঠে যেখানেই যাওয়ার সুযোগ ঘটে বাঙালি পর্যটকদের ভিড়ে সরগরম হয়ে ওঠে সেই স্থান। যাবেন কোথায়! পুরী, গোয়া, নৈনিতাল! না, এবার মৎস্য ভ্রমণ! অবাক হচ্ছেন? হ্যাঁ এমনি এক অভিনব উদ্যোগ গ্রহণ করে সফল হয়েছে পশ্চিমবাংলার হলদিয়া পঞ্চায়েত সমিতি ও হলদিয়া ব্লক প্রশাসন মৎস্য দপ্তর। উদ্যোগটির লক্ষ হচ্ছে মেছো বাঙালির জন্য মাছ ও মাছের চাষ দেখা ও শেখার উদ্দেশ্যে ভ্রমণ। বিস্তারিত বর্ণনার আগে আসুন জেনে নিই মৎস্য পর্যটন কী? এর উদ্দেশ্য কী? এর গুরুত্বই বা কী? একটি মৎস্য ভ্রমণে কী কী বিষয়াদি অন্তর্ভুক্ত থাকে?
মৎস্য পর্যটন কী?
সংক্ষেপে মৎস্য পর্যটন বলতে বোঝায় কোন একটি সুনির্দিষ্ট মৎস্য সম্পদ যেমন কোন সফল মৎস্য খামার সরেজমিনে পরিদর্শনসহ খামার ব্যবস্থাপনার নানান বিষয়াদি হাতেকলমে শেখার উদ্দেশ্যে ভ্রমণ। ভ্রমণটি একদিন ব্যাপী বা একাধিক দিন ব্যাপী হতে পারে যা মূলত অংশগ্রহণকারীর চাহিদার উপর নির্ভর করে নির্দিষ্ট করা হয়। মৎস্য খামার ছাড়াও যে কোন ফিশারীজ হটস্পট পরিদর্শন ও সে স্থানের মাছ ও অন্যান্য মৎস্য সম্পদ সম্পর্কে চাক্ষুষ জ্ঞানার্জনের উদ্দেশ্যে ভ্রমণও মৎস্য পর্যটন হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে। মৎস্য পর্যটন যখন কোন মৎস্য খামারের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে থাকে তখন তাকে মৎস্য খামার পর্যটনও বলা হয়ে থাকে।
মৎস্য খামার পর্যটনের লক্ষ ও উদ্দেশ্য:
- বিজ্ঞানভিত্তিক মাছচাষের নতুন নতুন কৌশল ও প্রযুক্তি সম্পর্কে প্রশিক্ষণ ও পরামর্শ প্রদান।
- মাছ ও মাছচাষকে আরও বেশি সহজবোধ্য ও জনপ্রিয় করে তোলা।
- মৎস্য ক্ষেত্রের ব্যবহারিক বিদ্যা ও পরীক্ষালব্ধ অনুসন্ধানের এক নিবিড় যোগসূত্র রচনা।
- মৎস্য ক্ষেত্রের আধুনিক ব্যাবহারিক দিক গুলি হাতে কলমে শিক্ষণ ও আরও বেশি সম্প্রসারণ।
- শহরবাসীর জন্য মাছ কিভাবে উৎপাদন করা হয় তা সরেজমিনে দেখার সুযোগ ।
- খামারে উৎপাদিত মাছ ক্রয়ের সুবিধা।
- মৎস্য পর্যটনে সুবিধা প্রদানকারী খামারিদের নিজেদের প্রতি আরও বেশি দায়িত্বশীলতা গড়ে তোলা। এবং সেই সাথে তাদের কাজের প্রতি আরও বেশী উৎসাহিত বোধ সৃষ্টি করা।
মৎস্য পর্যটনের গুরুত্ব:
মৎস্য পর্যটনের গুরুত্ব অপরিসীম। এর প্রধান গুরুত্ব হচ্ছে মাছচাষের নানান কৌশল ও নতুন নতুন প্রযুক্তি বিষয়ক গুরুগম্ভীর প্রশিক্ষণকে অংশগ্রহণকারীর নিকট সহজবোধ্য ও আনন্দদায়ক ভাবে উপস্থাপনের সুযোগ সৃষ্টি করা যাতে করে সম্পূর্ণ প্রশিক্ষণটিই অত্যন্ত আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। ঘরোয়া ভাবে অনুষ্ঠিত ক্লাসের পরিবর্তে খামারে ভ্রমণের পাশাপাশি হাতেকলমে মাছ, মাছচাষ ও খামার ব্যবস্থাপনার নানান দিক শেখার এই সুযোগ একদিকে যেমন প্রশিক্ষণকে সহজবোধ্য করে তোলে তেমনই অন্যদিকে তা আনন্দদায়ক ও আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে যা প্রশিক্ষণার্থীদের মাঝে আনন্দের সাথে জ্ঞানার্জনের অনুভূতি দেয়। ফলে গতানুগতিক পদ্ধতির প্রশিক্ষণের তুলনায় এজাতীয় প্রশিক্ষণ অনেক বেশী ফলপ্রসূ হয় যা মৎস্য পর্যটনের প্রধান সফলতা। মৎস্য খামারকে ঘিরে একদিকে যেমন উইক এন্ড ট্যুরিজম গড়ে তোলা সম্ভব তেমনই এ কর্মকাণ্ড ঘিরে খামারাঞ্চলে নতুন নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হওয়াও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
একটি মৎস্য ভ্রমণে অন্তর্ভুক্ত সুবিধাদি:
- মৎস্য পর্যটনের প্রধান ইভেন্ট হচ্ছে মাছ ও মাছচাষ বিষয়ে বাস্তব ধারণা লাভের পাশাপাশি খামার ব্যবস্থাপনার খুঁটিনাটি সম্পর্কে প্রশিক্ষণ গ্রহণ। এর পাশাপাশি প্রশিক্ষণের ক্লান্তি কাটাতে থাকতে পারে নানাবিধ বিনোদন লাভের সুযোগ। যেমন-
- মৎস্য শিকার প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ
- জলাশয়ে নৌভ্রমণ
- খামারের টাটকা মাছে ভোজনের ব্যবস্থা
- জলাশয় সংলগ্ন জেলে পল্লীতে বিশ্রামের সাথে সাথে খুব কাছে থেকে তাদের সংস্কৃতি সম্পর্কে জ্ঞানার্জন ইত্যাদি
এবার দেখে নেয়া যাক একটি মৎস্য ভ্রমণ আয়োজনের কর্মসূচী কেমন হতে পারে যে বিষয়ক একটি নমুনা-চিত্র।
৯:০০ | উদ্বোধনী অধিবেশন ও পরিচিতি সভা |
১০:০০ | খামারে পোনা মজুদ পূর্ববর্তী ব্যবস্থাপনা যেমন- পুকুরের পাড় ও তলদেশ মেরামত, জলজ উদ্ভিদ অপসারণ, চুন ও সার প্রয়োগ, পানির গুণাগুণ পরীক্ষণ ইত্যাদি পর্যবেক্ষণ |
১১:৩০ | চা পানের বিরতি ও নৌভ্রমণ |
১২:০০ | খামারে পোনা মজুদ ও পোনা মজুদ পরবর্তী ব্যবস্থাপনা যেমন- পোনা অবমুক্তি, খাদ্য প্রয়োগ, সার প্রয়োগ, মাছের বৃদ্ধি পরিমাপের উদ্দেশ্যে নমুনায়ন ইত্যাদি পর্যবেক্ষণ |
১:৩০ | দুপুরের আহারের বিরতি ও মাছ শিকার বা জেলে পল্লীতে বিশ্রাম |
২:৩০ | কই/টেংরা/তেলাপিয়া/রুই মাছের ব্রিডিং পর্যবেক্ষণ |
৩:৩০ | কাঁদা কাঁকড়া মোটাতাজাকরণ ও বাজারজাতকরণ পর্যবেক্ষণ অথবা গলদা চিংড়ির চাষ ব্যবস্থাপনা পর্যবেক্ষণ |
