দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মাছ নীল গোউরামি ও সোনালী গোউরামি (Trichogaster trichopterus) আমাদের দেশে আনা হয় থাইল্যান্ড ও ভারত থেকে। বর্তমানে ঢাকা ছাড়াও খুলনা, ময়মনসিংহ, রাজশাহী ইত্যাদি বড় বড় শহরের এ্যাকুয়ারিয়ামের বাহারি মাছের দোকানে এই মাছের দেখা মেলে। প্রকৃতিতে এরা কর্দমাক্ত ও উদ্ভিদময় জলজ পরিবেশে বসবাস করে। ল্যাবিরিন্থ (Labyrinth) নামক বাতাস থেকে অক্সিজেন গ্রহণে উপযোগী অতিরিক্ত শ্বাস অঙ্গ থাকায় এরা কম অক্সিজেনের উপস্থিতি রয়েছে এমন স্থানেও দিব্যি বেঁচে থাকতে পারে (Bailey and Stanford, 1999)।
শ্রেণীতাত্ত্বিক অবস্থান (Systematic position)
পর্ব: Chordata (chordates)
শ্রেণী: Actinopterygii (Ray-finned fishes)
বর্গ: Perciformes (perch-like fishes)
পরিবার: Osphronemidae (giant gouramis)
গণ: Trichogaster
প্রজাতি: Trichogaster trichopterus (Pallas, 1770)
ভ্যারাইটি (Variety):
আমাদের দেশে এই প্রজাতির গোউরামির দুটি ভ্যারাইটি পাওয়া যায়। যথা-
- নীল গোউরামি (Blue Gourami) এবং
- সোনালি (Golden) বা হলুদ (Yellow) গোউরামি (Gourami)।
সমনাম (Synonyms)
Labrus trichopterus Pallas, 1770
Nemaphoerus maculosus Bleeker, 1879
Osphromenus insulatus Seale, 1910
Osphromenus siamensis Günther, 1861
Stethochaetus biguttatus Gronow, 1854
Trichopodus trichopterus (Pallas, 1770)
Trichopus sepat Bleeker, 1845
Trichopus trichopterus (Pallas, 1770)
সাধারণ নাম (Common name)
বাংলা: নীল গোউরামি, সোনালী গোউরামি বা হলুদ গোউরামি
English: Blue Gourami, Golden Gourami or Yellow Gourami, Three Spot Gourami, Opaline Gourami
বিস্তৃতি (Distribution)
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া তথা- চীনের (China) ইনান (Yunnan) প্রদেশ, মায়ানমার (Myanmar), লাওস (Laos), থাইল্যান্ড (Thailand), কম্বোডিয়া (Cambodia), ভিয়েতনাম (Viet Nam) ও মালয়েশিয়া (Malaysia) ইত্যাদি। তবে এ্যাকুয়ারিয়ামের বাহারি মাছ হিসেবে এই মাছ পৃথিবীর দেশে দেশে বিস্তার লাভ করেছে যেমনটা করেছে বাংলাদেশ।
Fishbase (2014) অনুসারে এদের বিস্তৃতি: 26°N – 10°N এবং 99°E – 108°E।
সংরক্ষণ অবস্থা (Conservation status)
Categories & Criteria 2001 (version 3.1) অনুসারে এই মাছের বর্তমান অবস্থা: Least Concern (LC) (IUCN Redlist, 2014) অর্থাৎ এটি বর্তমানে হুমকির সম্মুখীন নয়।
দৈহিক গঠন (Morphology)
লম্বা দেহ পার্শ্বীয়ভাবে বেশ চাপা। দেহের উভয় পাশে তিনটি করে কাল বর্ণের দাগ দেখতে পাওয়া যায় যার মধ্যে দুটি দেহের মাঝামাঝিতে অন্যটি পুচ্ছ পাখনার নিকটে (Saxena, 2003)।
