উত্তরাঞ্চলের অনেক নদীতে আড়াআড়ি বাঁধ (মূলত বাঁশ ও বানা বা জাল ব্যবহার করে এই বাঁধ বা প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা হয়) দিয়ে মাছ ধরা দেখার সুযোগ আমার হয়েছে। ইদানিং পত্রিকায় বড় নদী যেমন পদ্মার বিভিন্ন পয়েন্টে এভাবে মাছ ধরার খবর প্রকাশিত হবার প্রেক্ষিতে নিশ্চিত করে বলা যায় এভাবে মাছ শিকারের পরিমাণ দিন দিন বাড়ছে।

যেমন- গত ১৪ মে ২০১০ তারিখের প্রথম আলোর বিশাল বাংলা পাতায় প্রকাশিত “পদ্মায় বাঁধ দিয়ে মাছ শিকার চলছেই” শিরোনামের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়- পদ্মা নদীর রাজবাড়ী সদর উপজেলার মিজানপুর ইউনিয়নে বেশ কয়েকটি এলাকায় বাঁশের তৈরি বাঁধ দিয়ে অবৈধভাবে মাছ ধরার কাজ চলছে। এ নিয়ে বেশ কয়েকবার কয়েকটি সংবাদপত্রে প্রতিবেদন প্রকাশ করার পরও একটি প্রভাশালী চক্র মাছ ধরছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। জানা গেছে, সদর উপজেলার মিজানপুর ইউনিয়নের চরধুঞ্চি ও চরবেনিনগর এলাকায় বিশাল আকারের দুটি বাঁশের তৈরি বাঁধ আড়াআড়িভাবে দিয়ে পুরো নদী আটকে রেখে মাছ শিকার করা হচ্ছে। বাঁশের সঙ্গে গুটি, বেড় ও ছোট ছোট ফাঁসের জাল পাতার কারণে এতে ছোট-বড় মাছসহ রেণুও আটকে যাচ্ছে। বাঁধের কারণে নদীর গতিপথ পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে এবং নৌচলাচল ব্যাহত হচ্ছে।

গত ১৯ মার্চ ২০১০ তারিখের দৈনিক জনকন্ঠ পত্রিকায় তৌহিদ আক্তার পান্না ও অমিতাভ পাল অপুর “যৌবন হারানো নদীর কান্না থেমে যাচ্ছে প্রমত্তা পদ্মার গর্জন” শিরোনামের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়- ঢাকার দোহারে পদ্মা নদীতে বাঁশ ও জাল দিয়ে বিশেষভাবে তৈরি গাড়া পাতন বাঁধ স্থাপন করে ইলিশ, জাটকা, পোনা মাছসহ বিভিন্ন মাছ শিকার ও চাষ করছে স্থানীয় প্রভাবশালীরা। সম্পূর্ণ অবৈধভাবে দীঘদিন ধরে এ কাজ চলে এলেও বিষয়টি স্থানীয় প্রসাশনের নজরে আসছে না। বাঁধের পাশাপাশি নদীতে নিষিদ্ধ বেড়জাল ব্যবহারের ফলে পদ্মাসহ স্থানীয় অন্যান্য নদী ও খাল-বিল মৎস্য শূন্য হতে চলেছে। উপজেলার নারিশা এলাকায় প্রতি বছরই জেলে পরিচয়ধারী স্থানীয় প্রভাবশালীরা বাঁশ ও জাল দিয়ে বিশেষ বাঁধ নদীর বিরাট এলাকায় আড়াআড়ি পেতে ইলিশ, জাটকাসহ অন্যান্য মাছ, মাছের ডিম ও পোনা শিকার করে। প্রতি বছর এ এলাকায় অন্তত ৪/৫টি এ ধরনের বাঁধ স্থাপন করা হয়। এক একটি বাঁধ তৈরিতে শত শত বাঁশ নদীতে পুঁততে হয়। বিশাল একেকটি বাঁধ নদীর তীর থেকে বিস্তৃত রয়েছে। ১৯৫০ সালের মৎস্য সংরক্ষণ আইনে নদীতে গাড়া পাতন বাঁধ স্থাপন করে মাছ শিকার সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করা আছে। অথচ দীর্ঘদিন ধরে এ এলাকায় এ ধরনের বাঁধ স্থাপন ও কারেন্ট জাল, বেড় জালের মতো নিষিদ্ধ জাল ব্যবহার করে মাছ শিকার করা হচ্ছে। এতে দিন দিন স্থানীয় নদ-নদী ও খাল-বিলে আশঙ্কাজনকভাবে মাছের সঙ্কট দেখা দিচ্ছে। দুরবস্থার মধ্যে পড়েছে শত শত সাধারণ জেলে পরিবার।

