চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড এলাকায় জড়ো করা ভাঙ্গা জাহাজের সারি (গুগল স্যাটেলাইট ইমেজ)
চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড এলাকায় জড়ো করা ভাঙ্গা জাহাজের সারি (গুগল স্যাটেলাইট ইমেজ)

জাহাজভাঙ্গা কার্যক্রমের ফলশ্রুতিতে চট্টগ্রামের উপকূলীয় অঞ্চলের পরিবেশ, মানুষ, মাছ ও অন্যান্য প্রাণীকুলের ওপর ইতোমধ্যে অনেক নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে, বর্তমানেও পড়ছে এবং ধরে নেয়া যায় ভবিষ্যতে আরো পড়বে। সবকিছু মিলিয়ে তা দিন দিন আরও ভয়াবহ রূপ নেবে তা নিশ্চিত। সবার আগে জেনে নেই বর্তমানে এখানকার পরিবেশের যেসব পরিবর্তন হয়েছে সেগুলো কি? [তথ্যসূত্র-১]

  • সমুদ্রের পানির রং ঘোলাটে, কালো হয়ে গেছে। আগের মতো মাছ পাওয়া যায় না। গত দশ বছরে সীতাকুণ্ডের সমুদ্র উপকূলে মত্স্য আহরণ ৮০ শতাংশের মতো কমেছে। শ্রাবণ-ভাদ্র মাসে পাওয়া যেত প্রচুর রুপালি ইলিশ, যা দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে।
  • এই অঞ্চলগুলো একসময় বিভিন্ন মাছের প্রজননক্ষেত্র ছিল। গভীরতার কারণে এখানে একসময় মাছেরা ডিম পাড়তে আসত। এখন তা আর নেই।
  • সমুদ্রের পানির ওপর যে তেল ও বর্জ্য জমা হয়, তা সূর্যের আলোকে পানির নিচে পৌঁছাতে বাধা দেয়। এতে পানির নিচের উদ্ভিদ-জগতের সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয়। এসব উদ্ভিদ ছোট ছোট মাছ ও খুদে সামুদ্রিক প্রাণীদের খাদ্য সরবরাহ করে। সালোকসংশ্লেষণ বাধা পেলে উদ্ভিদের জন্ম ও বৃদ্ধি বন্ধ হয়ে যায়। এর ফলে ২১ প্রজাতির মাছ বিপন্ন হয়ে পড়েছে।
  • একসময় সমুদ্র উপকূলে বিভিন্ন পাখির দেখা মিলত। সেসব পাখি এখন আর দেখা যায় না।
  • মাছ, জাল, নৌকার ওপর নির্ভর করে চলত জেলেদের যে জীবন সামুদ্রিক মাছের সংকট দেখা দেওয়ায় সেই পৈতৃক পেশা ছেড়ে দিয়ে বাধ্য হয়ে বেছে নিতে হচ্ছে অন্য কোন পেশা।
  • জাহাজগুলো কাটার সময় তেল ট্যাংকারের তলানিতে জমে থাকা বিপুল অপরিশোধিত তেল ও লুব্রিক্যান্ট পানিতে মেশে। বর্জ্যমিশ্রিত তেল সমুদ্রের পানিতে মিশে পানিকে দূষিত করে। জাহাজ ভাঙার ফলে উপকূলীয় এলাকার মাটিতে বিষাক্ত ধাতু ছড়িয়ে পড়ে। তার মধ্যে পারদ রয়েছে শূন্য দশমিক ৫ থেকে শূন্য দশমিক ২৭ পিপিএম, সিসা শূন্য দশমিক ৫ থেকে ২১ দশমিক ৮, ক্রোমিয়াম ২২০, ক্যাডামিয়াম শূন্য দশমিক ৩ থেকে ২ দশমিক ১, ক্যালসিয়াম ৫ দশমিক ২ থেকে ২ দশমিক ১০ এবং ম্যাগনেসিয়াম রয়েছে ৬ দশমিক ৫ থেকে ১ দশমিক ৫৭ পিপিএম।

বর্তমান বাস্তবতাঃ
তথ্যসূত্র-২ অনুসারে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড এলাকার ৭ কিলোমিটার দীর্ঘ উপকূলে চলছে জাহাজভাঙ্গা কার্যক্রম। পরিবেশ অধিদপ্তর গত ডিসেম্বর পর্যন্ত জরিপ চালিয়ে ৭৯টি শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডের অস্তিত্ব পেয়েছে। এরমধ্যে ৬১টি প্রতিষ্ঠানে জাহাজভাঙ্গার কাজ চলছে। ৮টি নতুন ইয়ার্ড হচ্ছে। ৯টি ইয়ার্ডে আপাতত জাহাজভাঙ্গার কাজ বন্ধ আছে এবং একটি ইয়ার্ড সৃষ্টির কাজ প্রাথমিক পর্যায়ে আছে। গত ২০ বছরে জাহাজভাঙার কাজ করার সময় প্রায় ৫০০ লোকের প্রাণহানি ঘটে। আহত হয়েছে আরো ছয় হাজার। এ কাজের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে প্রায় ৪ লাখ শ্রমিক ও পরোক্ষভাবে প্রায় ২ লাখ লোক সম্পৃক্ত। দেশের চাহিদার ৮০ শতাংশ লোহার যোগান আসে এখান থেকে। কিন্তু স্যার মুহম্মদ জাফর ইকবাল তাঁর প্রবন্ধে [তথ্যসূত্র-৩] উল্লেখ করেছেন শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের স্থায়ী কমিটিতে জানান হয়েছে, জাহাজ ভাঙার কাজে মোট শ্রমিকের সংখ্যা মাত্র ১৯ হাজারের মতো (সঠিক সংখ্যা ১৮ হাজার ৮৮৮)। শুধু তা-ই নয়, এই ১৯ হাজারের মাঝে মাত্র সাড়ে তিন হাজার (সঠিক সংখ্যা তিন হাজার ৫৪৩) হচ্ছে স্থায়ী শ্রমিক। অন্য সবাই অস্থায়ী এবং তাদের মাঝে শিশুশ্রমিকও আছে। … পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেখা যায়, শিপ ব্রেকিং খাত হতে দেশের লোহার চাহিদার মাত্র ২৫ হতে ৩০ শতাংশ আসে।

