বাংলাদেশে দ্রুতগতিতে মৎস্য জীববৈচিত্র্য হারিয়ে যাওয়ার বিষয়ে মৎস্যবিজ্ঞানীদের মধ্যে আজ আর কোন দ্বিমত নেই। বিষয়টি বিবেচনায় নিয়েই মৎস্য জীববৈচিত্র্য রক্ষায় বর্তমানে নানাবিধ পদক্ষেপ গ্রহণের কথা বলা হলেও তার মূল সুরটিই হচ্ছে দেশীয় মাছের আবাসস্থল ও প্রজননক্ষেত্র সংরক্ষণ। কিন্তু বিষয়টি উপস্থাপন করা যতটা সহজ বাস্তবায়ন করা ততোটাই কঠিন। কারণ এর সাথে ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর অর্থনৈতিক স্বার্থ এবং অধিক মুনাফার আকাঙ্ক্ষা বিষয়ক নানাবিধ প্রভাবক ওতপ্রোতভাবে জড়িত যা আবাসস্থল ও প্রজননক্ষেত্র পুনরুদ্ধার ও সংরক্ষণের প্রধান অন্তরায়। কিন্তু এ অন্তরায়সমূহ দূর করা সম্ভব না হলে দেশের মৎস্য জীববৈচিত্র্য রক্ষায় গৃহীত ব্যবস্থাপনাসমূহ টেকসই করা কোনভাবেই সম্ভব নয়। আমাদের হারাতে শুরু করা সমৃদ্ধ মৎস্য ঐতিহ্য রক্ষায় মৎস্য বৈচিত্র্য সংরক্ষণের উপায় এবং তা বাস্তবায়নের কৌশলের টেকসই উপায় হিসেবে মাছের আবাসস্থল ও প্রজননক্ষেত্র সংরক্ষণের নানান দিক বিস্তৃতভাবে এ লেখায় আলোচনা করা হল।
দেশীয় মাছের প্রাকৃতিক আবাসস্থল ও প্রজননক্ষেত্র ধ্বংস এবং উভয় প্রকৃতির জলাশয়ের মাঝে মাছ চলাচলের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির নেপথ্যের কারণগুলোর অধিকাংশই কৃত্রিম। যেমন- অপরিকল্পিতভাবে বাঁধ ও রাস্তাঘাট নির্মাণ, প্লাবনভূমিতে ধানচাষের ধাঁচে পরিবর্তন, জলাশয় দখল ও ভরাট এবং জলাশয়ের পানি দূষণ, আড়াআড়ি বাঁধ নির্মাণ ও অধিকহারে পানি প্রত্যাহারের প্রেক্ষিতে নদীর মরে যাওয়া ইত্যাদি। সবগুলো বিষয়ই আবার একে অপরের সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। আবার এসব কারণকে দূর করার জন্য যেসব ব্যবস্থাপনা ইতোমধ্যে গ্রহণ করা হয়েছে তার বেশিরভাগই কৃত্রিম (যেমন- ফিশপাস তথা মৎস্যবান্ধব অবকাঠামো নির্মাণ, ক্ষুদ্র পরিসরে অভয়াশ্রম নির্মাণ ইত্যাদি) যা আমাদের দেশের মত গঠন প্রক্রিয়া চলমান এরকম একটি ব-দ্বীপের ক্ষেত্রে কোন ভাবেই কার্যকর হতে পারে নি, হওয়ার কথাও নয়। একটা মিথ্যা যেমন হাজারটা মিথ্যার জন্ম দেয় তেমনই প্রাকৃতিক পরিবেশের একটি কৃত্রিম সংকটের সমাধানকল্পে নেয়া কৃত্রিম ব্যবস্থাপনা কেবলমাত্র কৃত্রিমতাকেই বাড়িয়ে দেয়, সমস্যার টেকসই সমাধান পাওয়া সম্ভব হয় না।
মাছের আবাসস্থল ও প্রজননক্ষেত্র পুনরুদ্ধার এবং এবং উভয় জলাশয়ের মাঝে মাছ চলাচলের প্রতিবন্ধকতা দূরীকরণে প্রথম এবং প্রধান পদক্ষেপ হওয়া উচিত যেসব অপরিকল্পিত বাঁধের কারণে জলাশয়ের ভূপ্রকৃতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তা অপসারণ করা এবং নির্মিত ও নির্মিতব্য রাস্তায় পর্যাপ্ত সেতুর ব্যবস্থা করা যাতে করে বৃষ্টি বা ঢলের পানি স্বাভাবিক গতিতে নদীর দুকূল ভাসিয়ে জমিকে প্লাবিত করে নেমে যেতে পারে। অনেকেই আমার সাথে ভিন্নমত প্রদর্শন করবেন কারণ সেসব বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছিল প্লাবন ভূমিতে বন্যা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে বর্ষায় উচ্চফলনশীল ধানের আবাদ নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে। কিন্তু প্রথমত