গত ১১ জানুয়ারী ২০১০ তারিখের প্রথম আলোর পান্না বালার “পদ্মায় ‘বাঁধ’ দিয়ে মাছ শিকার” শিরোনামের প্রতিবেদন অনুসারে- চরভদ্রাসন উপজেলা দিয়ে প্রবাহিত পদ্মা নদীতে বাঁশ দিয়ে আড়াআড়ি ব্লক বাঁধ দেওয়া হয়েছে। নদীর পশ্চিম পারে রয়েছে উপজেলার গাজীরটেক ইউনিয়নের আলম ফকিরেরডাঙ্গি গ্রাম। নদীর পূর্ব পারে একই উপজেলার চর হরিরামপুর ইউনিয়নের চরশালীপুর গ্রাম। দেড় কিলোমিটারব্যাপী বাঁধটি ওই দুই গ্রামের মধ্যে নদীর মূল প্রবাহে আড়াআড়িভাবে তৈরি করা হয়েছে। বাঁশের সঙ্গে আটকানো জালের নিচে ভারী পাথর বাঁধা। প্রায় ১০০ মিটার পর পর রয়েছে ২০টি ‘রাক্ষুসে জাল’। এমন জাল ইলিশ ধরার ফাঁদ হিসেবে ব্যবহূত হয়। কেবলমাত্র নৌযান চলাচলের জন্য বাঁধের ২৫ ফুট জায়গা খোলা রাখা হয়েছে। সেখানে কর্মরত মত্স্যজীবীরা জানান, প্রতি দুই ঘণ্টা পর পর জালগুলোতে মাছ ধরা পড়েছে কি না, তা দেখা হয়। ইলিশ, পাঙাশ, বোয়ালসহ ছোট ছোট জাটকা—সবই ধরা পড়ছে এ জালে।

