ভূমিকা:
রুইজাতীয় মাছের হ্যাচারির আদর্শ মালিকগণ প্রতিবছর ব্রুড পুকুরের পূর্ণ ব্যবস্থাপনা করে থাকেন। এতে ব্রুড মাছ যথাযথভাবে প্রস্তুত হতে পারে এবং মাছ থেকে পর্যাপ্ত পরিমাণে ডিম উৎপাদন করা সম্ভব হয়। বাংলাদেশে বর্তমানে হ্যাচারিতে ডিসেম্বর থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত রুইজাতীয় মাছের রেণু পোনা উৎপাদন হয়ে থাকে। সেপ্টেম্বরের মাঝ থেকে নভেম্বরের মাঝ পর্যন্ত এই তিন মাস ব্রুড মাছ ও ব্রুড পুকুর ব্যবস্থাপনার কাজ করা হয়ে থাকে। যেসব হ্যাচারির মালিকগণ দ্রুততম সময়ের মধ্যে অর্থাৎ সেপ্টেম্বর-অক্টোবরের মধ্যে ব্রুড মাছ ব্যবস্থাপনার কাজ সম্পন্ন করে থাকেন, সেসব হ্যাচারিতে আগাম রেণু পোনা উৎপাদন ও অধিক মূল্য প্রাপ্তি সম্ভব হয়। ব্রুড মাছ ব্যবস্থাপনা বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো নিয়ে এখানে আলোচনা করা হল।
১। ব্রুড পুকুর ব্যবস্থাপনা:
সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম বা দ্বিতীয় সপ্তাহের মধ্যে হ্যাচারির যে কোন একটি ব্রুড পুকুরের সমস্ত মাছ ধরে অন্য কোন পুকুরে স্থানান্তরিত করতে হবে। খালি হওয়া পুকুরটি সম্ভব হলে সেচ দিয়ে, একান্তই সেচ দেয়া সম্ভব না হলে বারবার জাল টেনে ও অবশেষে রোটেনন বা ফসটক্সিন ব্যবহার করে অপ্রয়োজনীয় মাছ অপসারণ করতে হবে। পরে শতাংশ প্রতি ১ কেজি হারে চুন প্রয়োগ করতে হবে। পুকুর শুকানো হলে চুন প্রয়োগের ২-৩ দিন পরে ২-৩ ফুট পানিতে পুকুর ভর্তি করতে হবে। এসময় পুকুরে শতাংশ প্রতি ১০ কেজি গোবর, ২০০ গ্রাম ইউরিয়া এবং ১০০ গ্রাম টিএসপি সার প্রয়োগ করতে হবে। ২-৩ দিনের মধ্যে পানি সবুজ বর্ণ ধারণ করলে সেখানে ব্রুড মাছ ছাড়ার উপযোগী হবে। ব্রুড মাছ ছাড়ার আগে অবশ্যই দেখে নিতে হবে পুকুরের পানিতে ক্ষতিকর পোকা বা পরজীবী আছে কিনা। থাকলে প্রয়োজন মতো কীটনাশক ব্যবহার করতে হবে।
২। ব্রুডমাছ শোধন, পরিবহণ ও প্রতিস্থাপন:
নতুন ভাবে প্রস্তুতকৃত ব্রুড পুকুরে ব্রুড মাছ ছাড়ার পূর্বে ভালোভাবে দেখে নিতে হবে যে, মাছ কোন পরজীবী বা রোগ-জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত কিনা? এসময় মাছ সাধারণত লার্নিয়া ও আর্গুলাস দ্বারা আক্রান্ত হতে দেখা যায়। আক্রান্ত মাছকে রোগের ধরণ অনুযায়ী হ্যাচারির রিয়ারিং ট্যাংক অথবা পুকুরে রেখে শোধন করে নিতে হবে।
ক) শোধন:
- ব্রুড মাছকে রিয়ারিং ট্যাংকে রেখে সাধারণ লবণ, পটাশিয়াম পার-ম্যাঙ্গানেট বা মিথিলিন ব্লু এর দ্রবণে গোসল করিয়ে শোধন করা যেতে পারে। এসব পদ্ধতি ছাড়াও ব্রুড মাছকে পুকুরে ছেড়েও শোধন করা যেতে পারে। সাধারণত পরিবহণজনিত ক্ষত ও সেখান থেকে পরবর্তীতে ব্যাকটেরিয়া বা/ও ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হবার হাত থেকে মাছকে রৰার জন্য পুকুরে শোধনের ব্যবস্থা নেয়া হয়ে থাকে। সেক্ষেত্রে পুকুরে ব্রুড মাছ মজুদের ২৪ ঘণ্টা পূর্বে বিঘা (৩৩ শতাংশ) প্রতি ৫০ গ্রাম হারে টিমসেন ব্যবহার করে ব্রুড মাছ মজুদ করলে ভালো ফল পাওয়া যায়। এছাড়াও ব্রুড মাছ মজুদের পরে প্রতি শতাংশে ২৫০ গ্রাম হারে সাধারণ লবণ ব্যবহার করলে রোগ-ব্যাধির হাত থেকে মাছকে রক্ষা করা যায়।