এসব বাঁধ তার উদ্দেশ্য পূরণ করতে অনেকাংশেই ব্যর্থ হয়েছে। কারণ এসব বাঁধ সম্পূর্ণভাবে বন্যা নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়নি বরং যা হয়েছে তা হল বন্যার স্থান, সময়কাল ও ধরণে পরিবর্তন এনেছে। এই পরিবর্তিত পরিস্থিতির সাথে দেশীয় মাছ এবং দেশীয় বর্ষালী ধান অভিযোজিত হতে না পেরে আজ বিপর্যয়ের মুখে পতিত হয়েছে। দেশীয় বর্ষালী ধান কম উৎপাদনশীল হওয়ায় চাষিরা এর পরিবর্তে উচ্চ ফলনশীল ধান চাষে পক্ষপাতী। অন্যদিকে প্লাবিত জমিতে যতদিন পানি থাকে ততদিন জমির মালিকের একক মালিকানা না থাকায় তিনিও প্লাবনমুক্ত জমি পেতে উৎসাহী। সঙ্গতকারণে জমির মালিকদের অধিকাংশই চায়না তাদের জমি বছর বছর প্লাবিত হোক। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে যত্রতত্র অপরিকল্পিত বাঁধ নির্মাণ করার মাধ্যমে একদিকে যেমন প্লাবনভূমিকে পুরোপুরি বন্যামুক্ত করা সম্ভব হয় নি অন্যদিকে তেমনই প্রতি বছরই কোন না কোন বিল, হাওর ও প্লাবনভূমিতে বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধ ভেঙ্গে ফসলহানির মত নতুন এক অনাকাঙ্ক্ষিত বিপর্যয়ের আবির্ভাব ঘটেছে। প্লাবনভূমিতে দেশীয় বর্ষালী ধান বা পাটের আবাদ কমতে থাকায় জলজ পরিবেশের যে পরিবর্তন ঘটেছে তার সাথে দেশীয় মাছ খাপ খাইয়ে নিতে পারে নি। কারণ দেশীয় বর্ষালী ধান-পাটের ক্ষেতই হচ্ছে দেশীয় ছোট মাছের প্রধান প্রজননক্ষেত্র। আবার বাঁধ ভেঙ্গে সৃষ্ট বন্যা স্বল্পস্থায়ী হওয়ায় (দ্রুতগতিতে প্লাবিত হওয়া ও কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই পানি নেমে যাওয়া) পৃথিবীতে আগত নতুন প্রজন্মের মাছ বড় হবার সুযোগ পাবার আগেই মানুষের খাবারে পরিণত হয় ফলে পরের বছরে পর্যাপ্ত মা-বাবা মাছের স্বল্পতা দেখা দেয় যা মাছের প্রজাতি হুমকির মুখে পড়ার প্রধান কারণ।
তাই দেরীতে হলেও বিবেচনায় আনা প্রয়োজন যে প্লাবনভূমিতে সারা বছর উচ্চ ফলনশীল ধান উৎপাদন করতে যেয়ে মাছের মত একটি গুরুত্বপূর্ণ সম্পদকে আমরা হারিয়ে যেতে দেবো কি না? মানুষের যেমন শক্তির জন্য শর্করা তথা ভাত গ্রহণের প্রয়োজন রয়েছে তেমনই শরীর গঠনের জন্য প্রয়োজন রয়েছে মাছের মত আমিষের। তাই ঢালাওভাবে সারা দেশের প্লাবনভূমিকে সারা বছর উচ্চফলনশীল ধানের জমিতে পরিণত করার কৃত্রিম এই পদ্ধতি থেকে সরে আসা অধিক যুক্তিসঙ্গত। কারণ প্লাবনভূমি ছাড়া অন্যান্য জমি তো রয়েছেই উচ্চ ফলনশীল ধানের আবাদের জন্য। এমনকি প্লাবনভূমিতেও বর্ষাকাল ছাড়া অন্যান্য সময়ে উচ্চ ফলনশীল ধান আবাদ করা যায়। প্লাবনভূমিতে বন্যার সময় পলি পড়ায় তাতে সারও কম লাগে খরচও কম হয়। তাই প্লাবনভূমি ছাড়া অন্যান্য স্থানে সারা বছর এবং প্লাবনভূমিতে বর্ষার সময় ছাড়া অন্যান্য সময়ে উচ্চ ফলনশীল হাইব্রিড ধান চাষ করার পরিকল্পনা গ্রহণ করা প্রয়োজন। প্রয়োজন বর্ষার মৌসুমে দেশীয় বর্ষালী ধান আবাদে চাষিদের উৎসাহিত করা। প্রয়োজনে চাষিদের প্রণোদনা দিয়ে দেশীয় প্রজাতির ধান চাষ তথা রক্ষায় আগ্রহী করে তোলা। প্রয়োজন বর্ষার পানি বৃদ্ধির সাথে সাথে বেড়ে উঠতে সক্ষম দেশীয় ধানের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিতে পর্যাপ্ত গবেষণার আয়োজন করা। মূলকথা অপরিকল্পিত বাঁধ নির্মাণের পূর্বে হাজার বছর ধরে এদেশের প্লাবনভূমি যেভাবে ব্যবহৃত হয়ে এসেছে তাকে সেভাবে চলতে দেয়া যাতে মা-বাবা মাছ কাঙ্ক্ষিত সন্তানের আগমনের প্রয়োজনীয় কার্যক্রমে বাধাহীনভাবে অংশ নিতে পারে এবং মাছের নতুন প্রজন্ম বেড়ে উঠার যথেষ্ট সময় ও সুযোগ পায়।