দৈনিক কালের কন্ঠে প্রকাশিত “পদ্মার বুকে মাছের ফাঁদ” শিরোনামের প্রদ্যুৎ কুমার সরকার এর প্রতিবেদন থেকে জানা যায়- বিস্তৃত পদ্মা নদীতে বাড়ছে মাছ ধরার অবৈধ বাঁধ। তাও একটি দুটি নয়। রবিবার পর্যন্ত কমপক্ষে অর্ধ শতাধিক অবৈধ বাঁধ স্থাপন করা হয়েছে। প্রতিদিনই বাড়ছে এই অবৈধ বাঁধের সংখ্যা। গত ৭ থেকে ১০ দিনে পানি বৃদ্ধির ফলে এখন মাদারীপুরের শিবচরের পদ্মায় অবৈধ নদী জোড়া আড়াআড়ি বাঁধ দিয়ে পোনা মাছ, ডিমওয়ালা মাছ, জাটকাসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ নিধনের মহোৎসব চলছে। তাই চরাঞ্চলের ফসল হারানো হাজার হাজার হতদরিদ্র কৃষক শেষ ভরসা মাছ ধরা থেকে বঞ্চিত হওয়ার শঙ্কায় হতাশ হয়ে পড়েছেন। মাওয়া-কাওরাকান্দি রুটের মূল চ্যানেলেও দেখা গেছে এ অবৈধ বাঁধ। ফলে নৌযান চলাচলেও বিঘ্ন সৃষ্টি হচ্ছে। কাওরাকান্দি ফেরিঘাটসংলগ্ন পদ্মায়, জনবিচ্ছিন্ন চরজানাজাতের কাওলিপাড়া, চরচান্দ্রা, জলসন, নেপালের হাওর, পোড়াকান্দিরখোল, মীর আলী সরদারকান্দি, বাড়ইকান্দি, চানবেপারিকান্দি, কাঁঠালবাড়ী, মাগুরখণ্ড, মাদবরচর, বন্দখোলা ইউনিয়নের চরাঞ্চলে নদীজুড়ে আড়াআড়ি প্রায় অর্ধশতাধিক বাঁধ দিয়ে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ নির্বিচারে নিধন চলছে। একেকটি বাঁধ ২০০ মিটার থেকে ৬০০ মিটার পর্যন্ত বিস্তৃত। বাঁধগুলোতে অসংখ্য বাঁশ গেড়ে মশারি, ছালা বা কারেন্ট জাল দিয়ে ঘেরা। নিচে মাছ আটকানোর দোয়াইর ও বড়শি। ফলে জাটকা, চিংড়ি, রুই, কাতলা, আইড়, পাঙ্গাস, বোয়ালের মা মাছ ও পোনাসহ বিভিন্ন মাছ আটকা পড়ছে। বাঁধগুলোতে ব্যবহৃত জাল দিয়ে এক ইঞ্চির পোনা মাছ বের হওয়ারও সুযোগ নেই। অথচ সাড়ে চার সেন্টিমিটারের নিচে ফাঁসযুক্ত জাল ব্যবহার ও নদীতে কোনো ধরনের প্রতিবন্ধকতামূলক বাঁধ দেওয়া সম্পূর্ণ নিষেধ। এদিকে চরাঞ্চলে আরো অর্ধ সহস্রাধিক অবৈধ বাঁধ তৈরির প্রস্তুতি চলছে। এই বাঁধে ছোট-বড় সব ধরনের মাছই নির্বিচারে ধরা পড়ে।

গত ১০ মে ২০১০ তারিখের প্রথম আলো পত্রিকার বিশাল বাংলায় “প্রবহমান মুক্তেশ্বরী নদীতে মধ্যে আড়াআড়ি বাঁধঃ মাৎস্যসম্পদ ও পরিবেশের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর” শিরোনামের প্রতিবেদনে বলা হয়- প্রবাহমান মুক্তেশ্বরী নদীটি যশোরের চৌগাছা উপজেলার মজ্জাতের বাঁওড়সংলগ্ন ভৈরব নদ থেকে উৎপত্তি হয়ে মনিরামপুরের ভবদহে গিয়ে টেকা ও শ্রীনদী নামে দুটি শাখায় রূপান্তরিত হয়েছে। এই নদীর ভেকুটিয়া বাজার, বালিয়া ভেকুটিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও শ্মশান ঘাটের নতুন সেতুর একপাশে বাঁশের পাটা দিয়ে এবং বালিয়াঘাটসহ বেশ কয়েকটি জায়গায় মাটি ফেলে নদীর দুই কূল শাসন করে বাঁধ দিয়ে পানি বন্ধ করে রাখা হয়েছে। যার ক্ষতিকারক প্রভাব হিসেবে যশোর সদর উপজেলার ভেকুটিয়া এলাকার চারটি বিলের পানি নিষ্কাশিত হতে পারছে না। ফলে ওই এলাকার অন্তত দেড় হাজার হেক্টর ফসলি জমিতে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। খবরে প্রকাশ জীবন্ত এই নদীটিকে বদ্ধ জলাশয় দেখিয়ে বিভিন্ন মৎস্যজীবী সমিতির নামে ইজারা দেওয়া হয়েছে। এবং নদীর কয়েকটি পয়েন্টে আড়াআড়ি পাটা ও বাঁধ দিয়ে পানি আটকে মাছের চাষ করা হচ্ছে। এভাবে মাছ চাষ করায় একটি মহল সাময়িকভাবে লাভবান হলেও এ জতীয় কার্যক্রম মৎস্যসম্পদ ও পরিবেশের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। এর ফলে একদিকে যেমন মাছ চলাচলে বাধাগ্রস্ত হয়ে প্রাকৃতিক ভাবে বড় হওয়া মাছ ও অন্যান্য জলজ প্রাণী প্রজনন করতে পারছে না পরে এদের সংখ্যা কমে যাচ্ছে অন্যদিকে বিলের পারি নেমে যেতে না পরের সেখানে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়ে ফসল ফলানো সম্ভব হচ্ছে না। তার চেয়ে বড় বিষয় হল এভাবে দীর্ঘদিন চলতে থাকলে এর ফলে প্রাকৃতিক পরিবেশের যে ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে তা ফিরে পাওয়া এক সময় কঠিন হয়ে পড়বে। তাই মাৎস্যসম্পদ ও পরিবেশের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর এজাতীয় আড়াআড়ি বাঁধ অপসারন করে মুক্তেশ্বর নদীর প্রবাহ ফিরিয়ে নিয়ে আসা অত্যন্ত জরুরী।

