চলন বিলে বউ মাছের দুটি প্রজাতি পাওয়া যায়, যারা দেখতে অনেকটা একই ধরনের হলেও দেহের বাহ্যিক বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে এদেরকে পৃথক করা যায়। এই দুটি প্রজাতির বৈজ্ঞানিক নাম Botia dario এবং Botia lohachata। চলন বিল সংলগ্ন এলাকায় মাছ দুটি বউ মাছ বা রাণী মাছ নামে পরিচিত হলেও দেশের অন্যান্য অনেক স্থানে এটি বেটি, পুতুল, বেতাঙ্গী ইত্যাদি নামে পরিচিত। বউ মাছ দেখতে অত্যন্ত আকর্ষনীয় এবং চ্যাপ্টা ও লম্বাটে দেহবিশিষ্ট। উভয় মাছেরই মুখ আকারে ছোট এবং ৪ জোড়া ক্ষুদ্রাকৃতির স্পর্শী থাকে।

বউ বা রাণী
Botia dario

বউ বা রাণী
Botia lohachata

Botia dario মাছের দেহের রং হলুদ বা হলুদাভাব এবং দেহে বেশ কিছু (সাধারণত ৭টি) উল্লম্ব কালচে রংয়ের দাগ বিদ্যমান। অন্যদিকে Botia lohachata মাছের দেহ বর্ণও হলুদ বা হলদেটে এবং এদের দেহে ইংরেজী “Y” অরের ন্যায় ৪টি কালো দাগ থাকে ও প্রতি ২টি দাগের মধ্যবর্তী অংশে ১টি কালো একক দাগ বিদ্যমান। উভয় মাছেরই আইশ অত্যন্ত ক্ষুদ্রকৃতির যা প্রায় সাধারণ দৃষ্টিতে বোঝাই যায় না এবং এদের পার্শ্বরেখা সম্পূর্ণ। আকারের দিক হতে Botia dario সর্বোচ্চ প্রায় ১৮ সে.মি. হলেও Botia lohachata -র রেকর্ডকৃত সর্বোচ্চ দৈর্ঘ্য ১১ সে.মি. (যা চৌগ্রাম আড়ত হতে ২০০৭ সালে রেকর্ডকৃত)।

বউ মাছ প্রায় সব ধরনের স্বাদুপানির জলাশয় যেমন, খাল-বিল, নদী-নালা, হাওড়-বাওড় ইত্যাদির তলদেশে পরিস্কার পানিতে বসবাস করতে পছন্দ করে। তবে কখনও কখনও ঘোলা পানিতেও এদের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। চলন বিলের প্রায় সকল স্থানে এদের উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেলেও কোথাও খুব বেশী দেখা যায় না। চলন বিল ছাড়াও বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলার (যেমন, রাজশাহী, দিনাজপুর, রংপুর, ময়মনসিংহ, সিলেট, ফরিদপুর, পার্বত্য চট্টগ্রাম প্রভৃতি) জলাশয়ে, বিশেষ করে নদীতে বউ মাছের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। ২০০৭ সালে এক গবেষণায় দেখা গেছে যে, চলন বিল সংলগ্ন বিভিন্ন মাছের আড়ত ও বাজারে খুবই স্বল্পসংখ্যক উপস্থিতির মধ্যে Botia lohachata -র পরিমাণ তুলনামূলকভাবে Botia dario অপেক্ষা বেশী। বউ বা রাণী মাছ সাধারণত মে হতে অক্টোবর মাসের মধ্যবর্তী সময়ে প্রজনন করে থাকে।

বউ মাছ খেতে খুবই সুস্বাদু এবং বাজারে এই মাছসমূহের বেশ চাহিদা রয়েছে। প্রায় সকল শ্রেণীর ক্রেতাই এই মাছ খুবই পছন্দ করে থাকে। অক্টোবরের শেষ থেকে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত বর্ষাকালের শেষে যখন বিলের পানি কমে যেতে থাকে তখন এরা জেলেদের দ্বারা অধিক ধৃত হয় এবং এই সময়ই বাজারে এদের তুলনামূলক বেশী উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়।

মানব খাদ্য ব্যতীত এই দুটি মাছকে একুয়ারিয়ামে রেখেও পালন করা যেতে পারে। আমাদের দেশে সৌখিনভাবে একুয়ারিয়ামে এই মাছ পালন করা না হলেও বহিঃবিশ্বের বিভিন্ন দেশে এদের একুয়ারিয়ামে পালন করা হচ্ছে এবং সেসকল দেশে বাণিজ্যিকভাবে একুয়ারিয়ামে বউ মাছ পালন করা হয়।

আমাদের দেশে একসময় উল্লেখযোগ্য পরিমাণে এই মাছের উপস্থিতি থাকলেও বর্তমান সময়ে বউ বা রাণী মাছের সংখ্যা অনেকাংশে কমে গেছে। বর্তমানে উভয় প্রজাতির বউ মাছই বাংলাদেশের বিপন্ন মৎস্য প্রজাতিসমূহের অন্যতম। মাছ ধরার ধ্বংসাত্মক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে মৎস্য আহরণ; ছোট-বড় আকার বিবেচনা না করে মাছ ধরা; রাস্তা-ঘাট, বসতবাড়ী নির্মানের মাধ্যমে মাছের বাসস্থান ও প্রজননক্ষেত্র ধ্বংস; জলাশয় সম্পূর্ণ শুকিয়ে মাছ ধরা ইত্যাদি কারণে এই মাছের অস্তিত্ব আজ হুমকির সম্মুখীন এবং এ বিষয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের জরুরী কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ না করলে অন্যন্য বেশ কিছু দেশী মাছের প্রজাতির সাথে অতীব সুন্দর বউ বা রাণী মাছও অচিরেই অতীত ইতিহাসে পরিণত হবে।

তথ্যসূত্রঃ
শফি, মো. এবং কুদ্দুস, মি. মু. আ.; ১৯৮২। বাংলাদেশের মাৎস্য সম্পদ। ১ম সংস্করণ। বাংলা একাডেমী, ঢাকা, বাংলাদেশ। মো. পৃ. xii+৪৪৪।

Afroze, S., N. Sultana and M.A. Hossain; 1996. Small Fish as a Source of Nutrition for Our People. In: Small Indigenous Fish Culture in Bangladesh; Edited by Felts, R.A., K. Ahmed and M. Akhteruzzaman; Integrated Food Assisted Development Project Sub Project 2 (IFADEP SP 2), Dhaka, Bangladesh. pp 57-63.

Rahman, A K M; 2005. Freshwater Fishes of Bangladesh, 2nd Edition. Zoological Society of Bangladesh, Department of Zoology, University of Dhaka, Dhaka, Bangladesh, XVIII+394 pp.

Talwar, P.K. and A.G. Jhingran; 1991. Inland Fishes of India and Adjacent Countries. Oxford and IBH Publishing Co. Pvt. Ltd., New Delhi, India. LIV + 1158 pp.

www.fishbase.org


Visited 2,589 times, 1 visits today | Have any fisheries relevant question?
বউ বা রাণী

Visitors' Opinion

শামস মুহাম্মদ গালিব

প্রভাষক, ফিশারীজ বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী, বাংলাদেশ। প্রাক্তন শিক্ষার্থী, ফিশারীজ বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী-৬২০৫, বাংলাদেশ। বিস্তারিত ইমেল: thegalib@gmail.com

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.