অপরিকল্পিত বাঁধ ও প্রয়োজনের তুলনায় কম সেতু বিশিষ্ট রাস্তার পাশাপাশি বিশাল জনসংখ্যার চাপ ও ভূমিদস্যুদের লোভী দখলবাজ চরিত্র বাধাহীন ভাবে বিকশিত হওয়ায় প্লাবনভূমি ও নদীর মতো উন্মুক্ত জলাশয়ের আয়তন কমে আসছে ক্রমশ। জলাভূমি হিসেবে স্বীকৃত স্থান ভরাট করা আইনত নিষিদ্ধ হলেও মাছের আবাসস্থল ও প্রজননক্ষেত্র এবং উভয় জলাশয়ের মাঝে মাছের চলাচলের সংযোগ খাল বা নদী দখল হয়ে ভরাট হয়ে যাচ্ছে দ্রুতই। আড়াআড়ি বাঁধ নির্মাণ ও চাষের জন্য নদীর পানি অধিকহারে ব্যবহারের প্রেক্ষিতেও একের পর এক নদী মরে যাচ্ছে। এছাড়াও মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহারসহ নানা ধরণের কৃষি বর্জ্যে আজ প্লাবনভূমি, বিল ও হাওরের পানির রাসায়নিক গুনাগুণ এমনভাবে পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে যে তা মাছের প্রজননের প্রতিকূলতার একটি কারণ হিসেবে বিবেচনায় আসছে। এর সাথে যোগ হয়েছে নদী তীরবর্তী কল-কাখানার বর্জ্যের দূষণ যা নদীকে দূষিত করে মাছকে নদী ছাড়া করেছে অনেক আগে আর বর্ষায় নদীর এই দূষিত পানি প্লাবিত হয়ে বিলে বা হাওরে প্রবেশ করায় সেখানকার পানিও দূষিত হয়ে পড়ছে। এমত অবস্থায় জলাশয় দখল ও ভরাট করা এবং কল-কারখানার বর্জ্যে দূষিত করা থেকে বিরত রাখার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাপনা গ্রহণের বিষয়টি নিশ্চিত করা করা একান্ত জরুরী। মাছের আবাসস্থল ও প্রজননক্ষেত্র পুনরুদ্ধার ও সংরক্ষণে আরও যেসব ব্যবস্থাপনা গ্রহণ করা জরুরী সেসব হল- জলজ বনায়ন সৃজন ও টেকসই মৎস্য ব্যবস্থাপনা কৌশল প্রণয়ন, জলাশয়ের স্বল্পমেয়াদী মুনাফামুখী বাণিজ্যিক ইজারা প্রথার পরিবর্তে দীর্ঘমেয়াদী বিজ্ঞানসম্মত উৎপাদনভিত্তিক জৈবব্যবস্থাপনা পদ্ধতির প্রচলন, উন্মুক্ত জলাশয় হতে মাছ আহরণের ক্ষতিকর উপকরণ ও পদ্ধতির ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ, বৃহৎ পরিসরে অভয়াশ্রম স্থাপন ও তার সঠিক রক্ষণাবেক্ষণ, প্লাবনভূমির কৃষিজমিতে পরিমিত সার ব্যবহার করা, ক্ষতিকর কীটনাশক ব্যবহারের পরিবর্তে পরিবেশবান্ধব পদ্ধতিতে ক্ষতিকর পোকামাকড় দমন করা, কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে বিপন্ন দেশীয় প্রজাতির মাছের পোনা উৎপাদন, চাষ ও উন্মুক্ত জলাশয়ে অবমুক্তকরণ, বিদেশী মাছ আমদানির পূর্বে দেশীয় মৎস্য প্রজাতি ও জলজ পরিবেশের এর প্রভাব সম্পর্কিত গবেষণার পর ভাল ফলাফল সাপেক্ষে আমদানির সিদ্ধান্ত নেয়া, সময় উপযোগী মৎস্য, জলাশয় ও পানিসম্পদ বিষয়ক আইন প্রণয়ন ও প্রচলিত মৎস্য সম্পদ রক্ষা ও সংরক্ষণ আইনের যথাযথ প্রয়োগ এবং মৎস্যজীবীসহ সকল জনসাধারণের মধ্যে এবিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টি।
Visited 1,456 times, 1 visits today | Have any fisheries relevant question?