৪:৩০ | চা পানের বিরতি ও খামারে মাছ ক্রয় |
৫:০০ | সমাপনী অধিবেশন, অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে সনদ বিতরণ |
কেস স্টাডি:
শুধু বেড়ানো নয়, স্কুল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের এডুকেশনাল এক্সপোজার ভিজিটের জন্য পূর্ব মেদিনীপুর জেলার হলদিয়ায় অবস্থিত ফিশারী ফার্মগুলিকে ইতিমধ্যেই মৎস্য পর্যটনের স্পট হিসেবে ব্যবহার শুরু হয়েছে। মৎস্য পর্যটনের অন্তর্ভুক্ত এই অভিনব উদ্যোগের নাম দেওয়া হয়েছে “Fish farm for a living – training and motivational travel destination for viewing- Haldia” (বাংলায় “ জীবিকা নির্বাহের জন্য মৎস্য খামার – প্রশিক্ষণ ও দেখার জন্য প্রেরণাদায়ী ভ্রমণ গন্তব্য – হলদিয়া”) । মৎস্য ক্ষেত্রের সুসংহত উন্নয়ন ও পরিবেশ বান্ধব মৎস্য ব্যবস্থাপনার উদ্দেশ্যে এমন অভিনব উদ্যোগ আরও কার্যকরী করতে আগ্রহী হলদিয়া ব্লকের বিডিও রাজর্ষি নাথ, সভাপতি খুকুমণি সাহু ও মৎস্য সম্প্রসারণ আধিকারিক সুমন কুমার সাহু প্রমুখ। সারা রাজ্যে এমনকি দেশে এমন অভিনব উদ্যোগ এই প্রথম যা এলাকার মাছ চাষিদের আরও উদ্দীপিত করবে। প্রশিক্ষণ ও দেখার জন্য প্রেরণাদায়ক এই ভ্রমণ এর মাধ্যমে মৎস্য ক্ষেত্রের আধুনিক ব্যাবহারিক দিকগুলি আরও বেশি করে সম্প্রসারণ করার সুযোগ থাকবে তেমনই সরকারী সাহায্য নিয়ে প্রকল্প রূপায়ন করছেন এমন চাষিরা আরও বেশি যত্নবান হবেন ও সেই সাথে নিজেদের কাজে আরও উৎসাহিত হবেন এমনটাই প্রত্যাশা করা হচ্ছে এমন উদ্যোগ থেকে। ইতিমধ্যেই এই প্রকল্প বিষয়ে দারুণ সাড়া পাওয়া গেছে। তারই অংশ হিসেবে রামনগর কলেজের ফিশারী ফার্ম ম্যানেজমেন্ট এর ছাত্র ছাত্রীদের একটি দল ২১ শে এপ্রিল ২০১৭ (শুক্রবার) হলদিয়াতে এরূপ একটি ভ্রমণ কার্যক্রম সম্পূর্ণ করলো। এটিই এদেশে মৎস্য পর্যটনের প্রথম উদাহরণ। ভ্রমণের বিস্তারিত বিবরণ সংক্ষেপে নিচে দেয়া হল-
চল্লিশ জন ছাত্র-ছাত্রী নিয়ে কলেজের অধ্যাপকবৃন্দ এসেছিলেন। ওনারা একটা পুরো দিন হলদিয়া ব্লকের বিভিন্ন সরকারী প্রকল্পের মাছ চাষের ক্ষেত্রগুলিতে গিয়ে সরেজমিনে এই প্রকল্প পরিদর্শন করেন। ব্লক অফিস মৎস্য বিভাগ থেকে এ কার্যক্রমের যাত্রা শুরু হয়।
