বাংলাদেশ মূলত কৃষি নির্ভর। এদেশের ৪৫.১% মানুষ জীবিকার জন্য কৃষির উপর নির্ভরশীল (BBS, 2004)। মৎস্য কৃষিখাতের একটি অন্যতম প্রধান উপখাত যা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে আসছে। দেশের প্রায় ১.২৫ কোটি মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে মৎস্য সেক্টরের বিভিন্ন কার্যক্রমে নিয়োজিত থেকে জীবিকা নির্বাহ করছে (মৎস্য অধিদপ্তর, ২০০৯)। উপকূলীয় অঞ্চলের জনগনের কাছে বাগদা চিংড়ির পোনা আহরণ অর্থ উপার্জনের একটি আকর্ষণীয় মাধ্যম। প্রায় ১৬০,০০০ জনের বেশী জেলে সরাসরি মাছ ধরার কাজে এবং প্রায় ১৮৫,০০০ জন চিংড়ির পোনা আহরণের সাথে জড়িত (মৎস্য অধিদপ্তর, ২০০৭)।

উপকূলীয় এলাকায় চিংড়ি পোনা সংগ্রহকারী শ্রমশক্তির শতকরা ৮০ ভাগই নারী ও শিশু। অন্য এক পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায় যে, বৃহত্তর খুলনা ও বরিশাল অঞ্চলে চিংড়ি পোনা সংগ্রহের কাজে জড়িত শিশুদের মধ্যে ৭০% মেয়ে ও ৩০% ছেলে অন্যদিকে কক্সবাজার ও বৃহত্তর নোয়াখালী জেলায় ৭৮% ছেলে ও ২২% মেয়ে স্থায়ী বা অস্থায়ীভাবে চিংড়ির পোনা সংগ্রহের সাথে জড়িত এরমধ্যে শুধুমাত্র দুবলার চরাঞ্চলেই দশ হাজার শিশু চিংড়ি পোনা সংগ্রহ, মাছধরা ও মাছ প্রক্রিয়াজাতকরণের সাথে এবং দেড় হাজার শিশু বিভিন্ন খাল, বিল ইত্যাদি থেকে শামুক-ঝিনুক সংগ্রহের সাথে জড়িত (Islam and Haque, 2010)।

শুধুমাত্র চিংড়ি পোনা আহরণই নয় বর্তমানে মৎস্য সেক্টরের বিভিন্ন খাতে মহিলারাও উল্লেখযোগ্য ভুমিকা পালন করছে। কিশোরগঞ্জ জেলার কুলিয়ার চর উপজেলার দাসপাড়া গ্রামের ৩০০ টি পরিবারের ৩৫৬ জন মহিলা প্রশিকা নামক একটি এনজিও এর কাছে প্রশিক্ষন নিয়ে গৃহস্থালী কাজের পাশাপাশি শুঁটকি মাছ বিক্রি করে গড়ে প্রতি মাসে ২৫০০-৩০০০ টাকা আয় করছে (মৎস্য অধিদপ্তর, ২০০৯)।

এছাড়াও বিভিন্ন প্রসেসিং কারখানায় কাজ করা ছাড়াও বর্তমানে মহিলারা মাছ চাষেও ব্যাপকভাবে ভুমিকা রাখছে।। নারীরা বাড়ির নিকটবর্তী স্থানে অবস্থিত পুকুর (বিশেষ করে মৌসুমী পুকুর), ধানক্ষেত ও বড় পুকুরে খাঁচায় অনায়াসেই মাছ চাষ করছে। বাংলাদেশের জনসংখ্যার অর্ধেকের বেশী নারী। মোট জনসংখ্যার ৭০.৫ মিলিয়ন হচ্ছে নারী (BBS, 2008)। আর মৎস্য বিষয়ক শ্রমশক্তির শতকরা ৩৬ ভাগ মহিলা (মৎস্য অধিদপ্তর, ১৯৯৫)। দাসপাড়া গ্রামের নারীদের মত দেশের সব নারীরা যদি সচেতন হয়, নিজের অধিকার ও কাজ করার সামর্থ্য সম্পর্কে সজাগ হয় তবে মৎস্য সেক্টরে কাজ করে তারা নিজেরা নিজেদের উন্নয়ন ঘটাতে পারে। অন্যের উপর নির্ভরশীল না হয়ে সমাজ, জাতি ও দেশ উন্নয়নের গুরুত্বপূর্ণ অংশরূপে নিজেদের আত্মপ্রকাশ ঘটাতে পারে। এদেশের জনসংখ্যার একটা বিশাল অংশ নারী তাই নারীর যথাযথ উন্নয়ন না হলে দেশ ও জাতিরও যথার্থ উন্নয়ন সম্ভব নয়।

কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি যে মৎস্যখাতের বিভিন্ন কার্যক্রমে অংশ নেয়া শিশুরা প্রাথমিক শিক্ষাগ্রহণ করার পরিবর্তে জীবনের শুরুতেই এ কাজে জড়িত হয়ে পড়ছে। এর ফলশ্রুতিতে তারা শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। অন্যদিকে শিক্ষার আলো বঞ্চিত শিশুরা একদিন দেশের সম্পদে পরিনত হবার সুযোগ না পেয়ে জাতির জন্য বোঝা হয়ে দেখা দেবে। এতে করে একদিকে যেমন দেশের ভবিষ্যৎ জনগোষ্ঠীর একটা অংশ অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ নিয়ে বড় হবে যা কারও কাম্য হতে পারে না। এ অবস্থার উন্নতির জন্য সরকারী পদক্ষেপ এর পাশাপাশি প্রয়োজন বেসরকারী পদক্ষেপ গ্রহণ এবং একই সাথে গণসচেতনতা বৃদ্ধি। শিশুদের মাঝে সুশিক্ষার আলো ছড়িয়ে তাদের আলোকিত ভবিষ্যত নিশ্চিত করে দেশ ও জাতির জন্য উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ এর রচনায় সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।

তথ্যসুত্র:

  • মৎস্য অধিদপ্তর, ১৯৯৫। মৎস্য সম্পদ উন্নয়নে মহিলাদের ভূমিকা, মৎস্য পক্ষ সংকলন ’৯৫, মৎস্য অধিদপ্তর, ঢাকা। পৃষ্ঠা ৭১-৭৩।
  • মৎস্য অধিদপ্তর, ২০০৭। দেশীয় প্রজাতির মৎস্য সংরক্ষন ও সমপ্রসারন অভিযান, মৎস্য ও পশু সম্পমন্ত্রণালয়, গনপ্রজাতত্রী বাংলাদেশ সরকার। পৃষ্ঠা ৬০।
  • মৎস্য অধিদপ্তর, ২০০৯। জাতীয় মৎস্য সপ্তাহ সংকলন, মৎস্য ও পশু সম্পমন্ত্রণালয়, গনপ্রজাতত্রী বাংলাদেশ সরকার, ঢাকা। পৃষ্ঠা ১৩ ও ৬৬।
  • BBS, 2004. Key Findings of the Poverty Monitoring Survey. Bangladesh Bureau of Statistics, Planning Division, Ministry of Planning, Government of the People’s Republic of Bangladesh.
  • BBS, 2008. Statistical Pocket Book of Bangladesh. Bangladesh Bureau of Statistics, Planning Division, Ministry of Planning, Government of the People’s Republic of Bangladesh.
  • Islam, M. M. and Haque, M. K. I. 2010. Social development and human rights: child labour in aquatic products processing. Bangladesh Fisheries Research Forum, Bangladesh Agricultural Research Council, Dhaka, Bangladesh, p 104.

Visited 701 times, 1 visits today | Have any fisheries relevant question?
মৎস্য খাতে নারী ও শিশুর অংশগ্রহণঃ প্রেক্ষাপট বাংলাদেশ

Visitors' Opinion

সৈয়দা নুসরাত জাহান

গবেষক, ফিশারীজ বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। বিস্তারিত

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.