এদের মুখ ছোট ও তির্যক। আঁইশ মাঝারি ও অনিয়মিতভাবে সজ্জিত। এদের পৃষ্ঠপাখনায় ৬-৮টি কণ্টকিত রশ্মি ও ৭-১০টি নরম রশ্মি, পায়ুপাখনায় ৯-১২টি কণ্টকিত রশ্মি ও ৩০-৩৮টি নরম রশ্মি উপস্থিত। জীবন্ত অবস্থায় এরা নীলাভ (নীল গোউরামি), বাদামী বা হলুদ বা সোনালী (সোনালী গোউরামি) বর্ণের হয়ে থাকে। উভয় ভ্যারাইটিতেই পৃষ্ঠদেশ জুড়ে কালো বর্ণের অনিয়মিত দণ্ডাকৃতির তির্যক দাগ দেখতে পাওয়া যায়।
বাংলাদেশের বিভিন্ন এ্যাকুয়ারিয়াম থেকে সংগৃহীত নমুনার রেকর্ডকৃত তথ্যানুসারে এই মাছের আদর্শ দৈর্ঘ্য, ফর্ক দৈর্ঘ্য (Fork lenght), দেহ উচ্চতা, মাথার দৈর্ঘ্য এবং চোখের ব্যাস মোট দৈর্ঘ্যের যথাক্রমে ৭৮.২৬-৭৮.৫৭, ৯১.০৭-৯২.১৭, ২৬.০৮-২৬.৭৯, ২২.৬১-৩১.২৫ ও ২২.৮৫-৩০.৭৭ শতাংশ (Galib and Mohsin, 2011)।
সর্বোচ্চ দৈর্ঘ্য (Maximum length)
বাংলাদেশে এই মাছের রেকর্ডকৃত সর্বোচ্চ দৈর্ঘ্য পনের সেমি (Galib and Mohsin, 2011)।
আবাস্থল (Habitat)
এরা উষ্ণ পরিবেশের স্বাদুপানির মাছ। জলাশয়ের তলদেশের নিকটবর্তী অঞ্চলে এরা থাকতে পছন্দ করে। এরা মূলত নদীর মাছ তবে পুকুর, ডোবা, জলাভূমি ইত্যাদিতেও এদের দেখা মেলে। কারণ প্রতি বর্ষায় প্রজননের উদ্দেশ্যে নদী থেকে অভিপ্রয়াণ করে প্লাবন-ভূমি, জলাভূমি, জলজ উদ্ভিদ সমৃদ্ধ উন্মুক্ত জলাশয়ে আসে এবং প্রজনন শেষে নদীতে ফিরে যায় (Seriouslyfish, 2014)।
খাদ্য এবং খাদ্যাভ্যাস (Food and feeding habit)
প্রকৃতিতে এরা সর্বভূত অর্থাৎ উদ্ভিদ ও প্রাণী উভয় ধরণের খাবারই এরা খেয়ে থাকে। তবে প্রধানত স্থলজ ও জলজ উদ্ভিদ, শেওলা, ক্ষুদ্রাকৃতির অমেরুদণ্ডী, বিভিন্ন ধরণের প্রাণিকণা (zooplankton), ক্রাস্টেশিয়ানস (crustaceans) ও পতঙ্গের (insect) লার্ভা (larvae), ডেট্রিটাস (detritus) ইত্যাদি খেয়ে থাকে।
এ্যাকুয়ারিয়ামে এরা বিভিন্ন ধরনের খাবার যথা জীবন্ত প্রাণী, ফ্রিজে সংরক্ষিত খাবার এবং প্যাকেটজাত খাবার খেয়ে থাকে (Galib and Mohsin, 2011)।
জীবনকাল ও প্রজনন (Lifecycle and Breeding)
এর জীবনকাল পাঁচ বছরের চেয়েও বেশি (Fishlore, 2014)। একই বয়সের পুরুষেরা স্ত্রীদের চেয়ে লম্বা হয়ে থাকে। পুরুষের পৃষ্ঠ পাখনা তুলনামূলক লম্বা এবং এর প্রান্ত তীক্ষ্ণ অন্যদিকে স্ত্রীদের পৃষ্ঠ পাখনা তুলনামূলক খর্বাকার এবং এর প্রান্ত গোলাকার (Saxena, 2003)।
এরা ডিম পাড়া মাছ। এ্যাকুয়ারিয়ামে এই মাছের প্রজননের উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করতে পারলে সহজেই প্রজনন করানো যায়। প্রজনন এ্যাকুয়ারিয়ামে ৬-৮ ইঞ্চি পানি থাকলেই চলে। এর সাথে অধিক পরিমাণে জলজ ভাসমান উদ্ভিদের উপস্থিতির প্রয়োজন হয়। একটি পুরুষের বিপরীতে ২-৩টি স্ত্রী মাছ রাখা আবশ্যক। স্ত্রীদের উদর যখন ডিম ধারণের কারণে স্ফীত হয়ে যায় তখন