খ) ব্রুড মাছ বাছাই ও পরিবহণ:
- ব্রুড মাছ বাছাই ও পরিবহণের কাজটি সকাল বেলায় করাই উত্তম। পরিবহণের সময় মাছ যাতে আঘাতপ্রাপ্ত না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। মাছ পরিবহণের সময় কাপড় বা পলিথিনের ব্যাগে পানিসহ তার মধ্যে মাছ পরিবহন করা নিরাপদ।
গ) ব্রুড প্রতিস্থাপন:
- পূর্বে প্রস্তুতকৃত ব্রুড পুকুরে ব্রুড মাছ পুনরায় মজুদ করার সময় নিম্নোক্ত কাজগুলো করা অত্যন্ত জরুরী-
- আ) পুকুরের খাদ্যস্তর অনুযায়ী মাছ মজুদ করা।
- আ) প্রতি শতকে ১২-১৫ কেজি হারে ব্রুড মাছ মজুদ করা।
- ই) মজুদকৃত ব্রুড মাছের যাবতীয় তথ্য যেমন- সংখ্যা, ওজন, স্ত্রী-পুরুষের অনুপাত, তারিখ ইত্যাদি প্রজাতি ভিত্তিক সংরক্ষণ করা।
- ঈ) পরস্পর খাদ্য প্রতিযোগী ব্রুড মাছ একই পুকুরে অধিক মাত্রায় মজুদ না করা।
- উ) ব্রুড মাছ এক পুকুর বা স্থান হতে অন্য পুকুরে স্থানান্তরের সময় যত্নসহকারে পরিবহন করা, যাতে মাছের দেহে কোন প্রকার আঘাত না লাগে এবং ক্ষতের সৃষ্টি না হয়।
- ঊ) ব্রুড মাছ স্থানান্তরের সময় যথাসম্ভব বড় ও মজবুত কাপড় বা পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার করলে মাছের দেহে আঘাত লাগার সম্ভাবনা কম থাকে।
- ঋ) কার্পিও ও সরপুঁটি/রাজপুঁটির পুরুষ ও স্ত্রী ব্রুড মাছ আলাদা আলাদা পুকুরে মজুদ করা।
- এ) ব্রুড পুকুরে যাতে অক্সিজেনের ঘাটতি না হয় সেজন্য কৃত্রিম ঝর্ণা বা অক্সিজেন ইঞ্জেক্টর ডিভাইস (এআইএন-ওর্য়াল্ডফিশ কর্তৃক উদ্ভাবিত) ব্যবহার করা।
- ঐ) মজুদের সময় অধিক বয়স্ক, রুগ্ন ও দুর্বল মাছ বাদ দিতে হবে এবং যথাযথ ভাবে তা নথিভুক্ত করতে হবে।
- ও) বাতিলকৃত ব্রুড মাছের পরিবর্তে নতুন ব্রুড মজুদ করতে হবে এবং মাছের বয়সসহ যাবতীয় তথ্য নথিভুক্ত করে রাখতে হবে।
৩। ব্রুড মাছের খাদ্য ব্যবস্থাপনা:
ব্রুড মাছের খাদ্য ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত জরুরী একটি বিষয়। ব্রুড মাছকে যথাযথ পুষ্টিকর খাদ্য প্রয়োগ করতে হবে। তবে খেয়াল রাখতে হবে যে, খাদ্য প্রয়োগ যাতে খুব বেশি না হয়ে যায়। অধিক খাদ্য প্রয়োগ করা হলে মাছের দেহে চর্বি জমে ডিম ধারণ ক্ষমতা কমে যায়। আবার উপযুক্ত মাত্রার খাদ্য প্রয়োগ করা না হলেও মাছ পুষ্টিহীনতায় ভোগে এবং ডিমের উৎপাদন কমে যায়। তাই ব্রুড মাছের খাদ্য ব্যবস্থাপনায় খুব সতর্ক থাকতে হবে। সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর মাস পর্যন্ত অর্থাৎ প্রজননোত্তর সময়ে মাছের দেহ ওজনের সর্বোচ্চ ৩-৪% হারে সপ্তাহে ৭ দিন ২৮-৩০% প্রোটিন সম্পন্ন খাদ্য প্রয়োগ করলে বছরে ২-৩ বার ডিম পাওয়া যায়। তবে মাছ ডিম দেয়ার একমাস আগে থেকে খাদ্যে প্রোটিনের মাত্রা ২০-২৪% এবং খাদ্য প্রয়োগ হার ২-৩% হওয়া জরুরী। প্রজনন পূর্ববর্তী সময়ে খাদ্যে প্রোটিনের চেয়ে কার্বোহাইড্রেট বেশি থাকা ভালো। শীতকালে মাছের খাদ্য চাহিদার উপর ভিত্তি করে দেহের ওজনের ০.৫-১.০% হারে খাদ্য প্রয়োগ করা যেতে পারে। খাদ্য দিনে একবার না দিয়ে ২-৩ বারে দেয়াই ভালো; তাতে খাদ্যের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত হয়। যেহেতু একটি ব্রুড পুকুরে উপর, মধ্য এবং নিম্ন এই তিন স্তরের মাছই থাকে তাই খাদ্য প্রয়োগের সময় মোট খাদ্যের ৭৫% ভাসমান এবং ২৫% ডুবন্ত খাদ্য মিশিয়ে খাওয়ালে ভালো ফল পাওয়া যায়। পুকুরের পানিতে প্রাকৃতিক খাদ্য কণার (ফাইটোপ্লাঙ্কটন ও জুপ্লাঙ্কটন) উপস্থিতির উপর ভিত্তি করে নিয়মিত হারে সার প্রয়োগ করতে হবে। তবে শীতকালে সার প্রয়োগ করা যাবে না। গ্রাসকার্প ও থাই সরপুঁটির জন্য নরম ঘাস, টোপাপানা, কলাপাতা, সবজির নরম অংশ ইত্যাদি কুঁচি কুঁচি করে কেটে মাছের দেহের ওজনের শতকরা ২০-২৫ ভাগ দৈনিক খাদ্য প্রয়োগের ৩০মিনিট পূর্বে দেওয়া আবশ্যক।
৪। ব্রুড মাছের শীতকালীন যত্ন:
শীতকালে ব্রুড মাছের ব্যবস্থাপনায় অধিক যত্নশীল হওয়া দরকার, কেননা মাছ শীতল রক্ত বিশিষ্ট প্রাণী হওয়ায় পরিবেশের তাপমাত্রা কমে গেলে মাছের রক্তের তথা দেহের তাপমাত্রাও কমে যায় এবং দেহের মেটাবলিক ক্রিয়াও হ্রাস পায়। ফলে মাছ খাদ্য গ্রহণ কম করে বা করে না। এসময় মাছ সহজেই নানাবিধ রোগে আক্রান্ত হতে পারে। তাই শীতকালে ব্রুড মাছের পুকুরের পরিবেশ ভালো রাখাই সব দিক থেকে মঙ্গলজনক। শীতকালে পুকুরে সার প্রয়োগ করা থেকে বিরত থাকতে হবে। প্রতিমাসে ১-২ বার শতাংশ প্রতি ৫০০ গ্রাম হারে চুন প্রয়োগ করতে হবে। শীতকালে ভোরের দিকে বাতাসে অক্সিজেনের ঘাটতি থাকায় পানিতেও অক্সিজেনের অভাব পরিলক্ষিত হয়। এসময় অক্সিজেনের অভাবে শ্বাসক্রিয়া বন্ধ হয়ে মাছ মারা যেতে পারে। এ সমস্যা থেকে পরিত্রাণের জন্য ভোরবেলা প্রতিদিন ২-৩ ঘণ্টা করে পুকুরে এ্যারেটর বা কৃত্রিম ঝর্ণা ব্যবহার করলে ভালো ফল পাওয়া যায়। এ সময় খাদ্য প্রয়োগ কমিয়ে দিতে হবে। যাতে পুকুরে অতিরিক্ত খাদ্য পচে ক্ষতিকর গ্যাস তৈরি করতে না পারে সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। শীতের প্রকোপের ফলে পুকুরে ২-১টি মাছ মারা যেতে পারে, তাতে বিচলিত না হয়ে মারা যাওয়ার লক্ষণগুলো ভালোভাবে পরীক্ষা করে দেখতে হবে। মরা মাছ পুকুরের পানি থেকে তুলে ফেলতে হবে। সম্ভব হলে মাসে ১-২ বার পুকুরে টিমসেন বা শতাংশ প্রতি ২০০-২৫০ গ্রাম হারে লবণ ব্যবহার করা যেতে পারে। মাছে কোন রোগ-বালাই দেখা দিলে দেরি না করে প্রতিকার করতে হবে বা বিশেষজ্ঞের পরামর্শ মতো ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
