উন্মুক্ত বা আবদ্ধ জলাশয়ে নিয়ন্ত্রিত পরিবেশ উপযোগী আকারের খাঁচা স্থাপন করে অধিক ঘনত্বে বাণিজ্যিকভাবে মাছ উৎপাদনের প্রযুক্তিই হল খাঁচায় মাছ চাষ। আমাদের দেশে সাম্প্রতিক সময়ে খাঁচায় মাছচাষ নতুন আঙ্গিকে শুরু হলেও খাঁচায় মাছ চাষের ইতিহাস অনেক পুরানো। খাঁচায় মাছচাষ শুরু হয় চীনের ইয়াংকি নদীতে আনুমানিক ৭৫০ বছর পূর্বে। প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতার কারণে আধুনিক কালে খাঁচায় মাছ চাষ ক্রমাগতভাবে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। কেয়ার বাংলাদেশ সর্বপ্রথম বাংলাদেশে খাঁচায় মাছ চাষ জনপ্রিয় করার প্রয়াস হাতে নেয়। প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতা সাধন এবং বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও বিশ্ববিদ্যালয় ক্রমাগতভাবে খাঁচায় মাছ চাষে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করার ফলশ্রুতিতে আমাদের দেশে খাঁচায় মাছ চাষ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। এরই ধারাবাহিকতায় থাইল্যান্ডের প্রযুক্তি অনুকরণে আমাদের দেশে সর্বপ্রথম চাঁদপুরের ডাকাতিয়া নদীতে খাঁচায় মাছ চাষ শুরু হয়। সেই ডাকাতিয়া নদীতে খাঁচায় মাছ এর আলোকে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষিতত্ত্ব বিভাগের সিস্টেম গবেষণার মাধ্যমে হাওরের জনজীবনের জীবন যাত্রার মান উন্নয়ন প্রকল্পের ফিশারিজ কম্পোনেন্ট ২০১০ সাল থেকে ভাসমান খাঁচায় মাছ চাষ শুরু করে।
কোন উন্মুক্ত বা আবদ্ধ জলাশয়ে বাঁশের বানা বা জাল দিয়ে বা অন্য কোন উপকরণ দিয়ে চারিদিক ঘিরে বা বেঁধে খাঁচা তেরি করা হয়। খাঁচায় মাছ চাষের ক্ষেত্রে স্রোত-শীল নদীতে বা হাওরে খাঁচা স্থাপন করা শ্রেয়। খাঁচায় মাছ চাষের জন্য নির্বাচিত জলাশয়ে সারা বছরব্যাপী অথবা ন্যূনতম ছয়মাস ২ মিটার গভীরতায় পানি থাকা প্রয়োজন। সাধারণত পুকুর থেকে পোনা নার্সিং করে ২০ থেকে ২৫ গ্রাম ওজনের হলে তা খাঁচায় মজুদ করা হয়। ২ মাসের মধ্যেই প্রতিটি মাছের ওজন ২০০/২৫০ গ্রাম এ উন্নীত হয়।
মৎস্য আহরণ আর বোরো মৌসুমে বোরো ধান উৎপাদনই হাওর এলাকার লাখ লাখ মানুষের জীবন ধারণের প্রধান অবলম্বন। হাওর অঞ্চল বর্ষা মৌসুমে প্রায় সাত মাস পানিতে নিমজ্জিত থাকে । উক্ত সময়ে হাওরের অধিকাংশ মানুষ হয় মাছ ধরে অথবা অলস ভাবে গল্প-গুজব করে সময় কাটিয়ে দেয়। গ্রামের দরিদ্র কৃষকদের মৌসুমি বেকারত্ব হ্রাসের মাধ্যমে জীবনমান উন্নয়নে সুবিধাভোগীর মধ্যে হাওরের পানিতে ভাসমান খাঁচায় মাছ চাষ করে অলসভাবে কাটানো সময়ের সদ্ব্যবহার এবং একই সাথে অর্থ উপার্জনের পাশাপাশি দেশের প্রাণীজ আমিষের ঘাটতি পূরণ করা সম্ভব । খাঁচায় মাছ চাষে এলাকার মহিলা ও বেকার তরুণ-তরুণীদেরও সম্পৃক্ত করা যায়।
সিস্টেম গবেষণার মাধ্যমে হাওরের জনজীবনের জীবন যাত্রার মান উন্নয়ন প্রকল্পের ফিশারিজ কম্পোনেন্টের সহযোগী প্রধান গবেষক প্রফেসর ড. এম এ সালাম এর তত্ত্বাবধানে বিগত তিন বছর যাবত নেত্রকোণা জেলার মোহনগঞ্জ উপজেলার তেথুলিয়া ইউনিয়নে ডিঙ্গাপোতা হাওরে খাঁচায় তেলাপিয়া চাষের গবেষণা করে আসছে। গবেষণার ফলাফল অনুসারে দেখা গেছে খাঁচা তৈরি, মাছের পোনা (১০০০-১৫০০ খাঁচা প্রতি) এবং মাছের খাদ্যসহ ২৭ ঘন মিটার (৯মি x ৬ মি x ১.৫ মি) একটি খাঁচায় মোট ৩০,০০০-৩৫,০০০ টাকা খরচ হয়। গ্রামের মৌসুমি পুকুরে তেলাপিয়ার পোনা ২৫-৩০ দিন নার্সিং করার পর হাওরে নতুন পানি আসার সাথে সাথে উক্ত পোনা খাঁচায় স্থানান্তরের ব্যবস্থা করা হয় । এই প্রক্রিয়ায় প্রতিটি খাঁচা থেকে ৩-৪ মাসে মাছ উৎপাদন হয় ৪০০-৫০০ কেজি যার বাজার মূল্য ৪৮,০০০-৬০,০০০ টাকা ( ১২০ টাকা কেজি ধরে) অর্থাৎ একটি খাঁচা থেকে উক্ত সময়ে ১৮০০০-২৫০০০ টাকা উপার্জন করা সম্ভব হয়েছে। এই ফলাফল সাধারণ কৃষকের মাঝে খাঁচায় মাছ চাষে ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছে। বিগত তিন বছরের কাজের অভিজ্ঞতার আলোকে বলা যায় উপযুক্ত পৃষ্ঠপোষকতা এবং মূলধনের যোগান পেলে হাওরবাসীরা খাঁচায় মাছ চাষে ব্যাপক হারে এগিয়ে আসবে এবং তা হাওরবাসীর জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
Visited 2,553 times, 1 visits today | Have any fisheries relevant question?