ভ্রমণ দলকে প্রথমে নিয়ে যাওয়া হয় রাজ্যের মধ্যে দৃষ্টান্তকারী মাছচাষি নারায়ণ বর্মণের ফিশারীতে। মাছচাষ করে যুগান্তকারী সাফল্য অর্জন করেছেন হলদিয়া ব্লকের নারায়ণ বর্মণ। অধিক মৎস্য উৎপাদনের অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে অর্জন করেছেন “মীন মিত্র” পুরস্কার। নারায়ণ বর্মণের বাড়ি পূর্ব মেদিনীপুর জেলার হলদিয়া ব্লকের দ্বারিবেড়িয়া গ্রামে। কয়েক বছরের দীর্ঘ প্রচেষ্টাই তাকে এ সফলতা আনতে সহায়তা করেছে। সফলতা ও খ্যাতির পাশাপাশি ফিরে পেয়েছেন হারিয়ে যাওয়া আর্থিক সচ্ছলতা, সেই সঙ্গে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছেন আরও প্রায় ২০০ মানুষের। এখানে ভ্রমণকারীরা হাতে কলমে জাল টানা, মাছ ধরা প্রভৃতি বিষয়ে সম্যক ধারণা লাভের পাশাপাশি একজন সফল মৎস্যচাষির সংস্পর্শে এসে মৎস্য নির্ভর ভবিষ্যৎ গড়ে তোলায় আরও উৎসাহিত হয় ভ্রমণকারীরা।
এরপর তাদেরকে নিয়ে যাওয়া হয় তপন বর্মণ এনার ফিশারীতে। সেখানে সরপুঁটি, গলদা প্রভৃতি মাছের চাষ পদ্ধতি সম্পর্কে ব্যবহারিক অভিজ্ঞতা অর্জন করে অংশগ্রহণকারীরা। দুপুরে ভ্রমণ দল তপন বর্মণের ফিশারী ফার্মে বনভোজনের আবহে মধ্যাহ্ন ভোজনে অংশ নেয়।
এরপর তাদের নিয়ে যাওয়া হয় চাউলখোলা গ্রামের সুব্রত মাইতির ফিশারীতে। সেখানে কই, মাগুর প্রভৃতি হারিয়ে যাওয়া মাছের কৃত্রিম প্রজনন এর গৃহস্থ হ্যাচারি পরিদর্শন করেন। সেখানে তাদের শিশু মাছের পরিচর্যা ব্রিডিং এর পদ্ধতি বিষয়ে হাতেকলমে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়।
অতঃপর তাদের হলদি নদীর পার্শ্বস্থ ফিশারীতেও নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে ফিশারী পরিদর্শন শেষে হলদি নদীর মনোরম পরিবেশে বেড়ানোর সুযোগ পায় তারা। একই সাথে হলদিয়া রিভার সাইডের পার্কেও সময় কাটান এই ভ্রমণ দল। এসময় হলদিয়া-নয়াচর কো-অপারেটিভ সোসাইটির সাথে ভ্রমণ দল স্বাস্থ্যকর মাছ উৎপাদন বিষয়ক এক আলোচনাসভায় অংশ নেয়। পরিশেষে ব্লক অফিস মৎস্য বিভাগ এর অফিসে ফিরে একদিনের এ কার্যক্রম শেষ হয়।
এক্সপোজার দর্শন এর মাধ্যমে মৎস্য প্রযুক্তির বিকীর্ণটা এক নতুন দিগন্ত আনবে বলে মনে করছে এলাকার মাছচাষি ও ভ্রমণকারী দল। ইতিমধ্যে বিভিন্ন মৎস্য সংশ্লিষ্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও বিশ্ববিদ্যালয় এই বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। অভিনব এই উদ্যোগ আগামীতে মৎস্য খাতে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করলো তা নিশ্চিত করে বলা যায়।
Visited 1,304 times, 1 visits today | Have any fisheries relevant question?