
বাংলাদেশ একটি নদীমাতৃক দেশ। নদী ছাড়াও এদেশে আছে অসংখ্য হাওড়, বাঁওড়, বিল, ঝিল ইত্যাদি। বর্ষা মৌসুম শেষ হওয়ার সাথে সাথে এসব জলাশয় থেকে ধরা পড়ে প্রচুর পরিমাণে ছোট ছোট দেশীয় মাছ যেমন- পুঁটি, কাচকি, গুচি, বাইম, টাকি ইত্যাদি। তখন এসব মাছের বাজার মূল্য কম থাকে বিধায় কৃষকেরা সেগুলো শুকিয়ে শুটকি হিসাবে পরবর্তীতে বিক্রি করে। কৃষিতত্ত্ব বিভাগ, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত ‘সিস্টেম গবেষণার মাধ্যমে হাওড় অঞ্চলের কৃষকের জীবন জীবিকার মান উন্নয়ন প্রকল্প’ শিরোনামের গবেষণায় দেখা গেছে যে, প্রচলিত পদ্ধতিতে মাছ শুকানোর ফলে শুটকি মাছের গুণগত মান তেমন ভাল হয় না এবং বেশি দিন সংরক্ষণও করা যায় না। কিন্তু হলুদ ও মরিচের মত মসল্লা লবণসহ ব্যবহার করে মাছ শুকানো হলে মাছের গুণগত মান অনেক দিন অপরিবর্তিত থাকে এবং ভাল থাকা অবস্থায় দীর্ঘদিন সংরক্ষণও করা যায়। ফলে সংরক্ষিত শুকনো মাছ পরবর্তীতে সুবিধাজনক সময়ে বিক্রি করে কৃষকেরা কাঙ্ক্ষিত মুনাফা অর্জন করতে পারেন।
প্রচলিত পদ্ধতিতে মাছ শুকানোর অসুবিধাসমূহ:

হাওড়ের কৃষকেরা প্রচলিত পদ্ধতিতে মাছ শুকাতে গিয়ে যে সকল বাস্তব অসুবিধার সম্মুখীন হচ্ছে সেগুলো হল-
- প্রচলিত পদ্ধতিতে মাছ শুকানোর পূর্বে মাছ পরিষ্কার করা হয় না বলে মাছের সাথে প্রচুর পরিমাণে ময়লা থাকে এবং মাছ শুকাতে তুলনামূলক ভাবে সময় বেশী লাগে।
- এই পদ্ধতিতে মাছ শুকানোর পূর্বে কোন প্রকার স্বাস্থ্যসম্মত পদ্ধতি অনুসরণ করা হয় না বিধায় মাছের নাড়ী-ভুঁড়িতে যেসব অণুজীব থাকে সেগুলো অতিদ্রুত মাছের মানকে নষ্ট করে দেয় এবং ভীষণ দুর্গন্ধ সৃষ্টি করে যা মাছিকে আকৃষ্ট করে রোগজীবাণু বিস্তার দ্রুততর করে। এছাড়াও মাছি মাছের উপর ডিম দিয়ে মাছের গুণাগুণ মানকে আরও দ্রুত নষ্ট করে দেয়।
- অণুজীব এবং কীটপতঙ্গ দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ফলে প্রচলিত পদ্ধতিতে শুকনো মাছের ওজন তুলনামূলক ভাবে কম হয়ে থাকে ফলে শুকানো মাছ বিক্রির সময় কৃষকেরা আর্থিকভাবেও ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
- এছাড়া প্রচলিত পদ্ধতিতে মাছ বেশী দিন সংরক্ষণ করা যায় না বিধায় কৃষকেরা দ্রুত এগুলো বাজারজাত করতে বাধ্য হয়। ফলে কাঙ্ক্ষিত মূল্যে শুটকি বিক্রি করতে পারেন না।
মসল্লা (হলুদ ও মরিচ) ও লবণ ব্যবহার করে মাছ শুকানোর পদ্ধতি:
মাছে নির্দিষ্ট হারে মসল্লা (হলুদ ও মরিচ) ও লবণ ব্যবহার করার পর মাছ শুকানোর পদ্ধতিকে হাওড়ে উন্নত পদ্ধতি হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। কারণ এতে প্রচলিত পদ্ধতির চেয়ে তুলনামূলক ভাবে অধিক স্বাস্থ্যসম্মতভাবে গুণগত মান সম্পন্ন শুটকি পাওয়া সম্ভব হয় যা দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করে রাখা যায় বিধায় কাঙ্ক্ষিত মূল্যে বিক্রি করে কৃষক লাভবান হতে পারে।
মসল্লা (হলুদ ও মরিচ) ও লবণ ব্যবহার করে মাছ শুকানোর পদ্ধতির কলা-কৌশল:

- এ পদ্ধতিতে মাছ শুকানোর আগে মাছকে পরিষ্কার (যেমন- মাছের দেহের ময়লা, নাড়ী-ভুঁড়ি, আঁইশ, পাখনা ইত্যাদি) করে নিতে হবে।
- এরপর মাছকে পরিষ্কার পানি দিয়ে ২-৩ বার ধুয়ে নিতে হবে।
- পরিষ্কার করার পর মাছে পরিমাণমত মসল্লা (হলুদ ও মরিচ) ও লবণ যোগ করতে হবে। প্রথমে প্রতি এক লিটার পরিমাণ পানিতে ৫ গ্রাম মসলা (হলুদ ও মরিচ) ও লবণ মিশিয়ে দ্রবণটিকে একটি বড় মুখওয়ালা পাত্রে রাখতে হবে। দ্রবণে পরিষ্কার করে রাখা মাছ যোগ করতে হবে। এর আধাঘণ্টা পর মাছগুলো দ্রবণ থেকে তুলে নিতে হবে।
- মসল্লা যোগ করার পর পরিষ্কার স্থানে (যেমন- বাঁশের চাটাইয়, মাচা) সূর্যালোকে শুকাতে দিতে হবে। পাখি. মাছ ইত্যাদির উপদ্রব থেকে রক্ষা পেতে জাল ব্যবহার করা যেতে পারে।
মসল্লা ও লবণ ব্যবহার করে মাছ শুকানোর সুবিধাসমূহ:

- মসল্লা ও লবণ ব্যবহার করে মাছ শুকানো হাওড় এলাকায় নতুন ও উন্নত পদ্ধতি হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে। এ পদ্ধতিতে মাছ শুকানোর পূর্বে মাছকে পরিষ্কার করে মশলাযুক্ত পানিতে ডুবিয়ে রাখতে হয়। তারপর রৌদ্রে শুকানো হয়। এভাবে মাছ শুকালে প্রচলিত পদ্ধতির চেয়ে মাছকে অনেকদিন সংরক্ষণ করে রাখা যায় এবং অধিক মূল্য পাওয়া যায়।
- এ পদ্ধতিতে শুকালে প্রচলিত পদ্ধতির চেয়ে সময় কম লাগে, কারণ এ পদ্ধতিতে মাছে মসল্লা ও লবণ প্রয়োগের পূর্বে মাছের নাড়ী-ভুঁড়ি ইত্যাদি পরিষ্কার করে পানি দ্বারা ধুয়ে নেওয়া হয় ফলে ময়লা কম থাকে এবং শুকাতে সময়ও কম লাগে।
- মসল্লা ও লবণ প্রয়োগে মাছ শুকালে মাছের মান তথা পুষ্টিমানের তেমন কোন পরিবর্তন হয় না। কারণ মসল্লা মাছের দেহে প্রতিরোধক হিসাবে কাজ করে বলে অণুজীবসহ কীট-পতঙ্গ মাছের মানের কোন ক্ষতি করতে পারে না। তাছাড়া মসল্লা প্রয়োগের পর মাছকে পরিষ্কার বাঁশের চাটাইয়ে শুকাতে দেওয়া হয় এবং প্রয়োজনে জাল দ্বারা বেড়া দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয় যাতে পাখি বা অন্য প্রাণী শুটকি মাছের কোন ক্ষতি করতে না পারে।
- উন্নত পদ্ধতিতে মাছ শুকালে গুণাগুণ অনেকদিন পর্যন্ত ভাল থাকে বিধায় এর ওজন প্রচলিত পদ্ধতিতে শুকানো মাছের চেয়ে বেশী হয়। ফলে কৃষকেরা আর্থিকভাবে লাভবান হয়।
- উন্নত পদ্ধতিতে মাছ শুকালে অণুজীবসহ বিভিন্ন ধরনের কীট-পতঙ্গ যেমন মশা, মাছি ইত্যাদি মাছের কোন ক্ষতি করতে পারে না। ফলে মাছের গুণগত মান অক্ষুণ্ণ থাকে এবং সংরক্ষণকাল অনেক বেশী হয়। এজন্য কৃষকেরা অধিক মূল্যের সময় বাজারজাত করে বেশি টাকা লাভ করতে পারেন।
- যেহেতু মসল্লা ও লবণ যোগ পদ্ধতিতে মাছ শুকালে মাছের গুণগত মান ভাল থাকে এবং ওজন বেশী হয় তাই এর বাজার মূল্য প্রচলিত পদ্ধতিতে শুকানো মাছের চেয়ে বেশী হয়।
কৃতজ্ঞতা:
- উক্ত গবেষণায় গবেষক হিসাবে সার্বিক সহযোগিতা করেছেন প্রকল্পের সহযোগী প্রধান গবেষক প্রফেসর ড. এম এ সালাম, এ্যাকুয়াকালচার বিভাগ, মাৎস্য বিজ্ঞান অনুষদ, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ। লেখক তাঁর প্রতি গভীরভাবে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছে।
Visited 974 times, 1 visits today | Have any fisheries relevant question?