সারিয়াকান্দি ফিসপাসের মূল অবকাঠামোর একাংশ
সারিয়াকান্দি ফিসপাসের মূল অবকাঠামোর একাংশ

ফিসপাস বলতে দুটি জলাশয়ের (যেমন নদী ও নদী, নদী ও হাওর, নদী ও বিল ইত্যাদি) মধ্যে মাছ চলাচলের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিকারী কৃত্রিম বাঁধ বা রাস্তায় স্থাপিত এমন একটি গঠন কাঠামোকে বোঝায় যার মধ্যে দিয়ে সারা বছরব্যাপী নিরাপদে মাছ চলাচল করতে পারে। এটি ফিসপাস ছাড়াও ফিস প্যাসেজ, ফিস ওয়ে, ফিস ফ্রেন্ডলি স্ট্রাকচার (fish friendly structure) ইত্যাদি নামে পরিচিত। নব্বই এর দশকে বাংলাদেশে ফিসপাসের ধারণাটির সূত্রপাত হয়। সারা পৃথিবীতে প্রধানত ছয় ধরণের ফিসপাস দেখতে পাওয়া গেলেও পুল ধরণের ফিসপাস বহুল পরিচিত।

বর্তমানে এদেশে চারটি ফিস রয়েছে। যথা-

  • মৌলভীবাজারের কুশিয়ারা নদী ও কাওয়াদিঘী হাওড়ের মধ্যে ১৯৯৫ সালে স্থাপিত ফিসপাস
  • টাঙ্গাইল জেলায় যমুনা নদীর পূর্বপাড়ে ১৯৯৬ সালে স্থাপিত ফিসপাস
  • চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় অবস্থিত মরিচের ডাঙ্গা ফিসপাস এবং
  • বগুড়া জেলার সারিয়াকান্দি উপজেলায় যমুনা ও বাঙ্গালী নদীর মধ্য স্থাপিত সারিয়াকান্দি ফিসপাস।

এর মধ্যে পুল ও ওয়ার (pool and weir) ধরণের সারিয়াকান্দি ফিসপাসটি গঠন কাঠামোর দিক থেকে সবচেয়ে আধুনিক যা ১৯৯৯ থেকে ২০০১ সালের মধ্যে নির্মান করা হয়।

২০০৬ সালে Journal of Bio-Science এর Volume: 14, পাতা ১৩৩ এ প্রকাশিত “Present Fisheries Status of Sarikandi Fish Pass, Sariakandi, Bogra” শিরোনামের একটি Short Communication (Author:M Mostafizur Rahman Mondol, M Αl-Amin Sarker and M A Hossain) থেকে জানা যায়- সারিয়াকান্দি ফিসপাস নির্মাণের আগে বাঙ্গালী নদীতে ১২ প্রজাতির মাছ পাওয়া যেত আর বর্তমানে অর্থাৎ ফিসপাসটি নির্মাণের পর পাওয়া যায় ২৩ প্রজাতির। এছাড়াও এটি নির্মাণের পর জেলেদের মাছ আহরণের পরিমাণও বাড়ে যার ফলে তাদের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নতি হয়। আরও জানা যায় যে, ফিসপাসের যমুনা প্রান্তে বর্ষার সময় অতিমাত্রায় বালু সঞ্চিত (siltation) হবার কারণে জলাভূমির তলদেশের উচ্চতা বাড়ছে এবং প্রতি বছরই ফিসপাস এলাকার বাস্তুতান্ত্রিক অবস্থার অবক্ষয় (degrade) চলছে। মৎস্য বৈচিত্র্য ও জেলেদের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নতি হলেও বালু সঞ্চিত (siltation) হবার কারণে ফিসপাসটি অকার্যকর হতে শুরু করেছে।

সারিয়াকান্দি ফিসপাসের বাঙ্গালী নদী প্রান্ত
সারিয়াকান্দি ফিসপাসের বাঙ্গালী নদী প্রান্ত

অন্যদিকে গত ২৫ মার্চ ২০১০ তারিখের প্রথম আলোর বিশাল বাংলায় (পাতা-৫) “কাওয়াদীঘিতে ‘ফিসপাস’ প্রকল্প কাজে আসছে না” শিরোনামের প্রতিবেদন থেকে জানা যায় একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার অর্থায়নে ১৯৯৫ সালে ৭৭ লাখ টাকা ব্যয়ে সদর ও রাজনগর উপজেলার কাওয়াদীঘি হাওর এলাকায় ফিসপাস পাইলট প্রকল্প বাস্তবায়ন করে পাউবো যার লক্ষ্য ছিল কুশিয়ারা নদীর সঙ্গে প্রজনন মৌসুমে কাওয়াদীঘির সরাসরি সংযোগ স্বাভাবিক রাখা, যাতে হাওরে মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। কিন্তু মাছের প্রজনন মৌসুমে (বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ) হাওর থেকে ফিসপাস প্রকল্পের তলদেশের উচ্চতা বেশি থাকায় প্রকল্প খাল দিয়ে পানি বের হতে না পারায় হাওরে মাছ ঢুকতে পারে না। আর হাওর পানিতে ভরাট হলে বাইন ও গুতুমজাতীয় কিছু মাছ ওঠে। তখন স্থানীয় মৎস্যশিকারিরা প্রকল্পের খালের মুখে জাল ফেলে সেগুলো ধরে যার ফলশ্রুতিতে প্রকল্পের উদ্দেশ্য পূরণ হচ্ছে না। কুশিয়ারা থেকে কাওয়াদীঘিতে এসে মাছ যাতে ডিম ছাড়তে পারে সেজন্য পরীক্ষামূলকভাবে প্রকল্পটি করা হলেও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে মাছের প্রজনন মৌসুমে প্রয়োজনীয় বৃষ্টিপাত না হওয়ায় প্রকল্পটি এখন কোনো কাজে আসছে না। একদিকে প্রকল্পের তলদেশ উঁচু অন্যদিকে বর্ষাকালে হাওর থেকে পানি না নামলে মাছ উঠতে পারে না, তাই পানি, প্রকৃতি ও প্রযুক্তির সমন্বয় দরকার।

তাই এখনই নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন যে, ফিসপাস বাংলাদেশের মাৎস্যখাতে আসলে কতটা ভূমিকা রাখছে? অন্যদিকে জলাশয়ের বাস্তুতান্ত্রিক অবস্থার অবক্ষয়ের জন্য ফিসপাস কতটা দায়ী তাও খুঁজে দেখা দরকার। ফিসপাস অকার্যকর হবার কারণগুলো খুঁজে বের করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা মাৎস্য জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের জন্য খুউব গুরুত্বপূর্ণ।


Visited 934 times, 1 visits today | Have any fisheries relevant question?
ফিসপাস বাংলাদেশের মাৎস্যখাতে কতটা ভূমিকা রাখছে?

Visitors' Opinion

এ বি এম মহসিন

প্রফেসর, ফিশারীজ বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী-৬২০৫, বাংলাদেশ। বিস্তারিত ...

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.