 

মানুষের উপর প্রভাবঃ
এই ধরণের বিষাক্ত জাহাজগুলি ইউরোপে ঠাঁই না পেয়ে চলে আসবে বাংলাদেশে। সস্তায় জাহাজগুলো ভাঙ্গার পর যার যার টাকা দিয়ে, টাকা নিয়ে চলে যাবে। রেখে যাবে বছরের পর বছর ধরে বিষাক্ত কেমিক্যালসের মরণ ব্যাধি। চেরনোবিল পারমানবিক বিষাক্ততার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় এখনো সেখানে বিকলাঙ্গ শিশু আর প্রাণীর জন্ম হয়। আর এখানে জন্ম হবে বিশ্বের অভূতপূর্ব সব রোগব্যাধি আর ভাইরাস!! [৪]। গুজরাট বন্দরের তীরের মাটি উচ্চ ঝুঁকির বিষাক্ত পদার্থে ভরে গেছে। সেখানকার বাতাসে বিপজ্জনক মাত্রায় অ্যামোনিয়া ও ক্লোরোফ্লুরো কার্বন গ্যাস পাওয়া গেছে। প্রতিটি জাহাজ থেকে কমপক্ষে পাঁচ টন করে বিষাক্ত বর্জ্য বের হয়েছে। এই বর্জ্যের সংস্পর্শে থাকায় জাহাজভাঙা শ্রমিকদের মধ্যে প্রতি চারজনের একজন নানা ধরনের ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে পড়েছেন [৫]।

ভবিষ্যত কোন পথে?
কার্বন নিঃসরণ ও দুর্ঘটনার ঝুঁকি কমাতে ২০১২ সালের মধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলো তাদের দুই হাজার ১৭২টি মেয়াদোত্তীর্ণ ও বিষাক্ত জাহাজ বিক্রি করে দেবে। এর বড় অংশের ক্রেতা হতে যাচ্ছেন বাংলাদেশের জাহাজভাঙা-শিল্পের ব্যবসায়ীরা। এই জাহাজগুলোসহ ইইউর সব মেয়াদোত্তীর্ণ জাহাজে সাড়ে পাঁচ মিলিয়ন টন বিষাক্ত বর্জ্য রয়েছে বলে ইইউর প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। যে উপকূলে এই জাহাজের বর্জ্য পরিষ্কার করা হবে, তার মাটি ও পানি মারাত্মকভাবে দূষিত হয়ে পড়বে। বাংলাদেশ বর্তমানে বিশ্বের ৫০ শতাংশ পুরোনো জাহাজ কিনছে। [৫]

আশার কথাঃ
তথ্যসূত্র-২ অনুসারে জাহাজভাঙ্গা কার্যক্রমের জন্য একটি আলাদা এলাকা গঠন ও একটি যুগোপযোগী নীতিমালা প্রণয়ন করা হবে। গত ১৭ মার্চ হাইকোর্টের এক আদেশে বলা হয়েছিল, বৈধ ও বাধ্যতামূলক পরিবেশ সংক্রান্ত ছাড়পত্র ছাড়া শিপ ইয়ার্ডে জাহাজ ভাঙার কোনো কাজ করা যাবে না। সংশ্লিষ্ট তথ্য যথাযথভাবে যাচাই-বাছাই না করা পর্যন্ত পরিবেশবাদী সংগঠন গ্রিন পিসের তালিকাভুক্ত কোনো জাহাজ ভাঙার জন্য বাংলাদেশে না আনার নির্দেশ দেয়। আইন অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট জাহাজের বর্জ্য পরিষ্কার এবং এ ধরনের জাহাজ ভাঙার মতো অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা আছে কিনা, তাও খতিয়ে দেখার নির্দেশ দেয়। বাংলাদেশের সীমানার বাইরেই ক্ষতিকর বর্জ্য পরিষ্কার না করে কোনো জাহাজ যাতে দেশে প্রবেশ করতে না পারে তা নিশ্চিত করতেও সরকারকে নির্দেশ দিয়েছিল উচ্চ আদালত।


View Larger Map

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড এলাকায় জড়ো করা ভাঙ্গা জাহাজের সারির সাম্প্রতিক চিত্র (সৌজন্যে গুগল ম্যাপ)

তথ্যসূত্রঃ


Visited 1,022 times, 1 visits today | Have any fisheries relevant question?
জাহাজভাঙ্গা কার্যক্রমঃ বিপন্ন মানুষ, মাছ আর পরিবেশ

Visitors' Opinion

এ বি এম মহসিন

প্রফেসর, ফিশারীজ বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী-৬২০৫, বাংলাদেশ। বিস্তারিত ...

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.