৫। হ্যাচারি ব্যবস্থাপনা:
হ্যাচারি ব্যবস্থাপনা বলতে এখানে প্রজনন পূর্ববর্তী হ্যাচারি অবকাঠামোর ব্যবস্থাপনাকে বুঝানো হয়েছে। হ্যাচারিতে মাছের প্রজননকার্য শেষ হয়ে গেলে অক্টোবর-নভেম্বর মাসের মধ্যে পরবর্তী বছরের প্রজনন কর্মের জন্য হ্যাচারিকে যথাযথভাবে প্রস্তুত করে তোলা আবশ্যক। এ লক্ষে হ্যাচারির ওভারহেড ট্যাংক, পানি সরবরাহের লাইন, রিয়ারিং ট্যাংক, বোতলজার ইত্যাদি হ্যাচারির অত্যাবশ্যকীয় জিনিস-পত্র যথাযথভাবে মেরামত করতে হবে। সময় মতো এসব অংশের মেরামতির কাজ সম্পন্ন করতে পারলে পরবর্তী প্রজনন মৌসুমে সমস্যায় পড়তে হবে না। এ সময় সেচযন্ত্র, বৈদ্যুতিক সংযোগ, মোটরসহ যাবতীয় প্রজনন উপকরণ একবার পরীক্ষা করে প্রয়োজনীয় সারাইয়ের কাজ করে নিতে হবে। সার্কুলার ট্যাংক, রিয়ারিং ট্যাংক, ওভারহেড ট্যাংক ও বোতলজারে রং করার কাজটিও এই সময়ে সেরে রাখাই ভালো। সারা বছর কাজের ফলে হ্যাচারি, গুদাম-ঘরসহ অন্যান্য সকল স্থানে যে অগোছালো অবস্থার সৃষ্টি হয় তা এই অবসর সময়ে গুছিয়ে নিয়ে পরবর্তী প্রজনন ঋতুর কাজ আরম্ভ করতে পারলে তা হবে হ্যাচারির জন্য একটি উদ্দীপনা বৃদ্ধিকারক কাজ। হ্যাচারির চারপাশের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার দিকেও নজর দিতে হবে। সর্বোপরি নতুন বছরের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে সে লক্ষে কাজ করার জন্য একটি বার্ষিক পরিকল্পনা এসময় প্রণয়ন করতে পারলে হ্যাচারির কাজ অনেক সহজ হয়ে যায়। হ্যাচারিতে এসময় কাজ কম থাকে তাই বিপণনের বিভিন্ন উদ্যোগ এসময় গ্রহণ করা যেতে পারে।
পরিশেষ:
একটি গোছানো পরিকল্পনা একটি কাজের অর্ধেক সম্পন্ন হওয়ার সমান। এসময় হ্যাচারির যাবতীয় কর্মকাণ্ডের একটি গুছানো পরিকল্পনা করে কাজে নামতে পারলে পূর্ব প্রজনন মৌসুম জুড়ে সমস্ত কাজ সহজে ও সুচারুভাবে সম্পন্ন করা সম্ভব। হ্যাচারিতে উন্নত মানের ব্রুড মাছ থেকে উন্নত মানের পোনা উৎপাদনের মাধ্যমে যে শুধুমাত্র বাণিজ্যিক ভাবে লাভজনক হওয়া যায় তাই নয়, এর ফলে দেশের সার্বিক উন্নয়নেও ভূমিকা পালন করার সুযোগ পাওয়া যায়।
সহায়ক গ্রন্থ:
- ওয়াল্ডফিশ (২০১৩) রুইজাতীয় মাছের হ্যাচারি ব্যবস্থাপনা ম্যানুয়াল, অ্যাকুয়াকালচার ফর ইনকাম এন্ড নিউট্রিশন (এআইএন) প্রকল্প, ওয়াল্ডফিশ-বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়া।
- দাশ বিষ্ণু (১৯৯৭) মাৎস্য ও মাৎস্যসম্পদ ব্যবস্থাপনা (দ্বিতীয় খণ্ড), বাংলা একাডেমী, পৃষ্ঠা ১-৩৬২।
Visited 2,985 times, 1 visits today | Have any fisheries relevant question?