উল্লেখিত প্রতিবেদন থেকে নদীর গতিপথ পরিবর্তন, নৌ চলাচলে ব্যাঘাত এবং ছোট-বড় মাছসহ নির্বিচারে রেণুপোনা আটকা পড়ার যে তথ্য এসেছে তা অবশ্যই উদ্বেগজনক। এছাড়াও এই পদ্ধতিতে মাছ ধরার মধ্যমে খুব সহজেই নির্বিচারে মাত্রা অতিরিক্ত মাছ ধরা পড়ে যার ফলশ্রুতিতে মাছের ভবিষ্যত প্রজন্ম হয়ে পড়ছে হুমকির মুখে। সাধারণ নদীর বেশিরভাগ মাছ এক বছর পর প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে থাকে। অর্থাৎ এই বছরের মাছ পরের বছরে মা/বাবা মাছে পরিনত হয়। কিন্তু বেশিরভাগ মাছ যদি এভাবে ধরে ফেলা হয় তাহলে মা/বাবা মাছের পরিমাণ এতটাই কমে যাবে যে মাছের জনতায় সদস্য সংখ্যা কমতে কমতে একটা সময় পর নিজ প্রজন্মের ধারা টিকিয়ে রাখার জন্য যে পরিমান মা/বাবা মাছ দরকার তা আর থাকবে না ফলে সেই প্রজাতি হুমকির মুখে পড়বে। বর্তমানে আই.ইউ.সি.এন (২০০০) এর তথ্যানুসারে বাংলাদেশে হুমকির মুখে রয়েছে ৫৪ প্রজাতির মাছ যার মধ্যে ১২ প্রজাতি চরম বিপদাপন্ন আর ২৮ প্রজাতি বিপদাপন্ন হিসেবে চিহ্নিত। এরকম একটি সময়ে এভাবে নদীতে আড়াআড়ি বাঁধ দিয়ে গণ মাছ শিকার মৎস্য বৈচিত্র্যের জন্য ভয়ঙ্কর হুমকি স্বরূপ।

তথ্যসূত্রঃ


Visited 595 times, 1 visits today | Have any fisheries relevant question?
নদীতে আড়াআড়ি বাঁধ দিয়ে মাছ শিকারঃ মৎস্য বৈচিত্র্যের জন্য হুমকি স্বরূপ

Visitors' Opinion

এ বি এম মহসিন

প্রফেসর, ফিশারীজ বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী-৬২০৫, বাংলাদেশ। বিস্তারিত ...

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.