পুরুষেরা ভাসমান জলজ উদ্ভিদের ফাঁকে ফাঁকে পানির উপরিতলে বাতাস ও মিউকাস ব্যবহার করে বুদবুদের বাসা (bubble nest) তৈরি করে। স্ত্রীরা ডিম পাড়ার পর পুরুষেরা সেই ডিম প্রথমে নিষিক্ত করে এবং পরবর্তীতে মুখে পুড়ে বুদবুদের বাসায় ছুঁড়ে মারে। ডিম থেকে বাচ্চা ফোটা পর্যন্ত ডিমগুলো বুদবুদের বাসায় সংরক্ষিত থাকে এবং বাবারা পাহারা দেয়। ডিম পাড়ার পর স্ত্রী মাছ অন্য এ্যাকুয়ারিয়ামে সরিয়ে নেয়া আবশ্যক।
উপযোগী পরিবেশ (Suitable Environment)
Seriouslyfish (2014) অনুসারে এদের জন্য ন্যুনতম এ্যাকুয়ারিয়ামের আকার ৩৬x১২x১২ ইঞ্চি বা ৯০x৩০x৩০ সেমি এবং এ্যাকুয়ারিয়ামের পানির তাপমাত্রা ২৪-৩০ ° সে., পিএইচ ৫.৫-৮.৫ এবং হার্ডনেস ৩-৩৫ dH। Fishlore (2014) অনুসারে এদের অনুকূল তাপমাত্রা ৭৪-৮২° ফা. বা ২৩-২৮° সে. এবং পিএইচ ৬-৮।
প্রকৃতিতে এই মাছের অনুকূল পরিবেশ হচ্ছে- পিএইচ (pH): ৬-৮, হার্ডনেস (Hardness): ৫-১৯ dH এবং তাপমাত্রা ২২-২৮ ডিগ্রী সে (Fishbase, 2014)।
রোগ (Diseases)
বাংলাদেশে এই মাছের রোগের উপস্থিতি বিষয়ক কোন তথ্য পাওয়া যায় না।
অর্থনৈতিক গুরুত্ব (Economic importance)
এ্যাকুয়ারিয়ামের বাহারি মাছ হিসেবে পৃথিবীব্যাপী এর চাহিদা রয়েছে। চাষের মাছ হিসেবেও এর ব্যবহার রয়েছে। এছাড়াও অনাকাঙ্ক্ষিত জলজ প্রজাতির লার্ভা (larvae) নিয়ন্ত্রণে এদের ব্যবহার করা যেতে পারে (Shammi and Bhatnagar, 2002)।
বাজার মূল্য:
বাংলাদেশে প্রতি জোড়া নীল ও সোনালি গোউরামি পাওয়া যায় ৩০-১২০ টাকার মধ্যে (Galib and Mohsin, 2011)।
তথ্য সূত্র (References)
- Bailey M and Stanford G 1999. Practical Fishkeeping, published by Sebastian Kelly, 2 Rectory Road, Oxford OX4 IBW, 128 p
- Fishbase 2014. Species Summary: Trichogaster trichopterus. Retrieved on March 13, 2014.
- Fishlore 2014. Trichogaster trichopterus. Retrieved on March 13, 2014.
- Galib SM and Mohsin ABM 2011. Cultured and Ornamental Exotic Fishes of Bangladesh: Past and Present. LAP LAMBERT Academic Publishing. 176pp.
- IUCN Redlist 2014. Trichopodus trichopterus. Retrieved on March 13, 2014.
- Saxena A 2003. Aquarium Management. Daya Publishing House, Delhi 110035, India, 230 p.
- Seriouslyfish 2014. Species Profile: Trichopodus trichopterus, Three-spot Gourami. Retrieved on March 13, 2014.
- Shammi QJ and Bhatnagar S 2002. Applied Fisheries, Published by Agrobios (India), Agro House, Behind Nasrani Cinema, Chopasani Road, Jodhpur 342 002, India, 328 p.
Visited 2,396 times, 1 visits today | Have any fisheries relevant question?